গুরুদাসপুরে মানব কিডনি কেনাবেচার নতুন সিন্ডিকেট

সংগৃহীত ছবি

বিক্রি হয়েছে প্রায় দুই শতাধিক 

গুরুদাসপুরে মানব কিডনি কেনাবেচার নতুন সিন্ডিকেট

মতিউর মর্তুজা, নাটোর 

রীতিমতো দরদাম করে মানুষের কিডনি কেনাবেচা চলছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায়। মনে হচ্ছে, এ যেন কিডনির হাট। তরুণদের প্রতিটি কিডনির দাম ৬-৭ লাখ আর মধ্যবয়সীদের কিডনির দাম একটু কমে দুই থেকে চার লাখের মধ্যে। বিক্রেতাদের রোগীর স্বজন সাজিয়ে এসব কিডনি প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রতিস্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে।

সক্রিয় একটি সিন্ডিকেট তরুণদের টার্গেট করে চালাচ্ছে মানব কিডনি সংগ্রহের এ প্রতিযোগিতা।  

কিডনি ফাউন্ডেশন এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যাণ বলছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্তদের মধ্যে প্রতিবছর ৪০ হাজার মানুষের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এর ফলেই গড়ে উঠছে কিডনি বেচাকেনার এরকম সিন্ডিকেট। সম্প্রতি এমনই একটি সিন্ডিকেটের খোঁজ মিলেছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলায়।

নিউজ টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী তথ্য বলছে, গুরুদাসপুরে এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে প্রায় ২ শতাধিক মানুষের কিডনি। কারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত তা অনুসন্ধানে মাঠে নামে নিউজ টোয়েন্টিফোর টিম।

গত মঙ্গলবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নাটোর পৌরসভার শিশুপার্ক এলাকায় সাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে দৌঁড় দেয় কিডনি সিন্ডিকেটের মূলহোতা আব্বাস ওরফে কিডনি আব্বাস। সামাদের মোড় এলাকায় গেলে হাতুড়ি দিয়ে ক্যামেরা ভাঙতেও তেড়ে আসে এই চক্রের আরেক সদস্য রশিদ।

এরপর চক্রের এই দুই সদস্যের পিছু নেয় নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদক। দীর্ঘক্ষণ অনুসরণ করার পর কথা বলতে রাজি হন রশিদ। তিনি বলেন, আব্বাস অনেক আগে থেকেই এই ব্যবসা করে, আমি এটা জানি। আমিও তার সঙ্গে গিয়েছিলাম। প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীর স্বজনের সঙ্গে কথা বলে কিডনি বিক্রি করা হয়।   

রশিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, কিডনি বিক্রি করতে চাওয়া সাহাপুরের তরুণ নজরুল ও তার মায়ের কাছে যায় নিউজ টোয়েন্টিফোর। সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের কী চুক্তি হয়েছিল-বিস্তারিত জানান তারা। এ সময় নজরুল বলেন, রশিদ আমাকে বহুদিন ফোন দিয়েছে, কিডনি বিক্রির কথা সে বারবার বলে। সে বলেছে, কিডনি দিলে বহু টাকা পাবো, ঋণপাতি সব শোধ করতে পারবো। বলেছে, তার সঙ্গে আব্বাস ও জেমসসহ অনেকে আছে।  

নজরুলের মা সভেদা খাতুন বলেন, রাশিদ বলেছে, তোর মা বোনকে নিয়ে আয়। যদি কিডনি বিক্রি করিস তবে অনেক টাকা হবে।  
 
ইতিমধ্যে কিডনি বিক্রি করা কয়েকজন জানান, নজরুল, কিডনি আব্বাসের মাধ্যমে তারা আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছেন। আবার ভুল বুঝতে পেরে ফিরেও এসেছেন কেউ কেউ। এদের একজন জানান, তিনি একবার আব্বাসের সঙ্গে গিয়েছিলেন, পরে রোগীর কথায়  মিল না পাওয়ায় তিনি ফিরে আসেন। এরপর আর তিনি আব্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।  

কিডনি বিক্রির জন্য ক্রেতা আছে, আছে বিক্রেতা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন মানুষগুলো তাদের শরীরের মূল্যবান এই অঙ্গ চক্রের সদস্যদের কাছে বিক্রি করছে? কিডনি বিক্রি করতে চাওয়া অনেকে জানান, তাদের অনেক ঋণ আছে। ঋণের জন্য অনেকে চাপ দিচ্ছেন তাদের। এ জন্য তারা কিডনি বিক্রি করতে রাজি হয়েছেন।  

ক্যামেরা দেখে দৌড়ে পালানো আব্বাসের কাছে আবারও যায় নিউজ টোয়েন্টিফোরের টিম। এ সময় তিনি কথা বলেন। তার দাবি, চক্রের অন্য সদস্য রশিদ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাকে সবাই চেনে এ জন্য রশিদ আমার নাম বলেছে।  

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চক্রের সদস্যরা সাধারণ মানুষকে ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. এ এফ এ ম এ জাহিদ বলেন, কিডনি দেওয়ার পর সেখানে অনেক সময় ইনফেকশন তৈরি হয়। পরে চিকিৎসা করাতে করাতে অনেকের জীবন যায়।  

এই বাস্তবতায় কিডনি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ চান এলাকাবাসী। তারা বলেন, এটা অবৈধ একটি কাজ। তাদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।  

কিন্তু এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ হলেও, প্রশাসনের নাকের ডগায় কিডনি বিক্রির রমরমা বাজার সম্পর্কে স্থানীয় সিভিল সার্জনের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। নাটোরের সিভিল সার্জন মুহাম্মদ মফিউর রহমান জানান, নাটোরে কিডনি বিক্রি হচ্ছে, এ ধরনের কোনো তথ্য তার জানা নেই।  

তবে, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কিডনি জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।  নাটোর জেলা পুলিশ সুপার তরিকুল ইসলাম জানান, আমরা এটা নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। কেউ এ বিষয়ে অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।  

কিডনি বিক্রির ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক