রাজনীতির রহস্যপুরুষ কে এই সিরাজুল আলম খান?

সংগৃহীত ছবি

রাজনীতির রহস্যপুরুষ কে এই সিরাজুল আলম খান?

অনলাইন প্রতিবেদক

১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন রাজনীতির রহস্যপুরুষ খ্যাত সিরাজুল আলম খান। তার ডাক নাম ছিল দাদাভাই। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাবেক ছাত্রনেতা, খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। ১৯৬১–১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

এরপর ১৯৬১ সাল থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জাসদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

সিরাজুল আলম খান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। এছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন এবং ‘৭ নভেম্বর ১৯৭৫’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতিতে সিরাজুল আলম ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

জন্ম ও শিক্ষা
সিরাজুল আলম খানের বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। স্থানীয় স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে চলে যান বাবার কর্মস্থল খুলনায়। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। থাকতেন ঢাবির ফজলুল হক হলে। গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে। প্রতিদিন রাত করে হলে ফিরতেন তিনি। ফলে হল থেকেও একবার বহিষ্কৃত হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় তার পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি নেয়া সম্ভব হয়নি।

সিরাজুল আলম খান ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে, তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। ছয় দফার সমর্থনে জনমত গঠনেও ভূমিকা পালন করেন তিনি।  

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করতে ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসলে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। ফলে তার সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে তিনি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন।  

১৯৬৩-’৬৪ এবং ১৯৬৪-’৬৫ এই দুই বছর তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালের গঠিত নিউক্লিয়াস স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামেও পরিচিত ছিল। এটি গঠনের উদ্যোগে তাঁর প্রধান সহকর্মী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৬২-’৭১ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ১১-দফা আন্দোলন পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে এই ‘নিউক্লিয়াস’। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গড়ে তোলা হয় ‘নিউক্লিয়াসে’র রাজনৈতিক উইং বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) এবং সামরিক ইউনিট জয় বাংলা বাহিনী। ১৯৭০-’৭১ সন নাগাদ  বিএলএফ এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজারে।  

জাসদ প্রতিষ্ঠা
১৯৭১ সনে স্বাধীনতার পর আন্দোলন-সংগ্রামের রূপ ও চরিত্র বদলে যায়। গড়ে ওঠে একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭৫ সনের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত 'অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে এক ঘটনা। জাসদ গঠন এবং ‘অভ্যুত্থান’ এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আর এই দুটি বৃহৎ ঘটনার নায়ক ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের।

কারাভোগ
সিরাজুল আলম খান ভিন্ন ভিন্ন তিন মেয়াদে প্রায় ৭ বছর কারাভোগ করেন। কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষদিকে গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৬ সালে জিয়ার আমলে আবার গ্রেপ্তার এবং ১৯৭৯ সালে মুক্তি পান। ১৯৯২ সালে বিদেশ যাবার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২৪ মার্চ সিরাজুল আলম খানকে গ্রেপ্তার করা হলে ৪ মাস পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পান।

শিক্ষা ও গবেষণা
সিরাজুল আলম খানের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অঙ্ক শাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেল জীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে উঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে।  

এক নতুন অধ্যায়
আর্থ-সামাজিক বিশেষনে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসাবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। চিরাচরিত পার্লামেন্টারি ধাঁচের অঞ্চল ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শ্রম, কর্ম, পেশায় নিয়োজিত সমাজ শক্তি সমূহের ‘বিষয় ভিত্তিক’ প্রতিনিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট গঠন, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন, বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন এবং প্রাদেশিক সরকার গঠন, উপজেলা পর্যায়ে স্ব-শাসিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালুর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আইন ব্যবস্থা ও শাসন কাঠামোর পরিবর্তে স্বাধীন দেশের উপযোগী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার মডেল উত্থাপন করেন তিনি।  

সূত্র : উইকিপিডিয়া

এই রকম আরও টপিক