আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বরিশাল-বনানীর হামলা

সংগৃহীত ছবি

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বরিশাল-বনানীর হামলা

অনলাইন ডেস্ক

বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গত ১২ জুন হামলার শিকার হন ইসলামী আন্দোলনের মেয়রপ্রার্থী সৈয়দ ফয়জুল করীম। আর গত সোমবার (১৭ জুলাই) ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে বানানীর একটি কেন্দ্রে হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম। এই দুটি হামলার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন মূল আলোচনায়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে পর পর দুটি ঘটনা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশ্নবোধক পরিস্থিতি তৈরি করছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র সাড়ে ৫ মাস বাকি। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের তাগিদের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের আহ্বান অব্যাহত রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ছয় সদস্যের স্বাধীন অনুসন্ধানী দল। সারা বিশ্বের নজর এখন বাংলাদেশের ওপর।

এরই মধ্যে গত সোমবার অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। ভোট চলাকালেই ঘটে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনা। মারধরের পর পুলিশের সামনেই তাকে ধাওয়া করে এলাকা ছাড়া করেন হামলাকারীরা।

এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানাতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক মহল। এ হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। তীব্র নিন্দা জানিয়েছে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়েও উঠে আসে এ হামলার প্রসঙ্গ। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।  

এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘সহিংসতা ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সবার মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করতে হবে। ’

এ প্রসঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো স্থান নেই। তারা আশা করে, বাংলাদেশ সরকার যে কোনো সংঘর্ষের ঘটনার সুষ্ঠু, পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্তের পাশাপাশি দোষীদের বিচার নিশ্চিত করবে। ’ এ সময় তিনি এ ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। ’

হিরো আলমকে মারধরের ঘটনা ছাড়াও ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে পরিচয় পাওয়ার পরও ভোট কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের করে দিয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার। নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খানকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা গোপন কক্ষ ছাড়া যে কোনো জায়গায় যেতে পারেন। সাংবাদিকদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া অন্যায় হয়েছে। ’

এর আগে গত ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীমের ওপর হামলা চালায় সরকারদলীয় প্রার্থীর সমর্থকরা।

এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন নির্বাচনী সহিংসতা প্রতিরোধ করা না গেলে তা সামনের দিনে আরও বাড়বে, যা জাতীয় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে। তারা রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের আচরণ পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব দেন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বরিশালে সিটি নির্বাচনে প্রার্থী মারধরের ঘটনায় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি হতো না। এ ঘটনায় জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, তাদের বিরুদ্ধেও নির্বাচন কমিশনকে অ্যাকশন নিতে হবে। তা না হলে দেশের নির্বাচনী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। ’

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে বিজয়ী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার মাত্র ২০ মিনিট আগে যা ঘটল, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। যারা মারামারি করল, তারা আর যা-ই হোক নৌকার শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। নির্বাচনকে বিতর্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি দোষীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। ’

এদিকে নির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর এসব হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ভিসা নীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশ সফর করে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। এ সফরকালে তাকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজরা জেয়ার ঢাকা ছাড়ার তিন দিনের মধ্যেই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীর ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটল।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন প্রশ্নে আগে থেকেই তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে দেশটি। এতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে। খোদ রাজধানীতে একটি উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলা এ ভিসা নীতির প্রয়োগে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল এখন ঢাকায় অবস্থান করছে। ঠিক এ সময়ে প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনা তাদের প্রতিবেদনকে প্রভাবিত করতে পারে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ ধরনের সহিংসতা প্রমাণ করে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী পরিস্থিতির কোনো গুণগত পরিবর্তন হয়নি। মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা এত দিন যে ধরনের আচরণ করেছে, এখনো তাই করছে। আর তাদের পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন, এ ব্যাপারে তারা নেতৃত্ব থেকে কোনো নির্দেশনা বা বার্তা পায়নি। ’

সিটি করপোরেশন ও উপনির্বাচনে প্রার্থীদের ওপর হামলাকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন মহলের সরকারবিরোধী প্রচারণা জোরদার হতে পারে বলেও অনেকের আশঙ্কা। তাদের মতে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কিছু রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী বিদেশে নানাভাবে প্রচার চালিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, এ ধরনের তৎপরতা ততই বাড়ছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার এসব উদাহরণ তাদের প্রচারণায় সহায়ক হবে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ মঙ্গলবার বলেছেন, ‘ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে একজন প্রার্থীর ওপর হামলা করা হয়েছে। তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেটি নিয়েও অনেকের কত মাতামাতি। যারা করেছে, তারা দুষ্কৃতকারী। তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এটি করেছে। ’

ভোট গ্রহণের শেষ পর্যায়ে এসে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর ওপর হামলা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। গতকাল মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকেদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভোটের শেষ পযায়ে এমন ঘটনার কী উদ্দেশ্য ছিল, তা পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ’

আইনশৃঙ্খলায় কোনো অবহেলা থাকলে তা খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে জানাতে ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এ কমিশনার।

অন্যদিকে হিরো আলমের ওপর হামলাকে নির্বাচনী আচরণবিধির পরিপন্থি ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। গতকাল মঙ্গলবার কমিশনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো বার্তায় বলা হয়, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নিবিড় তদন্ত হওয়া আবশ্যক এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা সমীচীন। ’

news24bd.tv/আইএএম