যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গা নারীরা

রোহিঙ্গা শিবির

যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন রোহিঙ্গা নারীরা

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

অভাবের তাড়নায়, দালালের খপ্পরে পড়ে যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নারী ও কিশোরীরা। আগে থেকেই এ পেশায় জড়িত প্রায় পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী। নতুন আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে ১০ হাজারের মতো নারী ও কিশোরী দালালের মাধ্যমে এ পেশায় ঢুকে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এরইমধ্যে অনেকে গোপনে এই নিষিদ্ধ পথে পা বাড়িয়েছে।

তবে তারা এ কাজ করেন রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরে। এমনকি কোন রোহিঙ্গা পুরুষের শয্যাসঙ্গিনীও তারা হন না। তাই রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে এ ব্যাপারে কিছুই বোঝার উপায় নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে নানাভাবে এই নিষিদ্ধ পথে পা বাড়ানো নারীদের না বলা কথা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শিবিরটি কক্সবাজারের উখিয়ায় অবস্থিত কুতুপালংয়ে। এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ১৯৯২ সালে স্থাপিত এ শিবিরের প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা কিশোরী ও নারী যৌন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নতুন ছয় লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এবার তাদের মধ্য থেকে আরও ১০ হাজার কিশোরী ও নারী এ পেশায় যুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে যৌনব্যবসায় মধ্যস্থতাকারী নূর নামের এক ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্স জানায়, কুতুপালংয়ে কমপক্ষে ৫০০ রোহিঙ্গা নারী আছেন যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এসব নারীর অনেকে বছরের পর বছর ধরে কুতুপালং শিবিরেই আছেন। নিয়োগকারীরা এখন পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গা নারীদের নিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে।  news24bd.tv

এদিকে এক শ্রেণির দালাল নানা ফাঁদে ফেলে, অর্থের লোভ দেখিয়ে রোহিঙ্গা নারীদের নিষিদ্ধ যৌন ব্যবসায় নামাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কেউ আবার অর্থের জন্য নিজেই এ পেশাকে বেছে নিচ্ছেন। কক্সবাজারের একশ্রেণির হোটেল মালিক ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এ সমস্ত রোহিঙ্গা কিশোরীদের নিয়ে যৌন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে। মাঝেমধ্যে এসব রোহিঙ্গা কিশোরীরা পুলিশের হাতে আটক হলেও পেশাদার দালালদের সহযোগিতায় তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো যৌন ব্যবসায় লিপ্ত হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌনকর্মে রোহিঙ্গা নারীরা কোন ধরণের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মারাত্মক সব যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়দের মতে, এসব রোহিঙ্গা নারীদের অধিকাংশই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার। তাই এসব নারীদের যৌন পেশায় নামানো অনেকটা সহজ। সেই সুযোগ নিচ্ছে দালালরা। তার উপরে দারিদ্র রোহিঙ্গাদের অন্যতম সমস্যা। তাই অর্থের জন্য অনেকে নিজ ইচ্ছায়ই যৌন ব্যবসায় নামছে। আর পর্যটন এলাকা কক্সবাজার কাছেই থাকায় অনেক মেয়ে এখানকার হোটেলগুলোতে গিয়ে গোপনে যৌন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার তাদেরকে এক জায়গায় রাখার চেষ্টা করলেও এত মানুষকে কোনভাবেই এক জায়গায় আটকে রাখা সম্ভব না। তারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এসব রোহিঙ্গা নারীরা দেশের অন্য এলাকাগুলোতে গিয়ে ভাষার কারণে অনেক সময় ধরা পড়লেও চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে তাদের মিল থাকায় সহজেই তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

গেল বছর ঢাকার সূত্রাপুর থানায় কুতুপালং শিবিরের ডাকাত সর্দার নুরুল হক মাঝির মেয়ে ফাতেমা বেগম ৫/৬ জনের একদল কিশোরী নিয়ে পুলিশের হাতে হোটেলে রাত কাটানোর সময় আটক হয়। নিজেকে হাবিব বলে পরিচয় দেওয়া এক রোহিঙ্গা পুরুষ বলেন, অনেক বছর ধরে তিনি কুতুপালংয়ে আছেন। গত কয়েক বছরে কুতুপালং থেকে অনেক কিশোরী নিখোঁজ হয়েছে। তার মধ্যে অনেক মেয়ের বয়স ১০ বছরের কম। গার্মেন্টে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাচারকারীরা রোহিঙ্গা কিশোরীদের যৌনপল্লীতে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন শহরে গিয়ে ভাসমান যৌনকর্মী হচ্ছেন। যৌন পেশায় জড়িয়ে পড়া এক রোহিঙ্গা নারী।  ছবি- রয়টার্স

এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে কথোপকথনে এক তরুণী জানান, ‘যখন আমি দেখলাম আমি ক্ষুধার্ত তখন কেবল এটাই ছিল আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ’

প্রথমবার এক বাংলাদেশি ‘বন্ধু’র সঙ্গে এক হাজার টাকার বিনিময়ে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হন তিনি। তবে টাকার এই পরিমানটা ক্রমেই কমে আসে। এখন সাধারণত ২০০ টাকার বিনিময়ে কাজ করতে হয় তাদের, যার অর্ধেকটা নিয়ে নেয় দালাল।

ওই নারী জানান, প্রথমবার অনেক ভাল পরিমাণে টাকা পেলেও এখন কম পান। গড়ে প্রতি সপ্তাহে তিনজন খদ্দেরের সঙ্গে মিলিত হন। মাঝে মাঝে আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া কিংবা মার্কেটে যাওয়ার কথা বলে কক্সবাজারেও যান। আর তাদের খদ্দের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনীতিক পর্যন্ত।  

