প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু চালুর এক বছর

সংগৃহীত ছবি

প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতু চালুর এক বছর

অনলাইন ডেস্ক

২০২২ সালের ২৫ জুন এক জমকালো অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় পদ্মা সেতু। পরদিন সেতুর ওপর দিয়ে শুরু হয় যানবাহন চলাচল। পদ্মা সেতু চালুর পর গত এক বছরে যোগাযোগ, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ফলে বদলে গেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ।  

দুই যুগ আগে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও নানা প্রতিবন্ধকতা শেষে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতুটি।

গত এক বছরে পদ্মা সেতুতে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার বেশি। সেতু বিভাগ জানায়, ২০২২ সালের ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া পদ্মা সেতুতে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ৬০৩ কোটি টাকা টোল আদায় হয়েছে। এর পরের (এপ্রিল-মে ও জুনের প্রথম ২০ দিন) তিন মাসে টোল আদায়ের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে টোল আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকার কিছুটা বেশি।

অপরদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে, পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত চার কিস্তিতে মোট ঋণের ৬৩২ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, সেতু কর্তৃপক্ষ আলাদাভাবে ঋণের প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির মোট ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ৯৭ হাজার টাকা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি টাকার চেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়েছে। প্রথম দফায় দুই কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হয়েছে চলতি বছরের ৫ এপ্রিল। তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থের চেক হস্তান্তর করা হয়েছে গত ১৯ জুন। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ বিভাগ থেকে নেওয়া ঋণের মোট চার কিস্তির অর্থ পরিশোধ করেছে সেতু বিভাগ।

ফেরি সংকটে অথবা আবহাওয়াজনিত জটিলতা, অথবা যানজটে পড়ে পদ্মা নদী পার হতে না পেরে তরমুজ বোঝাই শতাধিক গাড়ি আটকে পড়ার কাহিনী কারও অজানা নয়। শুধু তরমুজই নয়, মাদারীপুর থেকে আনা কলাই শাক, শরীয়তপুর থেকে আনা নানা ধরনের সবজি, ফরিদপুর থেকে আনা খেজুরের রস, বরিশাল ও  পটুয়াখালী থেকে আনা তরমুজ, বাঙ্গি, আমড়া ও মুরগির ডিমবাহী ট্রাকও পদ্মার পাড়ে আটকে থাকতো, ঘণ্টা পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। ফলে এসব পচনশীল পণ্য গরমে নষ্ট হয়ে যেতো। যা ফেলে দিতে বাধ্য হতেন ব্যবসায়ীরা। আবার কেউ কেউ এসব পণ্য কম দামে বিক্রি করে দিয়ে লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে বাড়ি ফিরতেন খালি হাতে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এমন পরিস্থিতির অবসান হয়েছে বলে স্বস্তিতে আছেন পদ্মার ওপারের কৃষিজীবী মানুষের।

তারা জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আগে সেই অবস্থা আর নেই। ওপারের ২১ জেলার কৃষিতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বাড়ছে চাষাবাদ। বাড়ছে কৃষিনির্ভর খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন। জমির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হচ্ছে সেসব কৃষিপণ্যের চাষাবাদ। উৎপাদিত কৃষিপণ্য বাজারজাত সহজ হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ক্রেতাও মিলছে আগের তুলনায় বেশি। চুক্তি ভঙ্গ হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তনে সাফল্য দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

নানা কারণে এখনও বহুল প্রত্যাশিত এই সেতুর পুরোপুরি সুবিধা মিলছে না। পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, পদ্মা সেতুকে ঘিরে এক্সপ্রেসওয়ে বা অ্যাপ্রোস রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় এটা একটা চমৎকার উন্নয়ন। কিন্তু এটি এখনো অপূর্ণ। আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে সাপোর্ট দেওয়া। দেশের অর্থনীতিতে ১.২৫ শতাংশের মতো জিডিপি বাড়ানোর জন্য এই সেতু করা হয়েছে। শুধু একটা ব্রিজ দিয়ে সেটা করা যাবে না। এর সাথে দরকার সামগ্রিক রোড নেটওয়ার্ক। সেটা কিন্তু এখনো তৈরি হয়নি। এটি সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়।

‌‌‘সেতুর কারণে গত এক বছরে ওই এলাকায় ছোট গাড়ি চলাচল বেড়েছে। মোটরসাইকেল কিংবা ব্যক্তিগত পরিবহনে ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণের জন্য বিরাট সুন্দর একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বড় মাপের এই সড়কে ছোট ছোট যান চলাচল করছে। এতে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব কমে যাচ্ছে,’ যোগ করেন তিনি।

শামসুল হকের মতে, সড়কে ব্যক্তি খুশি আর অর্থনীতি খুশি এক নয়। অর্থনৈতিক খুশির জন্য এখানে গণপরিবহন, ট্রাক এ ধরনের যানবাহনের দ্রুতগতিতা খুব দরকার। কারণ ছোট ছোট গাড়ি, মোটরসাইকেলের টোল সংগ্রহ করতে যে সময় লাগে একটা বড় গাড়ির ক্ষেত্রেও সময় লাগে একই। অদূরদর্শিতার কারণে এখন খণ্ডিত, বিখণ্ডিত গণপরিবহন, ব্যক্তিগত যানবাহন এবং মোটরসাইকেল যাওয়ার ফলে এটার 'অপারেটিং কন্ডিশান'টার মানে থাকছে না।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকায় প্রবেশের মুখে প্রায়ই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি সেই যানজট উড়ালসড়ক হয়ে রাজধানীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকসময় দেখা যায় গোপালগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পৌছাতে যে সময় লাগে তার চেয়ে বেশি বা সমান সময় লাগে গুলিস্তান পৌঁছাতে।

এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, এই সেতু হয়ে ঢাকায় প্রবেশের জন্য যে চক্রাকার সড়ক বা রিং রোডগুলো করার কথা ছিল সেটা এখনও প্রস্তুত না হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রিং রোডের মাধ্যমে একমুখী অনেক চাপ দ্রুত চলে আসলে তা ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়। যেমন কেউ উত্তরা যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী দিয়ে ঢুকতে গিয়ে যদি যানজট পান তাহলে বসিলা দিয়ে যেতে পারেন। অথবা আশুলিয়া হয়ে উত্তরা যেতে পারেন। রিং রোড করা হলে ঢাকার মুখে যানজট কমে যাবে। কিন্তু সেটা এখনও না করা বড় ধরনের ভুল।

একইসঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের স্থানীয় সড়কগুলোরও উন্নয়ন দরকার বলে মনে করেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে মাদারীপুর যাওয়ার পর সেখানকার লোকাল কানেকশনগুলোও এই সড়কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। পদ্মা সেতুর কারণে পরিবহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় জীর্ণ, শীর্ণ অনুপযোগী স্থানীয় সড়ক নেটওয়ার্কে চাপ বাড়ছে। এসব সড়কের মানও উন্নত করতে হবে।

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক