আদিলুরের সাথে মালয়েশিয়ায় যা হয়েছে

আদিলুরের সাথে মালয়েশিয়ায় যা হয়েছে

নিউজ ২৪ ডেস্ক:

মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গেলে বিমানবন্দরেই তাকে আটকে দেয়া মালয়েশিয়া। পরে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। বিষয়টি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন।  

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ১৯ জুলাই রাত ১১টায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ওঠেন।

এন্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএন) এর দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যাত্রা করেন। অধিকার এডিপিএএন-এর সদস্য। ২০শে জুলাই মালয়েশিয়ান সময় ভোর ৪টা ৫০ মিনিটে তিনি কুয়ালালামপুর ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে পৌঁছান। এদিন সকালেই ওই বৈঠকটি শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল।

ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার নাম ডাটাবেজে প্রবেশ করানোর পর আদিলুরকে এক টুকরো কাগজ দেন যেখানে বাহামা মালয়েশিয়া ভাষায় দুটো শব্দ লেখা ছিল। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধিরা তাকে জানিয়েছিলেন যে ওই শব্দ দুটির অর্থ ছিল ‘সন্দেহভাজন’। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা তার পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেন এবং নিকটবর্তী একটি কক্ষে এক কর্মকর্তার কাছে যাচাইয়ের জন্য পাসপোর্ট জমা দেয়ার নির্দেশনা দেন।

পাসপোর্ট জমা দেয়া পর আদিলুরকে অপেক্ষা করতে হয়। এ সময় পুলিশ একটি ফোন কল করে এবং নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। আনুমানিকসকালে সাড়ে সাতটার দিকে তাকে অপর একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ কর্মকর্তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়। আদিলুরকে যখন বিমানবন্দরের অপর প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি এডিপিএন-এর একজন সমন্বয়ককে তার ফোন থেকে ইমেইল করতে সক্ষম হন। এক বাক্যে তিনি তাকে জানান যে তাকে বিমানবন্দরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না এবং সম্ভবত তাকে আটক করা হবে। সঙ্গে সঙ্গেই ইমেইলের জবাব পান তিনি। এতে ওই সমন্বয়কের মালয়েশিয়ান সহকর্মীর ফোন নম্বর ছিল।  ওই ব্যক্তি আদিলুরকে জানান যে তিনি অবিলম্বে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনকে বিষয়টি অবহিত করছেন। আদিলুর তাকে সুয়ারাম’কেও (মালয়েশিয়ার স্থানীয় একটি মানবাধিকার সংস্থা) অবহিত করতে বলেন যেহেতু সুয়ারাম অধিকারের মতো একই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সদস্য ছিল।

লক-আপে আদিলুরকে তার জুতা খুলতে বলা হয় এবং সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র আলাদা করে রাখতে বলা হয়। তার সেলফোন ও ল্যাপটপ সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর তাকে বড় একটি কক্ষে আটক করা হয় যে কক্ষটি শুধু ইলেক্ট্রনিক পাসওয়ার্ড দিয়ে খোলা যায়। ওই কক্ষে আনুমানিক ৬০ জন ব্যক্তি ছিল। এদের বেশিরভাগ ছিল বাংলাদেশি। অন্যরা ছিল ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরান থেকে। আফ্রিকা মহাদেশ থেকেও কিছু লোক ছিল।

এক ঘণ্টা পর তাকে লক-আপ থেকে বের করে নেয়া হয় এবং খাবারের জন্য তাকে ৩৫০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা ১০০ মার্কিন ডলার দিতে বলা হয়। আর তাকে দেয়া হয় দুটি বিস্কিট, এক বোতল পানি, একটি টুথব্রাশ, টুথপেস্ট এবং একটি সাবান। এরপর তাকে ফের ওই কক্ষে পাঠানো হয়। ওই লক-আপের একমাত্র টয়লেট ব্যবস্থা ছিল নোংরা এবং কক্ষের আয়তন এতো মানুষের জন্য অপর্যাপ্ত।    

