সিরাজগঞ্জ এলজিইডি অফিসে অনিয়মই যেখানে নিয়ম  

সিরাজগঞ্জ এলজিইডি অফিসে অনিয়মই যেখানে নিয়ম  

আব্দুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

সিরাজগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৗশল বিভাগ (এলজিইডি) এখন অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি এখন নিয়মনীতি পরিনত হয়েছে। কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি হলেও শুধু তদন্ত হয় কিন্তু নেয়া হয় না কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাচ্ছে।

 

তথ্যানুসন্ধান ও সরেজমিনে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার ভদ্রাবতী খালের দুই পাশে কৃষি জমির ফসল উৎপাদনের জন্য পানি সেচের আওতায় আনতে ৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা ব্যায়ে ২৭ কিলোমিটার খাল খনন কর্মসূচি নেয় এলজিইডি। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৗশল অধদিপ্তর এলজিইডির তত্ত্বাবধানে লেবার কনটাকটিং সোসাইটি এলসিএস এর মাধ্যমে স্থানীয় সুবিধাভোগী ৪৪টি এলসিএস কমিটির ১১০০জন সদস্যর অংশগ্রহণে কাজটি শেষ করতে হবে। আর শ্রমিকরা মজুরীর পাশাপাশি লাভের ২৫% পাবেন। কিন্তু বাস্তবে চিত্র সম্পূর্ণ ছিলো ভিন্ন।

উত্তর ও দক্ষিণ ভদ্রাবতি মিলে ২৭ কিলোমিটার খাল পুনখননের ৭০ শতাংশ খননের কাজ দেখিয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধদিপ্তরের র্কমর্কতা ও ৪৪টি এলসিএস কমিটির সমিতির সভাপতি সম্পাদকরা। অথচ এলসিএ কমিটির সদস্যদের কেউই জানেন না তাদের নামে কাজ এসেছে বা তাদের নামে মাস্টাররোল দেখিয়ে কাজের টাকাও তুলে নিয়েছে চক্রটি।

এছাড়াও মাস্টাররোলের কারণেই অন্তত ১৩ জন মৃত ব্যক্তি ও ৭জন প্রবাসীর নামেও টাকা উঠেছে। বিষয়টি জানাজানি হবার পর ক্ষুব্ধ হয় সুবিধাভোগীরা। বর্ষার কারণে এখনো ৩০% কাজ বাকী রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ এস্কেবেটর দিয়ে খাল খননও করা হয়েছে নামমাত্র। প্রায় সম্পূর্ণ টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে।

নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী তারেক আজিজের বিরুদ্ধে সরকারী ওই অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠলেও তারা ক্ষমতার জোরে কাজের সাথে জড়িত নন এলজিইডির সিরাজগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী ও তাড়াশ উপজেলা দপ্তরের এমন ৫কর্মকর্তাকে তদন্তের শোকজ করা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে পাবনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম তদন্ত করেছেন। তদন্তে উত্তর ভদ্রাবতী খননে নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, সহকারী প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী তারেক আজিজের বিরুদ্ধে মৃত ও প্রবাসী ব্যক্তিদের নামে টাকা উত্তোলণসহ বিভিন্ন দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উত্তর ভদ্রাবতী খননে ১৬ লক্ষাধিক এবং দক্ষিণ ভদ্রাবর্তী খননে ১৯ লক্ষাধিক টাকা দুর্নীতির কারণে তা দ্রুত সরকারী কোষাগারে ফেরতের সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পাবনা অঞ্চলকে সুপারিশ করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমস্ত কাজ ম্যাকানিক্যাল করা হলে বিল দেখানো হয়েছে ম্যানুয়েল ও ম্যাকিনিকেল সংমিশ্রণে। এর ফলে স্থানীয় দারিদ্র জনসাধারণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে।  

অন্যদিকে গত ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের ঝাঐল-চালা জামে মসজিদ ও বাগবাড়ি কারিগরী কলেজ অভিমুখে গ্রামীণ সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় জরুরী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনটি প্রকল্পের রিকুয়েষ্ট-ফর-কোটেশন (আরএফকিউ)’র জন্য প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮এর ৬৯-৭৩ অনুসরণ আরএফকিউ টেন্ডার করার নির্দেশনা থাকলেও তা করা হয়নি। টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই তরুণ নামে এক ঠিকাদারকে দিয়ে কোরবানির আগে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা ব্যায়ে তিনটি গ্রুপে ‘ইটের হেরিংবোন’ রাস্তা নির্মাণ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী। এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত ওই কাজ নিয়ে এলাকাবাসির অভিযোগও রয়েছে। সম্প্রসারণ কাজের পাশে গত রোজার ঈদের আগে পৃথক কার্পেটিং কাজও করা হয়। সম্প্রসারণ কাজের সময় পুকুরপাড়ে পাইলিং নাদেয়ায় রেলঘুন্টির পশ্চিমে কাজের অংশবিশেষ ধ্বসে গেছে। কিন্তু নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা।