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরের অধিকাংশ পুরুষ জেলে পেশায় জড়িত। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে সপ্তাহ ও পনের দিন সাগরেই কেটে যায়। এ সুযোগে রোহিঙ্গা যুবতি, কিশোরী ও গৃহবধূরা জড়িয়ে পড়ে দেহ ব্যবসায়। বহদ্দার নামধারী বেশ কিছু নারী লিপ্সু ব্যক্তি ও কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও রোহিঙ্গা নারীদের নিয়ে রাত দিন ব্যস্ত থাকে। তারা এসব নারীদের পল্লী থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে নানাভাবে। কখনো দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে, কখনো লোভ দেখিয়ে, কখনো ভয় দেখিয়ে বা ফাঁদে ফেলে। এরপর এসব নারীদের কাউকে একবারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে যৌন পল্লীতে, যে নারীদের আর খোঁজ মিলছে না। আবার কাউকে দিয়ে নিয়মিত দেহ ব্যবসা করিয়ে কমিশন খাচ্ছে এই অসাধু লোকগুলো।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপচে পড়া আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা নারীরা যখন খাদ্য, পানিসহ মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য মরণপণ লড়াই করছেন, তখন তাদের নগদ অর্থের লোভ দেখিয়ে যৌন ব্যবসায় নামানো হচ্ছে। এমনই একটি ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।  

বলা হয়েছে, মাটির পরিচ্ছন্ন একটি ঘরে প্রবেশ করলেন চারজন নারী। তাদের শরীরে জড়ানো কালো চাদর। এসে বসলেন মেঝেতে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হলো, তারা অর্থের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করেন কিনা। এ প্রশ্ন যেন তাদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দিল। তারা নীরব হয়ে গেলেন। চলছে চা পান পর্ব। চা পানের পর আবার প্রশ্নোত্তর শুরু। ওই যুবতীরা একে অন্যের চোখের দিকে তাকাতে লাগলেন। ধীর পায়ে তাদের একজন ঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলেন দরজা বন্ধ করতে। আরেকজন বন্ধ করলেন জানালা। ছোট্ট, স্যাতসেতে ঘরে মুহূর্তে নেমে এলো অন্ধকার। ঠিক যেন রাতের পরিবেশ। এতে নিষিদ্ধ কথার পরিবেশটা যেন একটু সহজ হলো। এর মাঝেই ফিসফিসিয়ে কথা চলতে লাগলো। ২৬ বছর বয়সী রমিজা বললেন, যদি কেউ আমাদেরকে এখানে দেখতে পায় তাহলে মেরে ফেলবে।

এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া রমিজা (ছদ্মনাম) বলেন, এ ব্যবসার যারা হর্তাকর্তা তারা নতুন আসা যুবতীদের দিকে নজর দিয়েছে এখন। তাদেরকে এ ব্যবসায় নিয়োগ করার চেষ্টা করছে। তবে কতজন যুবতী বা নারী এ ব্যবসায় এ পর্যন্ত জড়িয়ে পড়েছেন সে হিসাব নেই জাতিসংঘের কোনো এজেন্সির কাছে।  

ইউএনএফপিএ’র বিশেষজ্ঞ সাবা জারিফ বলেন, সংখ্যায় তাদের কতজন এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে তা বলা কঠিন। এসব আশ্রয় শিবিরে কতজন যৌনকর্মী আছেন সে বিষয়ে আমরা এখনো ডাটা সংগ্রহ করিনি।  

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলেছে, বিশৃঙ্খল, এলোমেলো ক্যাম্পগুলোতে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়তে পারে শিশু ও যুবক, যুবতীরা। তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করা হতে পারে।  

এদিকে দালাল নূরের সঙ্গে রয়টার্সের কথপোকথনে বেরিয়ে এসেছে হাঁড়ির খবর। তিনি বলেন, বাইরে থেকে মানুষ মনে করবে এখানে এমন কোনো ব্যবসা হয় না। কারণ, আশ্রয় শিবিরের বাইরে খদ্দেরের সঙ্গে মিলিত হন যুবতীরা। তারা রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কারো শয্যাসঙ্গীনি হন না। এর মধ্য দিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে তারা নিজেদেরকে ‘পিওর’ হিসেবে দেখাতে চান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছে যারা তার বেশির ভাগই কিশোরী। দিনে তারা একবারের বেশি খাবার পায় না। স্কুলে যায় না। তারা এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে গোপনে, তাদের পিতামাতারও অজ্ঞাতে।  

এমনই একজন কিশোরী রিনা (ছদ্মনাম)। গত এক দশক ধরে তিনি বসবাস করছেন এই আশ্রয়শিবিরে। দু’ বছর আগে তাকে মাদকাসক্ত এক ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। রিনা এ সম্পর্কে বলেন, স্বামী আমার সঙ্গে ভীষণ খারাপ আচরণ করেন। মারপিট করেন। প্রথম ছেলে জন্ম হওয়ার পর তিনি আমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এখন ওই সন্তানের ভরণ-পোষণ আমার কাছে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাই আমি যৌনকর্মী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছি। ১৬ বছর বয়সে আমি এমন কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ি। তখন আমার অর্থের খুব দরকার। যৌন পেশা ছাড়া সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।

সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে প্রায় চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে অবস্থান করছে। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশে একাধিক আশ্রয়শিবির স্থাপন করা হয়েছে। আর এসব শিবিরে গোপনে রমরমিয়ে চলছে যৌনব্যবসা।

সম্পর্কিত খবর