আনুমানিক দুপুরের দিকে, এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আদিলুরকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি এই আটকবস্থা নিয়ে বাইরের কাউকে অবহিত করেছেন কিনা। আদিলুর জানান,  তিনি এক বন্ধুকে জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা এরপর জোরে বলে ওঠেন, ‘কেন আপনি এটা করেছেন?’ কিছুক্ষণ পর আরেকজন কর্মকর্তা আসেন এবং আদিলুরকে জানান যে মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন থেকে তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে জাওয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান যে ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টে তার বস নিশ্চিত হতে চেয়েছেন যে তিনি আদিলুর রহমান খান কি না এবং সেটা হিউম্যান রাইটস কমিশনের কাছে অবহিত করতে বলেছেন। তিনি তার সেলফোনে আদিলুরের একটি ছবি তোলেন।

পরে একজন কর্মকর্তা এসে আদিলুরকে পৃথক আরেকটি কক্ষে নিয়ে যান যেটার আকৃতি আনুমানিক ৬ ফিট বাই ১০ ফিট। সেখানে তাকে এক কাপ চা এবং মধ্যাহ্নভোজ দেয়া হয় যার জন্য তিনি অর্থ দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাকে সেখানে আটক রাখা হয়। এ সময়ে তাকে বড় ও প্রধান আটক কক্ষের টয়লেটটি ব্যবহার করতে হয়। ৬টার সময় তাকে প্রথম যেই কক্ষে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল (বড় আটককক্ষে নেয়ার আগে), সেই কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হিউম্যান রাইটস কমিশনের দু’জন প্রতিনিধিকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেয়া হয়।  

তারা তাকে জানান যে, একজন আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বিমানবন্দরে এসেছেন, কিন্তু তাকে সে অনুমতি দেয়া হয়নি। সকালে মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি দলও এসেছিল। তাদেরও অনুমতি দেয়া হয়নি। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধিদের কাছে আদিলুর যা কিছু ঘটেছে তা জানান এবং প্রথম ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার দেয়া কাগজের টুকরোটি হস্তান্তর করেন। তারা যখন কথা বলছিলেন তখন একজন পুলিশ সদস্য এসে তাদের ছবি তুলে নিয়ে যায়।  

৩০ মিনিট আলোচনার পর তাকে আটক এলাকার অভ্যর্থনার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টায় তাকে বোর্ডিং গেটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ঢাকাগামী মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ১১২ তে উঠিয়ে দেয়া হয়। তার পাসপোর্ট তাকে দেয়ার পরিবর্তে ফ্লাইটের একজন ক্রু মেম্বারের কাছে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকায় পৌঁছান আদিলুর। বাংলাদেশি একজন বিমানবন্দর কর্মকর্তা তাকে ইমিগ্রেশন পুলিশ কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে আনুমানিক ১৫ মিনিট ছিলেন তিনি। তাকে তার পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হয় এবং তিনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাকে আটক করা এবং এরপর ফেরত পাঠানোর প্রকৃত কারণ তিনি এখনও জানেন না। মালয়েশিয়ান ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন বিষয়টি তদন্ত করছে।

কেএলআইএ বন্দিশালায় যারা আটক ছিলেন তাদের কাছে খাবার কেনার অর্থ ছিল না। তারা ট্যাপের পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের মন্তব্যও ছিল ‘নো মানি-নো ফুড’। সেখানে থাকা বাংলাদেশিরা তাকে বলেন যে, তাদের পরিবার জানে না যে তারা কোথায়? আর কর্মকর্তারা ফোন কল করতে দেয়ার বিনিময়ে অর্থ নিচ্ছিল। আটক অনেকে দাবি করেন, তাদের কাছে স্থানীয় মালয়েশিয়ান দূতাবাস কর্তৃক ইস্যুকৃত বৈধ ভিসা রয়েছে; তারপরও তাদের আটক রাখা হয়েছে।