পাহাড়ে চাষিদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে গাব ফল

সংগৃহীত ছবি

পাহাড়ে চাষিদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে গাব ফল

মশিউর রহমান

একসময় পাহাড়ের পর পাহাড়ে শোভা পেত জুম চাষ। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ি টিলা ভূমিতে জুম চাষ নিয়ে ব্যস্ত থাকা সেই জুমিয়ারা বিলাতি গাব ফল চাষে সাফল্যের স্বপ্ন দেখছে। চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ড উপজেলার পাহাড়ি পতিত জমিতে প্রতিবছরই বাড়ছে বাগানের সংখ্যা। অনুকূল আবহাওয়া ও পাহাড়ের মাটি গাব ফল  চাষের উপযোগী হওয়ায় বাড়ছে চাষের পরিমাণ।

চাষিরা নিজেদের কঠোর পরিশ্রম আর প্রচেষ্টায় পাহাড়ের অনাবাদি টিলায় বিলাতি গাব চাষে ঈর্ষণীয় সফলতা এনেছেন। পাহাড়ে ছোট-বড় গাব ফল বাগানের সংখ্যা প্রায় ১৫০০। আর এ খাতে জড়িত অন্তত ১০ হাজার মানুষ।  

ফল চাষিরা বলেন, বর্তমান সময়ে ফলের মৌসুমে পাহাড়ি টিলা ও জমির বাগান থেকে বছরে প্রায় লাখ লাখ টাকার গাব ফল বেচাকেনা হয়।

বিলাতি গাবের বৈজ্ঞানিক নাম (Diospyros discolor যা Ebenaceae) পরিবারভুক্ত। যদিও একে বিলাতি গাব বলা হয়, যার আদি নিবাস ফিলিপাইন। ইংরেজিতে একে velvet apple বলা হয়। বিলাতি গাব গাছ মাঝারি আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ। যা ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। বাকল কালো ও ফাটা ফাটা। পাতা বেশ বড়, চকচকে সবুজ। একটা গাছ হলেই তার চারপাশে আটি পড়ে আরও গাছ হয়। গাছ বেশ ছোট অবস্থায়ই ফল হতে শুরু করে। একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদাভাবে ফোটে। ফুল ফোটার মৌসুম বসন্ত, ফল পাকে বর্ষায়। ফুল পাকা ফলের মতো মিষ্টি সৌরভ ছড়ায়। ফল ডিম্বাকৃতি বা গোলাকার। কাঁচা ফল সবুজাভ বাদামি, উজ্জ্বল মখমলের মতো ত্বকে আবৃত। ফলটি পাকলে লাল ও লাল-গোলাপী রঙের  হয়ে থাকে। পাকা ফলের ভেতরটা সাদা। তিন-চারটি কালো রঙের বীজ থাকে। পাকা ফল থেকে তীব্র গন্ধ পাওয়া যায়। ফলের ভেতরে শিরা যুক্ত মিষ্টি শাঁস রয়েছে।  

গ্রামে এ ফলের নানামুখী ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কাঁচা অবস্থায় কেউ কেউ সবজি হিসেবে রান্না করে খান। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁস থেকে ৬০ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। এই ফল ও বাকল বিভিন্ন রোগের মহৌষধ।

গাব গাছের কাঠ শক্ত প্রকৃতির। কাঠ ঘর তৈরির কাজে লাগে। বর্ষাকালীন ফল বিলেতি গাব নামে পরিচিত; গ্রামে এটি এক সময় অবহেলিত থাকলেও এখন এর বেশ কদর রয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো গাব গাছের ২ টা জাত রয়েছে। দেশি গাব আর বিলাতি গাব। এক জায়গায় একটা পার্থক্য পেয়েছি, ফলের পার্থক্য। একটি গাব সুস্বাদু ও মিষ্টি, একে বিলাতি গাব বলা হয়। অন্যটিকে দেশি গাব বলা হয়। এটি খেতে হালকা মিষ্টি ও কষযুক্ত। কাঁচা ফল সবুজ এবং পাকলে হলুদ হয়ে যায়।

সিতাকুণ্ড উপজলোর মধ্যম মহাদেবপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইউসুফ আলী শাহ জানান, পাহাড়ে তার ৫০ এর বেশি বিলাতি গাব গাছ রয়েছে। ফলন হয়েছে ভালো। গাব চাষে তেমন কোন খরচ হয় না। গাব গাছ একবার লাগালে অনেক বছর পর্যন্ত ফল দেয়। ইতিমধ্যে তিনি গাব বিক্রির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে  ক্ষতিকর কোন ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। তিনি প্রতিটি গাব খুচরা ৮ থেকে ১০ টাকা বিক্রি করছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লার পাইকারি ব্যবসায়ীরাই বাগানের সিংহভাগ গাব কিনে নিয়ে যায়। চাষিরা বাগানের গাবে ফরমালিন বা কোনো বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করেন না। বিষমুক্ত হওয়ায় এখানকার বাগানগুলোর গাবের চাহিদাও সবার কাছে বেশি।

বিলেতি গাব চাষাবাদে ভাল ফলন দেখে এর জাত উন্নয়নে পটুয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব রব্বানীর নেতৃত্বে এক দল গবেষক কাজ করছেন। তারা বিলেতি গাবের দু’টি উন্নত সীডলেস জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ দুই জাতের বিলাতি গাবের স্বীকৃতি দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে এ জাত দু’টি তারা পাহাড়ের চাষিদের মধ্যে বিতরন শুরু করেছেন।

পটুয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের (ডিন) অধ্যাপক ড. মাহবুব রব্বানী

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৬ হাজার একর জমিতে এ বিলাতি ফলটি চাষ হচ্ছে। প্রতি একরে উৎপাদন ৩ মেট্রিক টন। কমপক্ষে ১৫০০ চাষি এর সাথে জড়িত। এছাড়া বিভিন্ন বাড়িতেও বিলাতি গাব গাছ দেখা যায়। ওই সকল পাহাড়ি অঞ্চলে বিলাতি গাবের চাষ ভালো হয়।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, পার্বত্য এলাকার মাটি ও আবহাওয়া গাব চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উৎপাদিত গাব সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ জরুরি। এতে চাষিরা ফলের ন্যায্যমূল্য পাবে এবং বিপুল পরিমাণ ফল পচে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।

News24bd.tv/AA