'রেড নোটিশ' দিয়ে কি আরাভ খানকে বাংলাদেশে ফেরত আনা যাবে? 

সংগৃহীত ছবি

'রেড নোটিশ' দিয়ে কি আরাভ খানকে বাংলাদেশে ফেরত আনা যাবে? 

অনলাইন ডেস্ক

সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার এনায়েত বাজার পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।

তিনি বলেছেন, আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। ইন্টারপোল সেই আবেদন গ্রহণ করেছে।

পুলিশ বলছে, এ আরাভ খানই ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার অন্যতম পলাতক আসামি রবিউল ইসলাম। এজন্য তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান দুবাইয়ে রবিউল ইসলামের একটি গয়নার শোরুম উদ্বোধনে গেলে বিষয়টি আলোচনায় আসে।

রবিউল ইসলাম কীভাবে দেশত্যাগ করলেন, এ ক্ষেত্রে কোনও পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে কি না সেই বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে আইজিপি জানিয়েছেন।

পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে রবিউল ইসলামের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে, সেখানে তার বিরুদ্ধে অন্তত ৯টি গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। মামলার সংখ্যা আরও বেশি।

রেড নোটিশ জারি হলে দেশে ফেরানো যায়?

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান জানান, ইন্টারপোল যদি খবর পায় যে এই অভিযুক্ত ওই দেশের, ওই ঠিকানায় অবস্থান করছে, ইন্টারপোল সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। ইন্টারপোল সে দেশের পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে তাকে গ্রেফতার অনুরোধ জানায় এবং অভিযুক্তকে দেশের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারে।

বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রেড নোটিশ জারি করা আসামীদের দেশে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে। এক্ষেত্রে ইন্টারপোল যদি সহযোগিতা করে থাকে তাহলে রবিউল ইসলামকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু সেক্ষেত্রে রবিউল ইসলাম কোথায় আছেন, পুলিশের সেটা বের করা জরুরি বলে তিনি জানান।

তিন বছর আগে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের পর মানব-পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল বাংলাদেশ। তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল৷ এর মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা গিয়েছে। আবার রেড নোটিশ-প্রাপ্ত অনেকে আত্মগোপনে থাকায়, তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। ফলে দেশেও ফেরত আনা যায়নি।

অর্থ পাচার মামলার আসামী পি কে হালদারকে ধরতে পুলিশ রেড নোটিশ জারির আবেদন করলেও তার নাম এখনও ইন্টারপোলের বাংলাদেশি ‘ওয়ান্টেড পার্সন’ এর তালিকায় নেই। ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে এই নোটিশ আদৌ জারি করবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।

ইন্টারপোল কীভাবে কাজ করে

ইন্টারপোল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন হল এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যেটি সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত ও সমন্বয় করে। এর প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। যেন বিশ্বের সব পুলিশ অপরাধের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করতে পারে। যদি একটি দেশের আসামি সেখানে অপরাধ করার পর অন্য দেশে চলে যায়, তখন সেই আসামীকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে।

সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডেটা বিশ্লেষণ সেইসাথে পলাতকদের খুঁজে করতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়। তবে ইন্টারপোল কোন আসামীকে ধরিয়ে দেয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না বলে জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান।

তিনি জানান, যদি কোন দেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আবেদন জানায় তাকে ওই অভিযুক্তের অপরাধ বিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলা কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে দিতে হয়।

ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে তার বিরুদ্ধে কোন নোটিশ জারি করা হবে কি হবে না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়। ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়।

মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেস রয়েছে যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন : যেমন: অপরাধীর ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন, এবং জালিয়াতির তথ্য ইত্যাদি পাওয়া যায়।

এসব তথ্য পুলিশ বিশ্বব্যাপী অ্যাক্সেস করতে পারে। এতে পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা অপরাধীদের খুঁজে বের করা সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্ত করা সহজ হয়।

দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব-পাচার, অস্ত্রপচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।

রেড নোটিশ

ইন্টারপোলের নোটিশ কমলা, নীল, হলুদ, লাল, সবুজ, কালোসহ সাত ধরণের হয়ে থাকে। এরমধ্যে রেড নোটিশ জারি করা হয় মূলত গুরুতর ও বিপজ্জনক অপরাধীদের ক্ষেত্রে। ইন্টারপোল এই নোটিশকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখে। কারণ ওই ব্যক্তিকে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচনা করা হয়।

মোখলেসুর রহমান বলেন, “ওই অপরাধীর সম্পর্কে মোটামুটি যা তথ্য আছে আমাদের তা দেয়া লাগে। ইন্টারপোল যদি তথ্য প্রমাণ বিচার বিশ্লেষণ করে সন্তুষ্ট হয় তাহলে রেড নোটিশ জারি করে। এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ”

একবার কারও বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হলে ইন্টারপোল তার সব সদস্য দেশকে ওই রেড নোটিশ-প্রাপ্ত ব্যক্তির দিকে নজর রাখতে বলে। এবং তার প্রত্যর্পণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে বলে। তবে রেড নোটিশ কোন গ্রেফতারি পরোয়ানা নয় এবং ইন্টারপোল কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নয় যারা গ্রেফতারের নির্দেশ দিতে পারে।

এ কারণে ইন্টারপোল অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে আরেক দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বাধ্য করতে পারবে না।

এখন কোন দেশ যদি তাদের নিজস্ব বিবেচনায় বা মানবাধিকার প্রশ্নে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় সেক্ষেত্রে ইন্টারপোল বা তাদের জারিকৃত রেড নোটিশের মাধ্যমে কিছু করা সম্ভব না।

যদি গ্রেফতার করতেই হয়, তাহলে অভিযুক্ত যে দেশে আছেন সেই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে হবে। এক্ষেত্রে তারা নিজ দেশের বিচারিক আইন মেনে চলবে। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়া নির্ভর করছে তাদের ওপর।

তবে কারও বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ থাকলে তাকে যে দেশে খুঁজে পাওয়া যায় সেই দেশ তার সম্পদ জব্দ, চাকরীচ্যুত এবং তার ভিসা প্রত্যাহার করে দিতে পারে।

রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশি

যেখানে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে সেই দেশকেই রেড নোটিশের আবেদন জানাতে হবে। অভিযুক্ত যে দেশের নাগরিকই হোক না কেন। তবে একবার আবেদন পাওয়ার পর রেড নোটিশ প্রকাশ করতে ইন্টারপোল কিছুটা সময় নেয়।

বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত ৬২ জন নাগরিকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি আছে বলে সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেখা গিয়েছে। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের অপরাধের ধরণ, ঠিকানা, বয়স ও ছবি দেয়া আছে। সেখানে রবিউল ইসলাম বা আরাভ খান নামে কাউকে এখনও তালিকাভুক্ত হতে দেখা যায়নি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।