গাজীপুর সিটি নির্বাচন: লাভ ক্ষতির হিসাব-নিকাশ

সংগৃহীত ছবি

গাজীপুর সিটি নির্বাচন: লাভ ক্ষতির হিসাব-নিকাশ

মো. ইস্রাফিল আলম 

বহুকাল মনে রাখার মতো একটা নির্বাচন হয়ে গেলো গাজীপুর সিটি করপোরেশনে। অনেক দিক বিবেচনায় এই নির্বাচন অত্যাধিক তাৎপর্যপূর্ণ। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন সিটি করপোরেশনটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।

ইতোপূর্ব তিনি কখনো রাজনীতিতে সক্রিয়ও ছিলেন না; অথচ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আজমত উল্লাহ খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির মধ্যে এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে নির্বাচন কমিশনসহ উভয় পক্ষ দাবি করেছে। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ না নিলেও জাহাঙ্গীরের মায়ের বিজয়ে পরোক্ষভাবে মূল লাভটা যে তাদেরই হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেয়র পদ থেকে প্রত্যাহার, দল থেকে বহিষ্কার, নেতাকর্মীদের ওপর হামলা আর দুদকের চাপে দীর্ঘদিন ধরে কোণঠাসা জাহাঙ্গীরও যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধোঁয়া তুলে আওয়ামী লীগ কিছুটা সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করলেও কপালে যে একটা চিন্তার ভাজ তৈরি হয়েছে—এটা যে কেউ অনুধাবন করবেন। এই নির্বাচনে কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো—সেই হিসাব-নিকাশে আসা যাক।

জাহাঙ্গীরের কী লাভ হলো?

নির্বাচনে জয় লাভের পর এক সাংবাদ সম্মেলনে জায়েদা খাতুন এই নির্বাচনকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মানুষকে উৎসর্গ করেছেন। এ ক্ষেত্রে যারা তাকে ভোট দিয়ে মেয়র বানিয়েছেন, মূল বিজয়ী আসলে তারাই। ওই সংবাদ সম্মেলনে জায়েদা খাতুন আরও বলেন, ছেলের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে—সেগুলোর জবাব দিতেই তিনি মূলত নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। নানা দিক বিবেচনায় বড় জয়টা আসলে জাহাঙ্গীরেরই হয়েছে।  

সর্বশেষ গাজীপুর সিটির মেয়র ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর একটি ভিডিও ক্লিপ ভাইরালের সূত্র ধরে জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। দল থেকে বহিষ্কারের ৭ দিন পর ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ভিডিওতে তাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করতে এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে দেখা যায়। জাহাঙ্গীরের আবেদনে গত ২১ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দল তাঁকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়। এরপর তার ‌‘দুর্নীতি ও অপকর্মের’ বিষয়গুলো আবারও সামনে আনা হয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে মায়ের পক্ষে অবস্থান নিলে তাকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। মায়ের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার সময় দুদকের পক্ষ থেকে তাঁকে কয়েকবার তলব করা হয়। নির্বাচনী প্রচারণাকালে তাঁর গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েন জাহাঙ্গীর। বক্তব্যকালে প্রকাশ্যে কাঁদতেও দেখা যায় জাহাঙ্গীরকে। নির্বাচনে জয়লাভের পর স্বস্তি পেলেন জাহাঙ্গীর। দলীয় নেতাদের বিরাগভাজন হলেও জনগণের মধ্যে যে তাঁর বিরাট আস্থা ছিল, জয়লাভের পর সেটার প্রমাণ হয়েছে।

তবে জাহাঙ্গীর ও তাঁর মা জায়েদা খাতুন নির্বাচনে জয় লাভের পর বলেন, এই জয় আওয়ামী লীগের। এই জয় শেখ হাসিনার। এই নির্বাচনে ব্যক্তির পরাজয় হয়েছে। আওয়ামী লীগের জয় হয়েছে।

 কী পেল আওয়ামী লীগ?

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লাহ খান হেরেছেন। আওয়ামী লীগের এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। তারা যে এতে ব্যথিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরাজয়ের ইস্যুটি এড়িয়ে গিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি বারবার সামনে আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি শুক্রবার (২৬ মে) এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘এই সরকারের আমলে যে সুুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব তা গাজীপুরের নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। ’

রাজনীতিতে একেবারে আনকোরা প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মায়ের কাছে আজমত উল্লাহর হেরে যাওয়াটা দলের অনৈক্যতাকেই প্রাধান্যে তুলে আনে। কেননা যে ৪৮ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের ভোটার। তারপরও দল থেকে বহিষ্কৃত নেতার মায়ের কাছে নৌকার প্রার্থীর হেরে যাওয়াটা দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দলের প্রতি আনুগত্যের অভাবের প্রকাশ ঘটায়; যা দলটির জন্য অশনি সংকেত।  

