সাম্যবাদী নজরুল

সংগৃহীত ছবি

সাম্যবাদী নজরুল

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদ আর মার্কস-এঙ্গেলসের সাম্যবাদের মাঝে কিছু মৌলিক এবং কাঠামোগত পার্থক্য রয়েছে। মার্কস ও এঙ্গেলস যেমন অর্থনৈতিক দিকটিকেই অসাম্যের মূল হিসেবে দেখেছেন এবং তা দূরীকরণে আর্থিক ব্যবস্থাপনাকেই প্রধান হিসেবে বিবেচনা করেছেন; নজরুল পরাধীন পিছিয়ে পড়া ভারতে অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার পাশাপাশি কখনো কখনো আর্থিক সংকটের চেয়েও সাম্প্রদায়িকতা, জাত ভেদ, সামাজিক কুসংস্কারকে আরও জনঅনিষ্টকারী উপাদান হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। উপমহাদেশে জন্মে নজরুল অসাম্যের সংকটে মানবতা কীভাবে ভুলুন্ঠিত হয় তা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। অর্থ, শ্রম বা জমি-জমা, সম্পদ, জান-মাল হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও জাতপাত, ধর্ম-অধর্ম কীভাবে হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে তার নানা কৌশল বা অপকৌশল তিনি প্রত্যক্ষ করেন কাছে থেকে।

নজরুল সাম্যবাদকে তাঁর জীবন দর্শন দিয়ে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাই তিনি সাম্যবাদের চলমান ধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হননি। তাঁর অতিঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফ্ফর আহ্‌মেদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি পার্টিতে যোগ দেননি। কারণ তিনি পার্টির নিয়মকানুন মেনে চলার মতো মানুষ ছিলেন না, তিনি চলতেন আপন খেয়ালে।

তিনি যে লিখেছিলেন, ‘আমি দলে যাই যত নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খল। ’ তাঁর এই বক্তব্য শুধু কবিত্বের কথা ছিল না। এ শৃঙ্খল ভাঙার আকুতি তাঁর নিজের স্বভাবের মধ্যেই প্রোথিত ছিল।

তাছাড়া, প্রথম দিকে তাঁর হৃদয়ে অফুরন্ত মানবপ্রেম ছিল। তিনি চেয়েছেন মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, দরিদ্ররা দুবেলা দুমুঠো খেতে পারবে। শাসকেরা তাদের অধীনস্তদের অধিকার বুঝিয়ে দেবে। রাষ্ট্র জনগণের অধিকার সংরক্ষণ করবে। তিনি এ সকল কথা তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে সকলের মাঝে উপস্থাপন করেন। তাঁর সেই সময়কালের সাহিত্যকর্মগুলোতে তার প্রকাশ ঘটে।

কবি এ সময়ে একগুচ্ছ কবিতা লেখেন যা ‘সাম্যবাদী’ নাম দিয়ে প্রকাশিত হয়। এ কবিতাগুচ্ছ তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর অন্যতম। কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘ঈশ্বর’ থেকে আরম্ভ করে ‘চোর- ডাকাত’, ‘কুলি-মজুর’, ‘বীরঙ্গনা’সহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে। কবিতাসমূহে সাম্যবাদ সম্পর্কে কবির ধারণা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন: ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় কবি বলেছেন, ‘সিক্ত যাদের সারা দেহ-মন মাটির মমতা-রসে/এই ধরণীর তরণীর হাল রবে তাহাদেরই বশে!’ অর্থাৎ শ্রমজীবীদের শ্রমের বিনিময়ে সভ্যতা গড়ে

