এমন রোজকেয়ামতের দিন কারো জীবনে যেন না আসে 

সংগৃহীত ছবি

১৫ আগস্টে শেখ হাসিনার স্মৃতি রোমন্থন 

এমন রোজকেয়ামতের দিন কারো জীবনে যেন না আসে 

অনলাইন ডেস্ক

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের এই অমর বাণীই যেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার জন্য চির সত্যঃ ‌‌'এমন একান্ত করে চাওয়া/এ-ও সত্য/এমন একান্ত ছেড়ে যাওয়া/সেই সেই মতো/এ দু'য়ের মাঝে/তবু কোনখানে আছে কোন মিল/নহিলে নিখিল/এতবড় নিদারুণ প্রবঞ্চনা/হাসিমুখে এতকাল বহিতে পারিত না/সব তার আলো/কেটে কাটা পুষ্পসম/এতদিনে হয়ে যেত কালো। '

বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনাকে  কান্নাভেজা কন্ঠে বলেছিলেন, 'হাসু, তোরা দ্রুত দেশে ফিরে আয়। জয়-পুতুল ছাড়া যে আমার সময় কাটেনা। ' কিন্তু না, হাসুর আর দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনা।

দু'দিনের ব্যবধানে বয়ে গেছে বাংলাদেশের ওপর এক রোজকেয়ামত। বাবা-মা-ভাই-ভাবী, সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। ফলে শেখ হাসিনাকে চলে যেতে হলো নির্বাসনে, রাজনৈতিক আশ্রয়ে- প্রতিবেশি ভারতের দিল্লিতে। অর্থাৎ তাঁকে পরদেশী হয়ে ভারতে থাকতে হলো ১৯৮১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত।

আজ থেকে দু'দশকের বেশি সময় আগে সুধাসদনে একটি সাক্ষাতকার প্রদানকালে আমাকে ১৫ আগস্ট সম্পর্কিত বিশেষ কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের দুঃসহ  স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে নিজের একটি  লেখাও আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই লেখাটির অংশবিশেষ তুলে ধরছি আমার লেখায়। প্রসঙ্গতঃ আমাকে দেয়া  বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সেই বিশেষ সাক্ষাতকারটি ২০০২ সালের ২০ জুন সেসময়কার সাড়াজাগানো দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৩ আগস্ট-ই টেলিফোনে মা-মেয়ের মধ্যে শেষ কথা হয়। অর্থাৎ বেগম মুজিব ও শেখ হাসিনার মধ্যে। মা অঝোরে কেঁদে কেঁদে মেয়েকে এও বলেছিলেন, 'তোর আব্বা, আমাকে শেখ শহীদের বিয়েতে যেতে দেননি। তাঁর বোঝা উচিত ছিল, শহীদ আমার একমাত্র বোনের ছেলে। ' শেখ হাসিনা স্বামীর মন রক্ষার জন্য একরকম বাধ্য হয়েই পশ্চিম জার্মানিতে গিয়েছিলেন, দুই শিশুসন্তান জয়-পুতুল ও ছোটবোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি ১৫ আগস্টের পর স্বামীর কাছে যাবেন-এমন সিদ্ধান্তেই স্থির ছিলেন। কারণ তাঁর পরম শ্রদ্ধেয় স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম উপাচার্য ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীর কথা তাঁকে রাখতেই হবে। কেননা, তার বাবাকে ১৫ আগস্ট মহামান্য রাষ্ট্রপতিরূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো 'আচার্য' পদে সংবর্ধিত করবে।  

শেখ তখন হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম এ ক্লাশের ছাত্রী। বিদেশ সফরের জন্য ছুটি মঞ্জুরের আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মতিন চৌধুরীর কাছে। কিন্তু তিনি তা নাকচ করে দিয়ে ছাত্রীকে বলেন, রাষ্ট্রপতির মেয়ে হিসেবে শুধু নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবেও  ঐতিহাসিক বরণ-উৎসব উপেক্ষা করতে পারো না। তুমি ১৫ আগস্টের পর যেও। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ১৯৪৯ সালে আইন বিভাগের ছাত্র থাকাকালীন তোমার বাবার ছাত্রত্ব কেড়ে নিয়েছিলো। স্যার, আমি অনুষ্ঠানের জন্য ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশেই থেকে যেতে চেষ্টা করবো-প্রিয় স্যারের সঙ্গেও এই ছিলো শেষ কথা। সেদিন শেখ হাসিনা দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে বাসায় ফেরেন। বাসায় ফিরে স্যারের কথাগুলো মা-কে বলেন। মা বলেন, 'শিক্ষকের আদেশ শিরোধার্য। ' 

