দুর্নীতি যত বাড়বে অর্থ পাচার তত বাড়বে: ড. মনসুর 

সংগৃহীত ছবি

দুর্নীতি যত বাড়বে অর্থ পাচার তত বাড়বে: ড. মনসুর 

অনলাইন ডেস্ক

বাজেটের আকার বড় না হলেও অর্থায়নটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, পারুক বা না পারুক অন্তত রাজস্ব খাতে সংস্কারের একটা প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। সেই সঙ্গে আর্থিক খাতের রিফর্মও জরুরি। দাতা সংস্থা এবং বিনিয়োগকারীরা জানুক কীভাবে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর অর্থ পাচার ঠেকানো কঠিন। কারণ রাজনৈতিক সদিচ্ছা যথেষ্ট পরিমাণে নেই। দুর্নীতি যত বাড়বে অর্থ পাচারও তত বাড়বে।
সার্বিক বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট সমাধান দরকার। ’

একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এ বছর বাজেটের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। একদিকে রাজস্ব আদায় কম। অন্যদিকে নানা কারণে ব্যয়ের চাপও বাড়বে। কাঠামোগত সমস্যার পাশাপাশি আছে রাজনৈতিক সমস্যা। গত ১৫-২০ বছর কোনো সংস্কার হয়নি। এতে রাজস্ব আদায় ক্রমান্বয়ে নিম্নমুখী। এ বছরও বিশাল ঘাটতি হতে যাচ্ছে। কোনো অবস্থায় তা ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার কম হবে না। অন্যদিকে ব্যয়ের দিকেও শুধু সুদ পরিশোধ করতে হবে, প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া ভর্তুকি ও প্রণোদনা এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার মতো পরিশোধ করতে হবে। প্রশাসনিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ও ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর বাইরে উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয়সহ আরও অনেক ব্যয়ের খাত রয়েছে। সেগুলো বাস্তবায়নে ধার করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ বছর বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রচুর টাকা ছাপানো হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। ফলে আগামী বাজেটে অর্থায়ন একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তবে আশা করব, সরকার যেন টাকা না ছাপিয়ে অন্যান্য উৎস থেকে এই ঘাটতি মেটানোর ব্যবস্থা করে। ’

টাকা পাচার বাড়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই টাকা পাচার বাড়বে। দেশে দুর্নীতি যত বাড়বে, টাকা পাচারও তত বাড়বে। কারণ দুর্নীতির টাকা কেউ দেশে রাখতে চায় না। সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশে সব দেশেই টাকা পাচার বেড়ে যায়। আমাদের সামনে জাতীয় নির্বাচন। যার সঙ্গে বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিবেশে টাকা পাচার ঠেকানো কঠিন হবে। এই সমস্যার ত্বরিত সমাধান সম্ভব নয়। মৌলিক সংস্কার দরকার। দুর্নীতি বন্ধ করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ’

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রান্তিক মানুষের দুর্ভোগ কমানো বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি দৃশ্যমান। এর বড় কারণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তবে এটাও ঠিক শুধু বহির্বিশ্বে সরবরাহ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়েনি। যুদ্ধের সময় জ্বালানি তেলের দাম যা বেড়েছিল তা আবার আগের অবস্থায় বা তার চেয়েও নিচে চলে এসেছে। চাল, গম ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছিল তাও কমে গেছে। ডলারে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থার কাছাকাছি বা তার চেয়েও নিচে নেমে এসেছে। গড়ে সবকিছুর দাম যুদ্ধের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। ভারতে মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ থেকে কমে ৫ শতাংশে নেমে আসছে। প্রায় সব দেশের মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে কমছে না। কারণ আমাদের কোনো উদ্যোগ নেই। সব দেশ সুদের হার বাড়ালেও এখানে বাড়ানো হয়নি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আগামী দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৩ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু আমাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এটা আমাদের পলিসিগত দুর্বলতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হয়তো আরও ৫-১০ বছর চলতে পারে। যুদ্ধ চললেও বিশ্ব বসে নেই। তারা তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে নিয়েছে। আমাদেরও নিজেদের সমস্যার সমাধান খুঁজে নিতে হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধকে দোষারোপ করে পার পাব না। ’

