বৃদ্ধ জাহাঙ্গীর আলম, বাড়ি কুমিল্লার হোমনা উপজেলায়। বর্তমানে থাকেন ঢাকায়। নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই তার। সারাদিন এখানে-সেখানে ঘোরাঘুরির পর রাত্রিযাপন করেন গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার ও তার আশপাশের এলাকায়।
শুধু জাহাঙ্গীর আলম নন, তার মতো দুই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রতি রমজানে একসঙ্গে ইফতার করেছেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। তাদের কেউ পেশায় ভিক্ষুক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শ্রমিক, কেউ চাকরিজীবী।
মঙ্গলবার ইফতারের সময় একই সারিতে জাহাঙ্গীর আলমের পাশে বসেছিলেন ব্যবসায়ী মনজুরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম মার্কেটে ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান আছে তার। প্রতি রমজানে না পারলেও সুযোগ পেলেই ইফতার করতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে চলে আসেন তিনি। মনজুরুল ইসলামের দাবি, আর কোথাও ইফতারের সময় এত বেশি শ্রেণির মানুষের সমাগম হয় না।
তিনি বলেন, "অন্য যেকোনো ইফতার আয়োজনে গেলে শুধু নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষের দেখা পাওয়া যায়। কোথাও হয়তো চাকরিজীবীরা একসাথে হয়ে ইফতার করছেন, আবার কোথাও শুধু ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বায়তুল মোকাররম মসজিদে সব শ্রেণির মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। এখানে এলে সব শ্রেণির মানুষের দেখা পাওয়া যায়। এখানে গরিব-ধনী, শ্রমিক-মালিকের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবার একটাই পরিচয়―'রোজাদার'। এই সম্প্রীতির টানেই ছুটে আসি এখানে। "
জানা গেছে, রমজান মাসজুড়ে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি মুসল্লির জন্য ইফতারের আয়োজন করেছে দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মুসল্লি কমিটির সভাপতি হাজি মো. ইয়াকুব আলী জানান, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, যার আশপাশে রয়েছে অসংখ্য হতদরিদ্র রোজাদার মুসল্লি। আবার এই এলাকায় ব্যবসায়িক কারণেও অনেকে আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। যেখানে আসরের নামাজের পর চিন্তা করতে হয় রোজকার ইফতার নিয়ে। আর তাদের জন্যই মাসজুড়ে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মুসল্লি কমিটি প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি রোজাদার মুসল্লির জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করেছে।
ইফতার করার জন্য মসজিদের আরেক সারিতে বসেছিলেন মোহাম্মদ মাহাবুব আলম। তার বাড়ি রংপুরের পায়রাবন্দে। পুরাণ ঢাকার চকবাজারে শ্রমিকের কাজ করেন। থাকেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের বারান্দায়। এই রমজানে তিনিও প্রতিদিন কাজ শেষে ইফতারের আগে চলে আসেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে। তার পাশেই বসেছিলেন মো. সেলিম নামের এক যুবক। তিনি একটি পোশাকের শোরুমে চাকরি করেন। সেলিমের পাশে বসা শিশুটির নাম রাকিব। ছিন্নমূল রাকিব সারাদিন প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায়। রেজা না রাখলেও ইফতারের সময় হলেই বিনা মূল্যে ভালো খাবারের আশায় ছুটে আসে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম শায়খুল হাদিস মুফতি মুহিব্বুল্লাহিল বাকী আন নদভী বলেন, 'পবিত্র রমজানে মাসব্যাপী বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইফতার বিতরণের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাজুস প্রেসিডেন্ট ও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মুসল্লি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা সায়েম সোবহান আনভীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। রোজাদার ব্যক্তিদের ইফতার করানো খুবই সওয়াবের একটি কাজ। কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে তিনি রোজাদারের সমান সওয়াব পান। সায়েম সোবহান আনভীর রমজানের প্রতিদিনই বায়তুল মোকাররম মসজিদে হাজার হাজার মানুষকে ইফতার করিয়েছেন। আল্লাহ যেন তাকে উত্তম প্রতিদান দেন। দোয়া করি তিনি যেন আগামীতে আরও বেশি মানুষকে ইফতার করানোর তৌফিক অর্জন করেন। শুধু বায়তুল মোকাররম মসজিদই নয়, সারা দেশে তার এই সেবা ছড়িয়ে পড়ুক। '
এদিকে বুধবার মাসব্যাপী বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইফতার বিতরণের সমাপনী কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সুস্থতা কামনা করে কোরআন খতম ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যাবসায়ীক সফলতা কামনা করে দুই হাত তুলে দোয়া করেন হাজার হাজার মুসল্লি। একই সাথে দেশব্যাপী চলমান দাবদাহে মানুষের ভোগান্তি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করেন রোজাদাররা।