১০ কোটি মানুষের সুরক্ষায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন আজ

১০ কোটি মানুষের সুরক্ষায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন আজ

অনলাইন ডেস্ক

দেশের চার শ্রেণির প্রায় ১০ কোটি মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা। বহুলপ্রত্যাশিত এই ‘সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি’ আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে উদ্বোধন করবেন।  

উদ্বোধনের দিন থেকে কেউ চাইলে এই প্রক্রিয়ায় নিবন্ধন করে যুক্ত হতে পারবেন। এ জন্য সরকার পৃথক একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে।

 

বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তাকাঠামোর আওতায় আনতে এবং নিম্ন আয় ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সমাজের ৮৫ শতাংশ মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেশে প্রথমবারের মতো সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা (স্কিম) চালু হতে যাচ্ছে।  

পেনশন স্কিমের মাধ্যমে ১৮ বছরের বেশি দেশে-বিদেশে থাকা ১০ কোটি মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে সরকারের। পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ধীরে ধীরে বাড়ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা এবং তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা।

আর এ কারণেই চালু করা হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা।  

তবে এ স্কিম থেকে বাদ পড়ছেন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্ত ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ। তাদের সবাই নগদ ভাতার সুবিধা পাচ্ছেন। পেনশন স্কিমে অংশ নিতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করতে হবে। অন্যথায় এ স্কিমে যুক্ত হতে পারবে না। একই সঙ্গে কর্মরত সরকারি চাকরিজীবীরাও আপাতত এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারছেন না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বকর্মে নিয়োজিত ও স্বল্প-আয়ের নাগরিক ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা এতে অংশ নিতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩’ পাস হয়। ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে ১৩ আগস্ট এর বিধিমালা জারি করা হয়।

জানা যায়, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে সরকার থেকে নগদ আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ। এছাড়া খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেন ৩ কোটি ৬৭ লাখ জন। এর বাইরে আরও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। চলতি অর্থবছরে শুধু নগদ আর্থিক সহায়তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ আছে ৪৩ হাজার কোটি এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে আছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য কর্মসূচিতেও বড় ধরনের বরাদ্দ আছে।

সম্প্রতি জারি হওয়া সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালায় ধারা (৪)-এর উপধারা (৩)-এ বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে-এ স্কিমে অংশ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা সমর্পণ করতে হবে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সরকার আগামী দিনে পর্যায়ক্রমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির চাপ তুলে দিয়ে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিয়ে আসা হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, প্রকৃত সিদ্ধান্ত হবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিয়ে আসা। দেশে ১৫০টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনা হচ্ছে। এতগুলো দরকার নেই। কয়েকটি কর্মসূচি দিয়ে সব পরিচালনা করা যায়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি হচ্ছে সরকার থেকে অনুদান পাওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত গরিবদের জন্য শতভাগ চাঁদা পরিশোধ করবে-এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিতে। কিন্তু সেটি রাখতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাপ্রাপ্যদের এখানে আনতে হলে সমপরিমাণ সুবিধা দিতে হবে।

দেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি সম্পূর্ণ নতুন। এ জন্য কিছু নিয়মকানুন দিয়ে সম্প্রতি যে বিধিমালা জারি করা হয়েছে, সেখানে বলা হয় ধারাবাহিক তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। পরবর্তী সময়ে পুরো বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি সচল হবে না। নির্দিষ্ট তারিখে চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানাবিহীন পরিশোধ করা যাবে। এরপর প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে হিসাবটি সচল করা যাবে। এছাড়া একজন চাঁদাদাতা আগাম কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন।

সেখানে আরও বলা হয়, অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাবটি স্থগিত হবে না। আরও বলা হয়, কোনো চাঁদাদাতা ৭৫ বছরের আগে নিখোঁজ হলে এবং নিখোঁজ হওয়ার পর সাত বছর অতিবাহিত হলে তার হিসাব স্থগিত করে নমিনিকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়া কেউ চাঁদা প্রদানকালে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে অর্থ উপার্জন না করতে পারলে তাকে অসচ্ছল চাঁদাদাতা ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে।

সরকারের পেনশন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে টাকা সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত তফশিলি ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা, উপশাখাকে সম্মুখ অফিস হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকালে এই সম্মুখ অফিসের কেউ দুর্নীতি বা অনিয়ম করলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এছাড়া এই স্কিমের আওতায় চাঁদাদাতা স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না। তবে স্কিম চলাকালীন কেউ মারা গেলে মনোনীত নমিনির নামে হস্তান্তর করা যাবে। এছাড়া চাঁদাদাতা তার মোট জমানো অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এটি পরবর্তী ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

আইন অনুযায়ী, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আওতায় চারটি স্কিম থাকছে। প্রথম হচ্ছে প্রবাসী স্কিম, যা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা দেশীয় মুদ্রায় এই হিসাব খুলতে পারবেন। প্রবাসীরা ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও বৈধ চ্যানেলে এর কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন। দ্বিতীয় হচ্ছে প্রগতি স্কিম, এটি বেসরকারি চাকরিজীবী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য। তৃতীয় হচ্ছে সুরক্ষা স্কিম, এখানে স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং চতুর্থ সমতা স্কিমে স্বল্প-আয়ের নাগরিকরা অংশ নেবেন। আপাতত সীমিত আকারে পেনশন কর্মসূচি চালু করা হবে।

এ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ৫০ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা থাকবে। মাসিক চাঁদা হবে সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন এক হাজার টাকার মধ্যে পাঁচশ টাকা সরকার প্রদান করবে। পেনশনব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কর্মকাণ্ড হবে অনলাইনে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করেও চাঁদা দেওয়া যাবে। আর ৫০ বছরের বেশি বয়সিরা এতে অংশ নিতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে অংশ নেওয়ার দিন থেকে টানা দশ বছর চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। এরপর তিনি যে বয়সে উপনীত হন, সে বয়স থেকে পেনশন পাবেন।

৭৫ বছর বয়সের আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে তার নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের পেনশন প্রাপ্য হবেন। ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে কোনো পেনশনার মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ নমিনিকে দেওয়া হবে। কোনো প্রয়োজনে চাঁদাদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসাবে নেওয়া যাবে এবং নির্ধারিত ফিসহ তা পরিশোধ করতে হবে। বিনিয়োগ বিবেচনায় পেনশনের চাঁদা কর রেয়াতযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মাসিক পেনশন বাবদ পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে।

পেনশন বাবদ জমাকৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি ‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ গঠন করা হবে। এ তহবিলে চাঁদা জমা, হিসাব সংরক্ষণ, পুঞ্জীভূত অর্থের সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিনিয়োগ এবং পেনশন দেওয়াসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদিত হবে। এক বা একাধিক তফশিলি ব্যাংকে তহবিলের অর্থ রাখা যাবে।

অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি পেনশন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থসচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, এফবিসিসিআই-এর সভাপতি, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি প্রমুখ এর সদস্য হবেন।

news24bd.tv/আইএএম