কিন্তু ওদিনই সন্ধ্যায় শেখ হাসিনাকে  স্বামী ড. ওয়াজেদের টেলিফোন। শেখ হাসিনা উপাচার্যের আপত্তির কথা জানালেন। শিশুপুত্র জয় তখন প্রচন্ড জ্বরে ভুগছিল। সেটাও বললেন। কিন্তু কোনকিছুতেই কাজ হলো না। বরং রাগতস্বরে বাজার-সদায় করাসহ ছুটি নেয়ার কথা বললেন। শেখ হাসিনা স্বামীর মুখের ওপর আর না করতে পারলেন না। ৩০ জুলাই পুত্রকন্যা ও ছোটবোনকে নিয়ে আকাশ পথে উড়ে গেলেন পশ্চিম জার্মানিতে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ১৫ আগস্টের স্মৃতি রোমন্থন করেন এভাবে - 'এমন রোজকেয়ামতের দিন, কোনদিন যেন কারো জীবনে কখনো না আসে।

যেমনটি এসেছে আমার জীবনে। মাঝেমধ্যে মনে উদয় হয়, সেদিন যদি ভিসি স্যারের কথা অমান্য না করে ঢাকায় থেকে যেতাম, তাহলে আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। বেঁচে থাকা এই জীবনটাতে সে কি যন্ত্রণা তা প্রকাশ করার ভাষা নেই। '

 
শেখ হাসিনা নিজের ডায়েরিতে  লিখেছেন, 'সব হারিয়ে এমন বেঁচে থাকতে তো আমি চাইনি। প্রতিদিন পলে পলে দ্বগ্ধ হওয়া, সব হারানোর প্রচন্ড দাবদাহ সমস্ত অন্তরজুড়ে যে তুষের আগুনের ধিকিধিকি জ্বলনীর জীবন, এ জীবন তো আমি চাইনি। এর চেয়ে মা, বাবা,ভাই ও ভাবীদের সঙ্গে আমিও চলে যেতে পারতাম, তাহলে প্রতিদিনের অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে তো বেঁচে যেতাম। আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। ' তিনি আরো লিখেছেন, আমি সেদিন কেন যে স্যারের নিষেধ শুনলাম না, আমি সেই কেনোর জবাব খুঁজে ফিরি। আমার দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়, আমায় কুঁরেকুঁরে খায়। দলপাকানো বেদনায় আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়। স্মৃতির নিদারুণ কষাঘাতে জর্জরিত হই। '

শেখ হাসিনা লিখেছেন, 'আমার সেই স্যার ড. আব্দুল মতিন চৌধুরীও নিস্তার পাননি। ২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করে মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার পর একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। সেটা ২৩ জুন সন্ধ্যায় শিক্ষাবিদ মাজাহারুল ইসলামের বাসায়। আমাকে এক সংবর্ধনা দেন তিনি। কিন্তু নিয়তি কি নিষ্ঠুর! সেই প্রিয় স্যার পরের দিন পৃথিবী থেকেই চিরবিদায় নেন। ডায়েরির পাতায় আমার জীবনের সব চাইতে করুণ ও বেদনাঘণ হাহাকার পরিপূর্ণ একটি বিশেষ স্মৃতি রয়েছে মহান ওই মানুষটিকে নিয়ে। এসব দুঃসহ স্মৃতি ম্লান বা হাল্কাও হয় না। আমি যেন প্রত্যক্ষ করি, স্যারের সঙ্গে সেই কথোপকথনের দৃশ্য। তখনই প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করি আমার সমস্ত বুক জুড়ে। অন্তর কেবল প্রচন্ড শূণ্যতায় আর্তনাদ করে। বুকের মধ্যে দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টি অজান্তেই ঝাঁপসা হয়। আমি আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি।

শেখ হাসিনা নিজের ডায়েরিতে লিখেছেন, 'ভীষণ ব্যস্ত দিনেও যখন আমি কদাচিৎ একা বসে ভাবি তখন ফেলে আসা জীবনের স্বপ্নমধুর কিংবা বিষাদ-বেদনার স্মৃতির অর্গল তখনই উন্মুক্ত হয়। আমি বেদনায় বিমুঢ় হয়ে যাই। সমব্যথায় অংশীদার হয়ে আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বেঁচে আছে। আমার মতো প্রচন্ড শোকের দাব-দাহকে বুকের গভীরে ছাইচাপা দিয়ে। যা নিরন্তর কেবল আমাদের অন্তরকে ক্ষত বিক্ষত করে। স্মৃতির দংশন একমাত্র আমি ছাড়া আর কাউকে কখনোই সহ্য করতে হয়নি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার প্রার্থনা, আমার মতো যেন কাউকে কখনোই এমন ভয়ানক স্মৃতিচারণ করতে না হয়। মানুষের কিছু কিছু স্মৃতি থাকে যা কখনো অর্ন্তহিত হয় না।  

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।