নির্বাচনে না দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষক বিএনপি

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তবে বিএনপি যে একেবারে মাঠে ছিল না সে কথা বলা যায় না। বলা হচ্ছে, জায়েদা খাতুনের জয়ের পেছনে বিএনপির ভোটারদের কিছুটা হলেও অবদান রয়েছে। ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ চানক্যের এই তত্ত্বের আলোকে বিএনপি যে জাহাঙ্গীরের মায়ের পক্ষ নেবে এটাই স্বাভাবিক ছিল। জাহাঙ্গীরকে যেহেতু আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, সেহেতু আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তি মনে করে তারা জাহাঙ্গীরের মাকেই সমর্থন দিয়েছে এবং জায়েদার জয়ে তারা যে মনে মনে খুশি হয়েছে সেটা নির্দিধায় বলা যায়।

বিএনপি এই নির্বাচনে আনন্দ প্রকাশ না করে একটি রাজনৈতিক চাল চেলেছে। তারা বলছে, লোক দেখাতে সরকার একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়েছে। সরকার যেকোনো সময় আবার উল্টো পথে হাঁটতে পারে। নির্বাচনের পরদিন শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘গাজীপুর সিটিতে সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখানোর চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টার ফল আমরা দেখে ফেলেছি। এটা বাংলাদেশের আসল চিত্র। ’ তিনি বলেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং গণতান্ত্রিক অর্ডার ছাড়া যে সব ব্যক্তি নির্বাচনকে আলোচনায় আনতে চাচ্ছে, তারা এই সরকারের পক্ষে কাজ করছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। তারপরে নির্বাচনের আলোচনা আসবে। অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যতীত এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। ’

অর্থাৎ বিএনপি এই নির্বাচনে মনে মনে খুশি হলেও তা প্রকাশ করছে না। তাদের একটাই দাবি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না।

নির্বাচনে মার্কিন ভিসা নীতির কী প্রভাব?

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ঠিক আগের দিন ‘বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেওয়া হবে না’- এ রকম ভিসা নীতি ঘোষণা করে দেশটি। এদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করতে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দেন জাহাঙ্গীরের মা জায়েদা খাতুন। একজন প্রার্থীর এ রকম চিঠির পর ভিসা নীতির বিষয়টি সামনে আনে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও বিবৃতিতে তারা জানায়, গত ৩ মে এই বিষয়টি সরকারকে অবহিত করেছিল তারা।  

এই নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি, তাছাড়া গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত; সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগ ধরেই নিয়েছিল বহিষ্কৃত প্রার্থীর মাকে পরাজিত করা কঠিন হবে না। আওয়ামী লীগের ধারণা ছিল নির্বাচন যেভাবেই হোক না কেন আজমত উল্লাহ জিতবে। শেষ পর্যন্ত সমর্থক ভোটাররা ভোট না দেওয়ায় সেই আশায় ‘গুড়ে বালি’ হয়েছে আওয়ামী লীগের।

সুতরাং বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিই যে সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক হয়েছে এমনটি নয়; বরং দলীয় প্রার্থী জিতবে বলে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, সেটিই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আওয়ামী লীগের।     

এদিকে রোববার (২৮ মে) নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমেরিকার ভিসা নীতির সাথে গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার কোনো সম্পর্ক নেই। গাজীপুর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ-বিদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। ’

নির্বাচন কমিশনে আস্থা তৈরি

২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন এবং তারপর বহু স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। এসব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ আছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে জনগণ। ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হয়ে নির্বাচন কমিশন কাজ করেছে বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তাই বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সামনে। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সে ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। সবাই স্বীকার করেছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়, আগামী ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোট হবে। সেই নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, সে চ্যালেঞ্জ রয়েছে ইসির সামনে।  

 তবুও আশার আলো

একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল একটা শ্রেণির জন্য তাৎক্ষণিক সুবিধা এনে দিলেও তা দেশের অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করে। যার ভুক্তভোগী হয় জনগণ। তাই গাজীপুর সিটির সুষ্ঠু নির্বাচন জনগণের মধ্যে একটা আশার সঞ্চার করেছে; তারা আবার ভোটের মাঠে যাবে, ভোট দেবে, জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করবে—এমন আশার সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে। দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে জাতীয় ও স্থানীয় সকল নির্বাচন গাজীপুর সিটির মতো অবাধ ও সুষ্ঠু হোক— এমনটাই প্রত্যাশা করে জনগণ।

লেখাটি লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত