আধুনিক সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার উপায়

প্রতীকী ছবি

আধুনিক সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার উপায়

সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)

আধুনিক সময় ও সভ্যতা পৃথিবীর বিরাট ও বিস্তৃত পরিধিকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে। ফলে সুবিশাল পৃথিবী এখন একটি ঘর ও একটি পরিবারে পরিণত হয়েছে। এর অধিবাসীরা নানা শ্রেণি, গোত্র, জাতি ও সম্প্রদায়ের লোক হওয়া সত্ত্বেও তারা একই পরিবার ও ঘরের মানুষের মতো বসবাস করছে। ফলে মানুষের সামনে এমন একটি জীবনধারা অবলম্বনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, যাতে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শ্রেণি-সম্প্রদায়ের মন-মেজাজ, স্বাদ-রুচি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতির স্বীকৃতি রয়েছে।

এটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সভ্য জীবনের অপরিহার্য শর্ত। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিনয় ও স্বীকৃতি ছাড়া আধুনিক বিশ্বে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, পরস্পরকে জানা ও বোঝার অবারিত সুযোগ থাকার পরও মানুষ পরস্পরের প্রতি উদাসীন। একই ঘর ও পরিবারের সদস্য হওয়ার পরও, একই বাজার-ঘাটে চলাচলের পরও, একই অফিস-আদালতের কাজ করার পরও মানুষ পরস্পর সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখে না।

বিশেষত তারা অন্যের আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-আচার, শিক্ষা ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অজ্ঞ ও অপরিচিত। তারা এতটাই অপরিচিত যতটা অপরিচিত ছিল প্রাচীন কালের লোকেরা। যখন পরস্পরকে জানার কোনো সুযোগ ছিল না। উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিমরা হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে।

শহর কিংবা গ্রাম সর্বত্র তারা মিলেমিশে একাকার। হাটে-ঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অফিস-আদালতে, বাস ও রেলস্টেশনে তাদের নিত্য দেখা, শত বছর ধরে তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তারা চাইলে সহজে পরস্পরকে চিনতে পারে। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তারা পরস্পরের ধর্মীয় বিশ্বাস, সভ্যতা-সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি, জাতিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অজ্ঞ ও অপরিচিত। তারা পরস্পরকে যতটুকু জানে তা-ও অসম্পূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত, অগভীর, শ্রুতি ও কল্পনা নির্ভর। এই দূরত্বের কারণেই এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় সম্পর্কে মারাত্মক ভুল-বোঝাবুঝির শিকার।

এ ছাড়া কোনো কোনো সময় ঘৃণা ও বিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য, রাজনৈতিক প্রচারণা, ইতিহাসের ভুল উপস্থাপন, ভিত্তিহীন গল্প-কাহিনি মানুষের মন-মস্তিষ্কে ভুল ও অপ্রীতিকর ছবি এঁকে দেয়, যা সমাজে একটি বিভেদের দেয়াল তৈরি করে এবং দিন দিন তাদের ভেতর ভ্রান্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি যারা পক্ষপাতদুষ্ট নয়, কুসংস্কার যাদের ওপর ভর করেনি, যারা স্বচ্ছ ও নির্দোষ মনের অধিকারী, তাদেরও অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা-প্রচলন ও সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তারা এমন সব উত্তর দেয়, যা রীতিমতো হাস্যকর। এই অজ্ঞতা ও দূরত্বের দায় বিশেষ কোনো সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীর নয়, এই দায় সবার ওপর বর্তায়। বিশেষভাবে তাদের ওপর বর্তায় যারা সমাজকর্মী, যারা দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করে। তাদের দায়িত্ব ছিল সমাজে বসবাসকারী জাতিগোষ্ঠীকে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

সভ্য পৃথিবী আজ এ কথার ওপর একমত যে প্রেম ও ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধা, আস্থা ও শান্তির সঙ্গে বসবাস করা এবং সৎ উদ্দেশ্যে একে অন্যের সহযোগী ও কর্মসঙ্গী হওয়ার জন্য পরস্পরকে সঠিকভাবে জানা আবশ্যক। সমাজের প্রতিটি সদস্যের জন্য এটা জানা আবশ্যক যে অন্য সদস্যের ধর্মীয় বিশ্বাস কী, সে কোন ব্যবস্থা ও বিধিমালার অনুগত ও অনুসারী এবং সে কোন কোন বিষয়কে নিজের জন্য অপরিহার্য মনে করে। যেন তার সঙ্গে পথচলা আনন্দের ও স্বস্তির হয়। তার ভালো লাগা ও মন্দ লাগার প্রতি লক্ষ রাখলে সে-ও আমার ভালো-মন্দ বিবেচনা করবে। সবার ভেতর যখন এই বোধ তৈরি হবে, তখন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

যখন কোনো সমাজে পরস্পরকে জানা ও বোঝার পথ বন্ধ হয়ে যায়, যখন তারা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে না, তখন সমাজে দ্বন্দ্ব, বিবাদ ও সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়, তাদের ভেতর সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাস জন্ম নেয়, যা সামাজিক সুখ, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের অন্যতম মূল কারণ এটি।

পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাবে, সামাজিক দূরত্ব, সংশয় ও অবিশ্বাসের কারণে ভারতবর্ষে মুসলমানরা একটি সংকটময় সময় কাটাচ্ছে। তাদের যোগ্য ও শক্তি-সামর্থ্যের বেশির ভাগই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে আত্মপক্ষ সমর্থন এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ খণ্ডনে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মুসলমানের দায়িত্ব হলো উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যবদলে এবং সামাজিক মুক্তিতে দূর ও নিকট অতীতে মুসলমানরা যে অসামান্য অবদান রেখেছে তা সঠিকভাবে তুলে ধরা। ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি, কাব্য-সাহিত্য, শিল্পকলা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উন্নয়নে মুসলিম জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ও স্থপতি, শাসক ও নেতাদের ভূমিকা সমাজের সামনে স্পষ্ট করা। বিশেষত মুসলিম আলেম, সুফি-সাধক ও দ্বিনপ্রচারকরা উপমহাদেশের সামাজিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মুক্তিতে শান্তিপূর্ণ যে প্রচেষ্টা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত রেখেছেন, তা এ দেশের তরুণ ও যুবসমাজের জানা প্রয়োজন।

সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে এ দেশের সব ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পেছনে যে ইসলামই অনুঘটক ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল তা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। মুসলমানরা যদি নিজেদের পরিচয়, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অতীত অবদান ও কৃতিত্বগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারে, তবে সমাজে তাদের অধিকার ও মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাদের প্রতি সমাজের ভুল ধারণাও ভাঙবে না।