ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সৌদি ফেরত ১২ নারী

ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সৌদি ফেরত ১২ নারী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সৌদি আরব থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে এসেছেন ১২ নারী কর্মী। গণমাধ্যমের সামনে পড়তেই তাদের মুখে দেখা গেছে আতঙ্কের ছাপ। জানালেন সেদেশ থাকাকালীন ভয়াবহ নির্যাতনের কথা।

শনিবার (৩ জুন) বিকালে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন (এপিবিএন) এর সহায়তায় দেশে ফেরেন তারা।

দেশে ফিরে তারা জানালেন, বুকে, পেটে লাথি মারতো এলোপাথাড়ি। লোহার রড দিয়ে মারতো। কখনও চাবুক দিয়ে মারতো গৃহকর্তারা।

এদিন বিমানবন্দরে পৌঁছালে এপিবিএন তাদেরকে বিমানবন্দরে রিসিভ করে তাদের নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে।

পরবর্তী সময়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের খাবার ও বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। তারা সৌদি গিয়েছিলেন— এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মক্কা ইন্টারন্যাশনাল, হিমেল এয়ার সার্ভিস নামে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে।

নির্যাতিত এমন একজন জানান, গত ৯ মার্চ সৌদি যান তিনি। হিমেল এয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে তাকে সৌদি পাঠায় দালাল তারেক মিয়া। ভাগ্য বদলাতে সৌদি গেলেও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তিনি বলেন, 'কথায় কথায় মারতো আমাকে। মক্তবে আমার মতো আরও অনেক নারী ছিল। সবাইকেই মারতো। এলোপাথাড়ি বুকে, পেটে লাথি মারতো। লোহার রড দিয়ে মারতো। কখনও চাবুক দিয়ে মারতো। কোনো কথা শুনতো না, বরং কিছু বললে আরও বেশি মারতো। এতো মারতো, মাঝে মাঝে মনে হতো মরে যাই। '

ভুক্তভোগী আরও বলেন, 'আমি দেশে আমার বাবাকে বলছি আমাকে ফেরত নিয়ে যেতে। বাবা দালালের সাথে যোগাযোগ করলে তারা টাকা দাবি করে। পরে আমার বাবা দালালকে টাকা দিছে। '

নির্যাতনের শিকার আরেক ভুক্তভোগী জানালেন, তাকে লড়াই করতে হয়েছে নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য। প্রতিনিয়ত তাকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করা হতো। দালাল বাবলু তাকে সৌদি পাঠায় এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশলানের মাধ্যমে। সৌদি যাওয়ার পর তার মোবাইল নিয়ে যায়। পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি। মক্তব থেকে এক এক সময় এক এক বাসায় কাজে পাঠাতো। মক্তবে থাকলেই মারতো। দিনে ২ বার কোনও রকমে খাবার দিতো। একটা বাচ্চা শিশু যে পরিমাণ খাবার খায়, তাও দিতো না। সন্ধ্যায় মক্তবে এসে আমার সবাইকে মারতো। রড দিয়ে পিটাতো। ব্যথায় পড়ে গেলে লাথি মারতো। গায়ের ওপর উঠে দাঁড়াতো।

চাবুকের আঘাতে ক্ষত হয়েছে গেছে একজনের শরীর। তিনিও এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যে বাসায় কাজ করতাম, তাদের একটা বাচ্চা ছিল। কোনো কারণে বাচ্চা কান্না করলে আমাকে মারতো। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে মারতো। বোতল দিয়ে আমাকে আঘাত করতো। চাবুক দিয়ে পেটাতো।

ভুক্তভোগী আরেক নারী বলেন, শ্রমিক ভিসায় সৌদি গিয়েছিলেন ১ এপ্রিল। শ্রমিক ভিসায় বিদেশ যেতে বিএমইটি কার্ড থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার ছিল না। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কনট্রাক্ট করে তাকে সৌদি পাঠায় দালাল ফজলু। তিনি বলেন, আমি সৌদি যাবার কিছু দিন পরেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমাকে একদিন হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে হাসপাতাল থেকে ফেরত আনা হয়।

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, মে মাসে একজন নারী ভুক্তভোগীর স্বামী বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কাছে অভিযোগ জানান যে তার স্ত্রী ৬ মাস আগে এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজ করতে সৌদি আরব গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর থেকে তিনি তার স্ত্রীর সাথে কোনভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। লোকমুখে তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রী শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তিনি তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এপিবিএনের সহযোগিতা চান। একই সাথে যে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে সৌদিতে গিয়েছেন সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান। এরপর এয়ারপোর্ট এপিবিএনের গোয়েন্দা দল বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে।

জিয়াউল হক আরও বলেন, এ সময় অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস বন্ধ করে রাখে। গা ঢাকা দেন সেখানে কাজ করা কর্মচারীরা। তারা মনে করেছে ভুক্তভোগী নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনলে হয়তো তারা আইনগত জটিলতার বিষয়টি থেকে মুক্তি পাবেন। যার কারণে ট্রাভেল এজেন্সি সৌদি থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়া ১২ নারী ভুক্তভোগীকে ফেরত নিয়ে এসেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই ১২ জন জানান যে তারা প্রত্যেকেই বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাভেল এজেন্সিসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

news24bd.tv/FA

এই রকম আরও টপিক