ওঠে। সুতরাং সভ্যতার পরিচালিকা শক্তি তাদেরই হাতে ন্যস্ত থাকার কথা; এ কবিতাগুচ্ছের প্রথম কবিতা ‘সাম্যবাদী’র বক্তব্যও মূলত একই। এ কবিতায় তিনি বলেছেন, মানুষে-মানুষে সব ধর্মীয় এবং জাতিগত ব্যবধান ঘুচে গেছে, ‘যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান। পার্সি, জৈন, ইহুদি, সাঁওতাল, ভীল, গারো?’ কারণ, মানুষের ‘হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির- কাবা নাই। ’ এবং ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ ভিখারি, চাষি, চণ্ডাল, রাখাল—মানুষ হিসেবে সবারই অভিন্ন পরিচয়। বিচিত্র নামের আড়ালে এসব কবিতার মূলে আছে মানবপ্রেম এবং শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সামাজিক সাম্য। এই হলো নজরুলের সাম্যবাদী চিন্তার স্বরূপ।

এ সময়কার কিছু কবিতায় সমকালীন রাজনীতির কথাও তিনি তুলে ধরেছেন। তিনি ‘সর্বহারা’ ও ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে সামাজিক সাম্য ও দরিদ্রদের অধিকারের কথা লেখেন, তিনি দূর থেকে কুলি-মজুর-চাষি-ধীবর সবার দুখে দুখি হয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্রদের জন্য তাঁর অন্তরের গভীর বেদনা প্রকাশ করেন কবিতাসমূহের মাধ্যমে।

ধনীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেছেন, দরিদ্ররা তাদের দ্বারে এসেছে অধিকার নিয়ে, তাদের ভাগ তাদের দিয়ে দাও, নয়তো ওরা কেড়ে নেবে। আলোচ্য কবিতাগুলো তাই সাম্যবাদী ও শ্রেণিসংগ্রাম ধারণায় সম্পৃক্ত। কিন্তু এ কবিতাগুলোতে আরেকটি বৈশিষ্ট্য নির্ভুলভাবে দেখা যায়, তা হলো সাম্যবাদী ধারণার সঙ্গে তাঁর নব্য-ধর্মীয় চেতনা ও এ কবিতাগুলোয় একাকার হয়ে আছে। সাধারণভাবে বিশ্বকে কোনো ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না, এটি অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও মাপা যায় না। এই বিশ্ব কোনো ভাষাভাষি দিয়েও সংঙ্গায়িত করা যায় না। ধর্মের সংকীর্ণতা ও ভৌগলিক বিভাজন যেভাবে মানুষ থেকে মানুষকে পৃথক করেছে, তাঁর সংকট নজরুল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে তাঁর জীবনের সুকুমার-সুন্দর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। জীবনের সবচেয়ে নিষ্পাপ চাওয়া, নির্মোহ আকাঙ্ক্ষা দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেছেন- কীভাবে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী, পরিচয় মানুষের অধিকারকে হরণ করে, সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে। তিনি প্রতিষ্ঠিত অনেক শক্তিধর ধর্ম-হিন্দু বা মসুলমান ধর্মের পাশাপাশি জৈন বা নৃঃগোষ্ঠীর ধর্মকে নিয়ে এসেছেন সমগুরুত্ব দিয়ে।

তিনি ইসলামের যে বিশাল শক্তিধর ধর্ম প্রচারের আবেদন তাও সকলের সামনে নিয়ে এসেছেন, ঠিক তেমনি কম ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা অনুসৃত ধর্ম শিক ধর্মের কথাও তিনি বলেছেন। তিনি ছোট নৃঃগোষ্ঠী গারোদের কথা বলেছেন। আরবের বেদুঈনদের কথা বলেছেন। যিশু খ্রিস্টের পাশাপাশি ইহুদি ধর্মের কথা বিবেচনায় এনেছেন। তাঁর কাছে কোনো ধর্মই ছোট নয়। নজরুল বিশ্বাস করতেন, আমরা সকলে পিঠে এত ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন, বেদ, ইঞ্জিল, বাইবেল—এর বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। তাঁর কোনো গুরুত্ব নেই। তিনি মনে করেন, এত অবারিত সৌন্দর্যে ভরা বিশাল মাঠের মাঝে যে ফুলের বাগান মানব দৃষ্টিতে অবলকন করে, সকলকে বিমোহিত করে, সেই সৌন্দর্য যদি তোমাকে টানতে না পারে, তাহলে তুমি কিতাব বা গ্রন্থের ভারে নূয্য অবস্থা থেকে উত্তরণ পাবে না। ধর্মের যে শক্তি, পেশির যে শক্তি, অশির যে শক্তি তাঁর কাছে তুমি বন্দি হয়ে থাকবে। তোমার হৃদয় তুমি খুলে দেখ ধর্মের সকল কল্যাণের বাণী সেখানেই রয়েছে, হোক সে মসুলমান, হিন্দু, বোদ্ধ,খ্রিস্টান, জৈন, ইহুদি, বেদুঈন বা গারো।