কামারখন্দ উপজেলার প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত মধ্য ভদ্রঘাট কালিবাড়ী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। হস্তান্তরের কয়েকদিনের মধ্যেই বিল্ডিংয়ের চারপাশে ফাটল দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান শামীম বিল্ডার্সের মাধ্যমে কাজ নিয়ে তার পছন্দের লোক কামরুল হাসান তরুণকে দিয়ে কাজটি করিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বিল্ডিংয়ে জাদুঘরের কার্যক্রম শুরুর আগেই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।  

কাজিপুরের মনসুরনগর ইউনিয়ন হয়ে ছালালহাট রাস্তার ৮১ মিটার সেতু। একই উপজেলার সোনামুখী-ভানুডাঙ্গা সড়ক ও সোনামুখী-হরিনাথপুর সড়ক মেরামত এবং সংস্কার কাজ বিগত অর্থবছরে পুরোপুরি শেষ না হলেও রাজশাহী আঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর ‘অনাপত্তি প্রত্যয়ন সনদ ছাড়া’ নির্বাহী প্রকৌশলী সম্প্রতি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে আরও প্রায় ২৭ কোটি টাকার চূড়ান্ত বিল প্রদানের অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে ঠিকাদাররা ২% কমিশন না দিলে নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম কোন বিলে স্বাক্ষর করেন না। বাৎসরিক মোবাইল মেইনটেইনস বাবদ ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। নির্বাহী প্রকৌশলী নামমাত্র কাজ করে পুরো টাকাই তুলে নেন। অফিস মেরামত বাবদ বরাদ্দের টাকাও প্রকৌশলী নিজে তুলে তার সহযোগীদের সাথে ভাগ বাটোয়ারা করে নেন।

প্রকল্পের সোসিওলজিস্ট হেমন্ত কুমার জানান, পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির রেজুলেশনে তার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। অথচ তিনি প্রকল্পের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। নির্বাহী প্রকৌশলী ইচ্ছেমত প্রকৌশলী তারেক আজিজ ও হাফিজুর রহমানকে দিয়ে কাজ করেছেন।  

জন্তিপুর এলসিএস কমিটির সভাপতি মোছা. লিজা বলেন, মানুষ নয়, মেশিন দিয়ে খাল খনন করা হয়েছে। মাষ্টার রোলে স্বাক্ষর করে নিয়ে গেছেন এলজিইডির কমিউনিটি অর্গানাইজার মো. মিজানুর রহমান। অন্য একটি এলসিএস সমিতির সাধারণ সম্পাদক আকলিমা খাতুন জানালেন, মাষ্টাররোল বানানোর বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।

এ বিষয়ে জেষ্ঠ সহ প্রকৌশলী ছাবের আলী বলেন, এলজিইডির উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও  দুদক ভদ্রাবতী খাল খননের নয়-ছয় ও লোপাটের তদন্ত করেছেন। তদন্তে সত্যতা পেয়ে টাকা ফেরতের নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এমনকি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়াও বাকী কাজগুলোর নয়-ছয় বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। অথচ তদন্ত শুরর আগে নির্বাহী প্রকৌশলী অন্যায়ভাবে আমাকে বদলী করেছেন। যারা দায়ি নন, তাদেরও শোকজ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজগঞ্জ এলজিইডি অফিসকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন।  

অভিযোগের বিষয় অস্বীকার করে নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, খাল খননের মাষ্টাররোলে মৃত ও প্রবাসী ব্যক্তিদের নাম রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে।

আর কামারখন্দের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরের বিষয়ে ঠিকাদারের সাফাই গেয়ে তিনি বলেন, ওই ফাটলে বিল্ডিংয়ের কোন ক্ষতি হবে না। তবে ঠিকাদারকে নতুন করে চারপাশে মাটি ভরাট করে ঠিক করার নির্দেশ দেয়া হবে।

ঝাঐল রাস্তার বিষয়ে তিনি বলেন, কোটেশনের মাধ্যমে অর্ডার দেয়া হয়েছে। কামারখন্দের ভদ্রঘাট কালিবাড়ী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘরটি ফাটল ধরেছে। সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে ফাটল ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

news24bd.tv/TR