বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় সচ্ছল হবে সংসার

 

 

 

কুষ্টিয়ার দুই উপজেলায় সেলাই মেশিন পেলেন ৪০ অসহায় নারী

বসুন্ধরা গ্রুপের সহায়তায় সচ্ছল হবে সংসার

অনলাইন ডেস্ক

কেবল সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে দোলা। এই বয়সেই সংসার নিয়ে তার চিন্তার অন্ত নেই। বাবা চায়ের দোকান চালান। বাবার স্বল্প আয়ে সংসারের চাকাই ঘোরে না ঠিকমতো।

পড়ালেখা করতে দোলা এসে থাকে মামার বাড়িতে। কুষ্টিয়া হাই স্কুলে পড়ে সে। বাবা ঠিকমতো পড়ার খরচ দিতে পারেন না, কিন্তু দোলা পড়াশোনা করবেই। নিজে কিছু একটা করতে চায় সে।

এই বয়সে করবেই বা কী। কার কাছে শুনতে পেল বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কথা। ছুটে এলো শুভসংঘের বন্ধুদের কাছে। এত কম বয়সে সেলাই প্রশিক্ষণ নিতে পারবে কি না, এটা খুব ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল।

পরিবারের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এবং পড়াশোনার ব্যাপক আগ্রহ দেখে দোলাকে শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয়। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অন্যদের তুলনায় দ্রুত সেলাইয়ের কাজ শিখে যায় দোলা। স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় আরো বেশি করে কাজ করার। প্রতিদিনই সেলাইয়ের ফোঁড়ে স্বপ্ন বুনেছে কিশোরী মেয়েটি। তার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করল বসুন্ধরা গ্রুপ।

সেলাইয়ের কাজ শেখার পর বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় সেলাই মেশিন। নতুন সেলাই মেশিন পেয়ে দোলার মুখে ফুটে ওঠে স্বপ্ন জয়ের হাসি। শুধু দোলাই নয়, কুষ্টিয়া সদর ও দৌলতপুর উপজেলায় সেদিন সেলাই মেশিন পেয়েছেন বিভিন্ন বয়সী সুবিধাবঞ্চিত ৪০ নারী।  
বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে তাঁদের হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও কালের কণ্ঠ’র প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।  

এই নারীরা যেন নিজেদের স্বাবলম্বী করতে পারেন সে জন্য প্রথমে তাঁদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়। কুষ্টিয়া সদরে শুভসংঘ আঞ্চলিক কার্যালয়ে এবং দৌলতপুর নুরুজ্জামান বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজ মাঠে প্রশিক্ষিত এসব নারীর হাতে সেলাই মেশিন তুলে দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পার্থ প্রতীম শীল, নুরুজ্জামান বিশ্বাস ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক, শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামানসহ শুভসংঘের সদস্যরা। সেলাই মেশিন হাতে পেয়ে দরিদ্র নারীদের চোখ ভিজে যায় আনন্দ অশ্রুতে।

কুষ্টিয়া সদরে বিলকিস বেগম এবং দৌলতপুরে আফরোজা খাতুন মাসখানেক হলো এই নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তিন মাস এই প্রশিক্ষণ চলবে। কুষ্টিয়া জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রগ্রাম অফিসার মর্জিনা খাতুন বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপ সহায়-সম্বলহীন অসহায় নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে সেলাই মেশিন প্রদান করছে। এটা খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই মেশিন দিয়ে উপার্জন করে নিজেদের এগিয়ে নিতে পারবেন সুবিধাবঞ্চিত নারীরা।

রেজাউল হক চৌধুরী বলেন, ‘বসুন্ধরা গ্রুপ সব সময়ই দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে চলেছে। অসহায় দরিদ্র নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাঁদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণের যে উদ্যোগ তারা নিয়েছে, সেটি একজন অসহায় মানুষকে স্বাবলম্বী করার সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ। বসুন্ধরা গ্রুপকে সাধুবাদ জানাই। তাদের এই উদ্যোগ কুষ্টিয়ার সব উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ুক। ’

সদর উপজেলার মোল্লাতেঘরিয়ার স্বামী পরিত্যক্তা হাওয়া খাতুন বলেন, ‘বাচ্চা নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছি। নতুন উদ্যম নিয়ে সেলাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। বসুন্ধরা গ্রুপ আমাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিল। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষে এই সুযোগটিকে কাজে লাগাতে চাই, যেন আমার সংসারের অভাব দূর হয়। আর দরিদ্র থাকব না। আমাদের দারিদ্র্য দূর করে দিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। আল্লাহ তাদের সবার ভালো করবেন। ’

কুষ্টিয়া শহরের হাউজিং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী মায়া খাতুন। দিনমজুর মনজু ইসলামের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মায়া বড়। বাবা অসুস্থ হয়ে বেকার বসে আছেন। অভাবের কারণে সেশন ফি দিতে না পারায় স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে মায়ার। নিজেদের একটি ঘর থাকলেও বসবাসের উপযোগী নেই। বৃষ্টি এলে সেখানে থাকা যায় না। বাড়িতে কোনো নলকূপ ও বাথরুম নেই। অন্যের বাড়ি থেকে পানি আনতে হয়। মায়া নিজে স্বাবলম্বী হয়ে সংসারের হাল ধরার জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সে একটি সেলাই মেশিন পেয়েছে। এখন নিজের এবং অন্যের কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে মায়া। তার কণ্ঠে এমনই প্রত্যয় ছিল সেদিন।

মায়া বলে, ‘কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। দিশাহারা আমাকে পথ দেখিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। এখন আর অভাব থাকবে না। পড়াশোনাও করতে পারব। আমার দরিদ্র পরিবারকে আলোর পথ দেখিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করার জন্য বসুন্ধরা গ্রুপকে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ এই গ্রুপের সবাইকে ভালো রাখবেন। ’

অনেক ছোট থাকতেই বিয়ে হয়ে যায় বিনা খাতুনের। পরিবারের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। স্বামী দেলোয়ার হোসেন কোনো রকমে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করলেও ২০ বছর ধরে তিনি ফসফুসের রোগে আক্রান্ত। কোনো কাজ করতে পারেন না। বিনার ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য এবং সংসারের খরচ মেটানোর জন্য বিনা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান। হাওয়া খাতুন, মায়া খাতুন ও বিনার মতো যেসব নারী শুভসংঘ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁরা এখন জামাকাপড় কাটতে ও সেলাই করতে জানেন। সেলাই মেশিন পাওয়ার পরেও তাঁরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসছেন এবং নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করছেন। সবার একটাই ইচ্ছা, দারিদ্র্য দূরীকরণ। সেলাইয়ের কাজ করে দারিদ্র্যকে বিদায় জানাতে চান তাঁরা।

দৌলতপুর উপজেলার জয়রামপুরের দরিদ্র জিয়ারুল ইসলামের স্ত্রী আলিয়া আক্তার। শারীরিক অসুস্থতার জন্য জিয়ারুল ভারী কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী আলিয়া বাড়িতে সেলাই মেশিন চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিছুদিন আগে আগুনে তাঁর ঘরসহ সেলাই মেশিনটিও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অভাব-অনটনে খেয়ে না খেয়ে তাঁদের জীবন চলছে। দৌলতপুর শুভসংঘের সদস্যরা খবর পেয়ে আলিয়াকে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি সেলাই মেশিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আলিয়া নতুন করে বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পান। শুভসংঘের সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে নতুন আরো কাজ শিখেছেন আলিয়া।

সেলাই মেশিন পাওয়ার পর আলিয়া বলেন, ‘আগুনে আমার শুয়ে থাকার ঘরসহ সাধের সেলাই মেশিনটিও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অভাবের তাড়নায় কিভাবে কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে আমাকে একটি সেলাই মেশিন দেওয়া হয়। মেশিনটি পেয়ে আমার খুবই উপকার হলো। আল্লাহ বসুন্ধরা গ্রুপের সবাইকে হায়াত বাড়িয়ে দিক। আমাদের মতো মেহনতি মানুষের পাশে বেশি করে দাঁড়ানোর তৌফিক দিক। ’

বসুন্ধরা শুভসংঘ দৌলতপুর উপজেলা শাখার সভাপতি তামিন রহমান সুইট বলেন, ‘সেলাই প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ অসহায় নারীকে নির্বাচন করেছি। প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে ২০ নারীকে বাছাই করে তাঁদের হাতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়েছে। অতিদরিদ্র পরিবারের এই নারীরা সেলাই মেশিন পেয়ে খুবই উপকৃত হয়েছেন। বসুন্ধরা গ্রুপের জন্য সবাই মন খুলে দোয়া করেছেন। এই মেশিন হবে তাঁদের দারিদ্র্য দূর করার হাতিয়ার। ’

বসুন্ধরা শুভসংঘ কুষ্টিয়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কাকলী খাতুন বলেন, ‘আমরা জেলা শহরের মধ্যে সুবিধাবঞ্চিত ও অসচ্ছল ৩০ নারীকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে ২০ জনকে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এই নারীরা এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরিবার, সমাজ ও দেশের উন্নয়নযাত্রায় সহযোগী হতে পারবেন। তাঁদের আর অভাব থাকবে না। ’