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে ড. মনসুর  বলেন, ‘বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে সংকট, এটা শুরু হয় ১৫ থেকে ১৮ মাস আগে। এটাকে এখনো স্থিতিশীল করা যায়নি। যে কারণে মূল্যস্ফীতি অনেকদিন ধরেই উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। রিজার্ভ ১৫ থেকে ১৮ মাস ধরে কমছে। একই কারণে টাকার মূল্যমানে অস্থিরতা। কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ইন্টারব্যাংক মার্কেটের একটি পার্থক্যও বিরাজমান। খুব একটা কমছে না। এর সঙ্গে যোগ হয় ব্যাংকিংয়ের কিছু সমস্যা। এখানে তারল্য সংকট চলছে। ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি অর্ধেকেরও বেশি কমেছে। বর্তমানে সাড়ে ছয় বা সাত শতাংশের মতো আছে। গত ২০-৩০ বছরে আমানতের এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি। আস্থাহীনতা বা যে কারণেই হোক ব্যাংক খাত থেকে উধাও হয়ে গেছে আমানতকারীরা। যদিও এখন ফিরতে শুরু করেছে। ’

রপ্তানি আয়ের নিম্নমুখী ধারা নিয়ে তিনি বলেন, ‘ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপকভাবে চাহিদার পতন হয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি কমে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দা একটি কারণ আর তাদের অনেক অবিক্রীত পণ্য রয়ে গেছে। অবিক্রীত পণ্য বেশি থাকলে অর্ডার করা কমিয়ে দেবে, সেটাই এখন চলছে। তবে চীন ও ভিয়েতনামে যতখানি কমেছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি কম কমেছে। প্রতিযোগী রাষ্ট্রের চেয়ে ভালো করেছি। কিন্তু বাজারটাই খারাপ। খারাপের মধ্যেও ভালো করেছি। আমি মনে করি, পোশাক খাতে প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশ সুদৃঢ় অবস্থানে আছে এবং বিশ্বে চাহিদা বাড়লেই আমাদের রপ্তানি বাড়বে। ’

রেমিট্যান্স না বাড়ার কারণ জানতে চাইলে ড. মনসুর বলেন, ‘গত বছর ১১ লাখেরও অধিক বাংলাদেশি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে গেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মানুষ সবচেয়ে বেশি যাচ্ছেন, সেসব দেশের অর্থনীতিও ভালো এবং বেতনও ভালো পাচ্ছেন। কিন্তু টাকা আসছে না। টাকা আসার অঙ্ক কমে গেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ বেশি যেতে পারে না। সেখান থেকে ডলার আসার অঙ্ক অনেক বেড়েছে। এর ফলে দেশটি প্রবাসী আয় পাঠানোর তালিকায় এক নম্বরে চলে আসছে। হুন্ডির প্রভাব আমেরিকাতে নেই। ওখানে সবাই ব্যাংকের সঙ্গে পরিচিত। ঘরে বসেই ব্যাংকিং অ্যাপ দিয়ে দেশে টাকা পাঠায়। সেখানে কোনো দালালশ্রেণিও নেই। কিন্তু সৌদি আরব ও দুবাইসহ অন্য অনেক দেশে হুন্ডিওয়ালারা আধিপত্য বিস্তার করেছে। তারা খুব সহজেই ওখানকার মুদ্রা ডলারে কনভার্ট করে যে কোনো দেশে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই এভাবে টাকা সরাচ্ছেন। ডলারের বিপরীতে দেওয়া টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রমিকদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আর ডলার যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশে চলে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের মাটিও স্পর্শ করছে না। বাংলাদেশ সমপরিমাণ রিজার্ভ হারাচ্ছে। এটাকে ঠেকানো খুব কঠিন। এটার মূলে আছে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা। এখানে সম্পদ অবৈধভাবে অর্জিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ অবৈধভাবে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার মাধ্যমে দুর্নীতিকে কমিয়ে আনতে না পারলে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয়। ’

news24bd.tv/আইএএম