তুমি যদি তোমার হৃদয়কে খুলে প্রাণ উন্মোচন করে দেখ, তবে তুমি সকল ধর্মের শ্রেষ্ঠ মর্মবাণী হৃদয়ের মাঝে দেখতে পাবে। তোমার কিতাবের বোঝায় নুয্য হয়ে নিঃশেষ হওয়ার কোনোই অর্থই থাকে না। মূল অর্থ তুমি যদি সত্যিকারের ধর্মের যে সুন্দর অমর বাণী, যে বাণী সুন্দর, যে বাণী মুক্তির, যে বাণী কল্যাণের, যে বাণী মানুষকে অমরত্ব দেবে, যে বাণী মানুষের সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বার উন্মোচন করে দেবে; সে বাণী লিখিত আছে তোমার অন্তরে। এটি বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, ফার্সি দিয়ে নয়, এটি জীবনের অমর অক্ষরে লেখা। এ লেখা সাধারণ কালি বা কলম দিয়ে লিখা নয়। অমর বাণীগুলো সেই অলিখিত অনির্নিত অক্ষরে লেখা, যেটি আসলে নির্নিত হয়েছে মানুষের সৃষ্টির সময়েই, আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। এ আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষা ছিল নজরুলের অন্তরে।

নজরুল যে সাম্যের কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল মানুষের অধিকারের সাম্য, সেটি শুধু অর্থনৈতিক অধিকার নয়, রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামোর অধিকার নয়—এ অধীকার মানবিক অধিকার, এ অধিকার হলো সাম্যের বাণীর মর্মার্থ। এ অধিকার যদি মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া যায়, তবে প্রচলিত কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না। যে ভৌগলিক পরিসীমায় দেশ বিভাজন হয়েছে, তাঁর কোনো দরকার হবে না, আধুনিক রাষ্ট্রের ভিসা ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন হবে না। ধর্মের যে গঠনগত ইমারত বা কাঠামোগত নির্মাণ উপাসানালয় বা প্রার্থনালয় সেটিও প্রয়োজন পরবে না। এমনকি অর্থনীতির যে নিয়ম বা আইন বা তত্ত্ব যার মাধ্যমে মানুষের সুষম বণ্টনের কথা মার্কস, এঙ্গেলস বা আরও অনেক সাম্যবাদী অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সেটিও জরুরি নয়। মানুষকে উদার হতে হবে, মানুষকে মানবিক হতে হবে ন্যাপরায়ন হতে হবে এবং এই ক্ষুদ্র স্বার্থ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সাপ্রদায়িকতা, খণ্ডিত মানসিকতা এবং ধর্মের গোঁড়ামির ঊর্ধ্ব উঠতে হবে। সেখানে একই ধর্মের মাঝে আবার অনেকগুলো বিভাজন রয়েছে। সেই ভাগগুলো কোনো ধর্মেই প্রত্যাশিত নয়।

একইভাবে ধর্মের বিভাজন সামগ্রিকভাবে সমাজের একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। একইভাবে সমস্ত বিশ্ব মানব সমাজের মাঝে ধর্মীয় বিভাজনের সংকটের অবসান খুবই জরুরি বলে নজরুল মনে করতেন। তাই তিনি এই সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত সংকট অবসানের লক্ষ্যে তাঁর এই মানবিক সাম্যের কথা এত

তেজদ্বীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন। নজরুল প্রকৃত সাম্যবাদী কবি ছিলেন। তাঁর জন্মদিনে সাম্যের তরে নিবেদিত বিশ্বের সকল মানুষের পক্ষ হতে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
লেখক: সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।  

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক