সমাহিত হতে ইতালি থেকে আসছেন প্রাণহীন ফাদার রিগন

ফাদার রিগন

মৃত্যুর একবছর পর

সমাহিত হতে ইতালি থেকে আসছেন প্রাণহীন ফাদার রিগন

বাগেরহাট প্রতিনিধি

শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতালির নাগরিক ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মংলায় সমাহিত করা হবে। মৃত্যুর এক বছর পরে আগামীকাল রবিবার ইতালি থেকে বাংলাদেশে আসছে বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ফাদার রিগনের প্রাণহীন দেহ।  

পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ দুইয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব সুডানা ইকরাম চৌধুরী জানান, ভোর ৫টায় তার্কিশ এয়ারলাইন্স’র ফ্লাইট TK-0712-তে করে ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছাবে। সেখান থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় হেলিকপ্টারযোগে ফাদার রিগনের মরদেহ বাগেরহাটের মংলায় পাঠানো হবে।

হেলিকপ্টারটি মংলার শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে অবতরণের পর সকাল সাড়ে ৯টায় ফাদার রিগণের মরদেহ নেওয়া হবে মংলা উপজেলা পরিষদের মাঠে। সেখানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফাদার রিগনকে সর্বস্তরের মানুষের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই ঘন্টা উপজেলা পরিষদের মাঠে রাখার পর মরদেহ নেওয়া হবে ফাদার রিগনের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট পলস্ উচ্চ বিদ্যালয় এবং সেন্ট পলস্ হাসপাতালে। সর্বশেষ শেহলাবুনিয়ার সেন্ট পলস্ গীর্জার সামনে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে দুপুরে সেখাইে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফাদার মারিনো রিগনকে সমাধিস্থ করা হবে।

মংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২১ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ৯ টায় মংলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে ফাদার মারিনো রিগনকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি অবতরণ করবে। সেখান থেকে শোভাযাত্রা সহকারে তাঁর মরদেহ উপজেলা মাঠে সর্বসাধারনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আনা হবে। সেখান থেকে সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে এনে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শেহলাবুনিয়া ক্যাথলিক গীর্জার পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। বিভিন্ন সরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে ফাদার রিগনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আহবান জানিয়েছে মংলা উপজেলা প্রশাসন।

ইতালির নাগরিক ফাদার রিগন ১৯২৫ সারের ৫ ফেব্রুয়ারি সে দেশের ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ভিল্লাভেরলা গ্রামে বাবা রিকার্ডো এবং মা মনিকার আট সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন মারিনো। তাঁর জীবিত ভাইবোন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাছে মারিনো একজন অতিশয় প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষ।  মাত্র ২৮ বছর বয়সে খৃষ্ট্রধর্ম প্রচারে জন্য ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় ছিলেন। ফাদার রিগন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাগেরহাটের মংলার শেহলাবুনিয়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। ফাদার রিগনকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে সরকার Friends of Liberation War Honour পদকসহ বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। ফাদার রিগন মংলায় থাকাবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর ২০১৪ সালে তার ভাই মংলায় এসে তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যান। তবে শর্ত ছিল ইতালিতে গিয়ে মৃত্যু হলে তাকে মংলার সেন্ট পলস্ গির্জার পাশে সমাহিত করতে হবে। শর্ত মানায় তিনি চিকিৎসার জন্য ভাইয়ের সঙ্গে ইতালি যেতে রাজি হন।

গত বছরের ২০ অক্টোবর ৯৩ বছর বয়সে ইতালির ভিল্লাভেরলা গ্রামে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধৃ ফাদার রিগন। ২৪ অক্টোবর গ্রামেরই একটি ক্যাথলিক গির্জায় তার শেষকৃত্য হয়। এ সময় তার কফিনটি ঢেকে দেওয়া হয় লাল-সবুজের পতাকায়। তিনি ইতালীয় পরিচয় রেখে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন।

অসুস্থ অবস্থায় ভাইবোন এবং আত্মীয়-পরিজনকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি সমাহিত হবেন শেহলাবুনিয়ার সাধু পলের গির্জার সামনে। তাঁর পরিবার একটি বছর সময় নিয়েছে ঐকমত্যে পৌঁছাতে। অবশেষে রিগনের শেষ ইচ্ছার কাছে তারা হার মেনেছে। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ছিল তাঁর অন্তিম প্রয়াণ। ঠিক এক বছর পর ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে তিনি যাত্রা শুরু করবেন বাংলাদেশের মংলা উপজেলার শেহলাবুনিয়া গ্রামের উদ্দেশে। কফিনবন্দী হয়ে ফিরছেন এবার ফাদার রিগন। আসছেন প্রিয় ভূমিতে সমাহিত হতে!

ফাদার মারিনো রিগন দীর্ঘ সময় মংলায় অবস্থানকালে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের তিনশত পঞ্চাশটি গান, জসীম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এদেশের খ্যাতিমান কবিদের অসংখ্য কবিতা। অন্যদিকে ফাদার রিগন বাগেরহাট জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট পলস হাসপাতালসহ প্রতিষ্ঠা করেন ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পলস সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র, যেখান থেকে মেয়েদের সেলাই করা নকশিকাঁথা রপ্তানি করা হতো বিদেশে। ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’র সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস রিগন সম্পর্কে বলেন, তিনি ইতালিতে বাংলাদেশের অঘোষিত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফ্রান্সিস সুদান হালদার বলেন, ফাদার রিগন নিজেই বলতেন ‘আমার মস্তকে আছে রবীন্দ্রনাথ- অন্তরে রয়েছে লালন’

সম্পর্কিত খবর