পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাগনিকে খুন, গ্রেপ্তার ৪

হত্যার ৫ বছর পর রহস্য উদঘাটন

পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাগনিকে খুন, গ্রেপ্তার ৪

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:

মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে অন্তঃসত্ত্বা ভাগনিকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ৫ বছর ক্লুলেস হত্যাকাণ্ডটির রহস্য উন্মোচন করেছেন সিরাজগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই)। একই সাথে খুনের সাথে সম্পৃক্ত চার ঘাতককে গ্রেপ্তার করেছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্তঃসত্ত্বা নারী বিউটি খাতুন সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রামের সাচ্চু মিয়ার মেয়ে।

 

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো-এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রামের মৃত আমির হোসেনের ছেলে স্বপন ব্যাপারী (৩৭), মৃত জসিম উদ্দিনের ছেলে মমিন (৫৫), মমিনের স্ত্রী আনু বেগম (৪০) ও ঢাকায় আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুক (২৮)। সোমবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) এর পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।  

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ১৩ মে রাতে বিউটি খাতুন তার নিজ ঘরে ঘুমিয়ে পরে। রাতে বিউটির মা কোমেলা খাতুন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দেখেন তার মেয়ের ঘরের দরজা খোলা।

সে সময় বিউটিকে নাম ধরে ডাকলে বিউটি কোন সাড়া-শব্দ পায় না। পরে চিৎকার দিলে বিউটির পরিবারের সদস্যরা ঘরের আলো জ্বালিয়ে বিউটিকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করে। এ ঘটনায় সাচ্চু মিয়া বাদী হয়ে ২০১৮ সালের ১৪ মে এনায়েতপুর থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করে।  

মামলাটি তদন্তে থাকাবস্থায় প্রায় ২ বছর পরে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা মামলাটি পিবিআইকে তদন্ত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। দীর্ঘদিন তদন্তের এক পর্যায়ে গত ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ওমর ফারুককে (২৮) গ্রেফতার করা হয়। ফারকের দেওয়া তথ্যমতে ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় চলতি বছরের ২৩ ও ২৫ মে রাতে সন্দেহমূলক ৩ জনকে আটক করে। পরে গ্রেপ্তারকৃতরা হত্যার সাথে জড়িত থাকায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।

জবানবন্দিতে আসামিরা উল্লেখ করেছেন, ২০১৪ সালে এনায়েতপুরের কোচগাঁও গ্রামের আব্দুল্লাহের সাথে বিউটি খাতুনের বিয়ে হয়। বিয়ের ৩ বছর পরে স্বামীর সঙ্গে তালাক হয়। বিউটি বাবার বাড়িতে থাকাবস্থায় প্রতিবেশী ওমর ফারুকের সঙ্গে মোবাইলে কথা হতো। এক পর্যায়ে ফারুক বিয়ের প্রস্তাব দিলে বিউটি না করে। একই সময়ের মধ্যে বিউটির আরেক ছোট বোন আলোমতির স্বামীর পরিবারের সাথে ঝামেলা হয়। পরে বিউটির বাবা সাচ্চু মিয়া তাদের পার্শ্ববর্তী খোকশাবাড়ী গ্রামের স্বপন ব্যাপারীকে বিষয়টি সমাধান করার জন্য অনুরোধ করে। স্বপনের মাধ্যমে বিউটির ছোট বোন আলোমতির স্বামীর বাড়ির সমস্যার সমাধান হওয়ায় বিউটির পরিবারের সাথে স্বপনের সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। বিউটির ছোট খালা আন্না মাদক ব্যবসা করায় সে বিউটির মোবাইল দিয়ে স্বপনের সাথে মাঝে মধ্যে কথা বলত। অপর দিকে স্বপন মাদক সেবী হওয়ায় মাঝে মধ্যে স্বপন আন্নার বাড়ীতে যাওয়া আসা করত এবং মাদক সেবন করত। সেই সুবাদে বিউটির সাথেও স্বপনের দেখা সাক্ষাত হত এবং মোবাইলে কথাবার্তা হত। এমতাবস্থায় বিউটির পিতা অর্থাৎ বাদী সাচ্চু মিয়া স্বপনকে বলেন তার প্রতিবেশী ওমর ফারুক বিউটিকে ডিসটার্ব করে তাকে একটু শাসন করে দিতে হবে।  

স্বপন এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় সে ওমর ফারুককে শাসন করে। এতে সম্পর্ক আরো ভাল হয়। এক পর্যায়ে স্বপন, বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করত। কিন্তু স্বপন সরাসরি বিউটিকে প্রস্তাব দিতে না পেরে আন্নাকে জানায়। পরবর্তীতে স্বপন আন্নার মাধ্যমে বিউটির সাথে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। বিউটির ছোট খালা আন্নার মাধ্যমে আন্নার বাড়িতে স্বপন নিয়মিত বিউটির সাথে দেখা-সাক্ষাত করত। বিউটির সাথে স্বপনের অনুমান ২ মাস সম্পর্ক চলার পরে বিউটিকে বিয়ে করার জন্য স্বপনকে চাপ দেয়। স্বপন বিবাহিত হওয়ায় বিউটিকে বিয়ে করতে রাজি না হলে বিউটি স্বপনকে জানায় বিউটি অন্তঃসত্ত্বা। পরবর্তীতে বিউটি স্বপনের উপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করলে স্বপন কি করবে তা ভেবে না পেয়ে ঘটনার ১০/১২ দিন আগে প্রতিবেশী ওমর ফারুককে ডেকে বিষয়টি বিউটিকে হত্যা করা নিয়ে আলোচনা করে।  

কিন্তু ওমর ফারুক রাজি না হলে স্বপন ওমর ফারুককে ভয়- ভীতি দেখায়। স্বপন বিউটির সাথে ওমর ফারুকের পূর্বেও সম্পর্কের বিষয় নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে হত্যার পরিকল্পনায় সাথে নেয়। পরে স্বপন বিউটির ছোট খালা আন্নার কাছে বিউটিকে হত্যা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আন্না তার নিজের ভাগনিকে হত্যা করতে রাজী না হলে স্বপন তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজী করায়। পরে ৫০ হাজার টাকা আন্নাকে দিতে চায়। তাৎক্ষনিক স্বপন ২০ হাজার ওমর ফারুক ৩০ হাজার টাকা দেয় আন্নাকে। তখন বিউটির ছোট খালা তার আপন মেজো বোন আনু বেগমকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বিউটিকে হত্যা করতে সহায়তা করতে বলে। আনু বেগম তার স্বামী মোমিন এর সাথে কথা বলে তাকে রাজি করায়। তাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক গত ১৩ মে ২০১৮ সালে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে বিউটিদের বাড়ির পাশে সবাই একত্র হয়। পরে স্বপন, ওমর ফারুক, আনু, আন্না ও মোমিন বিউটির ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থা বিউটিকে হাত-পা ও মাথা চেপে ধরে মুখে বালিশ চাঁপা দিয়ে হত্যা করে কৌশলে পালিয়ে যায় তারা।