আবারও রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর, যা যা ঘটলো সারাদিনে...

সংগৃহীত ছবি

আবারও রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর, যা যা ঘটলো সারাদিনে...

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০০৬ সালের ভয়াল ২৮ অক্টোবরের পর চলতি বছরের এই দিনটিতেও রাজনৈতিক সংঘাতে আবারও রক্ত ঝরলো রাজপথে। শনিবার ঢাকায় বিরোধী পক্ষের সমাবেশের দিনে রাজপথে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। আজকের দিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে আশঙ্কা ছিল জনমনে। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নজর আছে- এই বিবেচনায় অনেকেই আশা করেছিলেন এই দফায় ২৮ অক্টোবর ব্যতিক্রমী কিছু হবে।

কিন্তু নানা নাটকীয়তাসহ দিনের শুরুটা ভালো হলেও ত্রিমুখী সংঘর্ষে শেষ পর্যন্ত রক্ত ঝরলো। নিহত হয়েছেন এক যুবদল নেতা ও পুলিশ সদস্য। আহত হয়েছেন পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মীসহ অনেকে।

কয়েকদিনের নাটকীয়তার পর শুক্রবার নয়াপল্টনে বিএনপি ও বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ সমাবেশ করার অনুমতি পায়।

অনুমতি না পেয়েও শাপলা চত্বরেই সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় জামায়াতও।

২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘাতে কর্মী হারানো জামায়াত ইসলামী অনুমতি ছাড়া সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। আবারও রাজনৈতিক সংঘাতের শঙ্কায় চলতে থাকে নানা জল্পনা-কল্পনা। কিন্তু এ দিন জামায়াতের সমাবেশ বড় ধরনের কোনো সংঘাত ছাড়াই শেষ হয়।

সকালে বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, বিকেলে রক্তক্ষয়ী সংঘাত

শনিবার (২৮ অক্টোবর) ভোর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের ঢল নামে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী জড়ে হন। দুপুরের আগ পর্যন্ত নয়াপল্টনে শান্তিপূর্ণভাবে বিএনপির সমাবেশ চলে। এ সমাবেশের সীমা ছাড়িয়ে যায় ফকিরাপুল, বিজয়নগর ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত।

দুপুরে পর কাকরাইল মোড়ে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। কাকরাইল মোড় দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যাওয়ার সময় বিএনপি কর্মীরা ধাওয়া দিলে সংঘর্ষ শুরু হয়।

এ সময় বিএনপি কর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায়। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অগ্নিসংযোগ করে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা কাকরাইল ছেড়ে গেলেও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের।

পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। গোটা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরে বিজিবি মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে প্রশাসন।

পল্টনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া

কাকরাইল মোড়ের সংঘর্ষের উত্তাপ পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। বিএনপি নেতাকর্মীরা নাইটিংগেল মোড় থেকে পুরানা পল্টন পার হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট থেকে পুরানা পল্টনে আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় দফায় দফায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা পিছু হটেন। কিন্তু সারাদিন এই পথে ছিল চরম উত্তেজনা।

এক পুলিশ নিহত, আহত ৪১

বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্য নিহত

বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। এছাড়া ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হন বলে জানায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।

যুবদল নেতা নিহত


নয়াপল্টনে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের গুলিতে শামীম মোল্লা নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। দুপুরে নয়াপল্টনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। নিহত শামীম মোল্লা মুগদা থানা যুবদলের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক নম্বর ইউনিটের সভাপতি। তার বাবার নাম ইউসুফ মোল্লা। সংঘর্ষে আহত হলে তাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সন্ধ্যার দিকে শামীম মোল্লা মারা যায় বলে নিশ্চিত করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদ।

হাসপাতাল-গাড়িতে আগুন

সংঘর্ষ চলাকালে বিএনপি ও জামায়াত কর্মীরা পুলিশ হাসপাতালে আগুন দেয় বলে দাবি করেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন। পুলিশ হাসপাতালে অগ্নি সংযোগের ঘটনায় ৭টির মতো গাড়ি পুড়ে যায়। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, বিআরটিসি, বলাকা বাসসহ কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় দুষ্কৃতিকারীরা।

পাঁচ সাংবাদিক আহত

পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাজধানীর কাকরাইলে হামলার শিকার হন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত পাঁচজন সাংবাদিক। কাকরাইলে হামলায় আহত হন পলিটিক্যাল নিউজ বিডি অনলাইনের মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্ট মারুফ হাসান, বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জাফর আহমেদ, দৈনিক কালবেলা পত্রিকার রাফসান জানি ও দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার এক সাংবাদিক। এছাড়াও রাজু আহমেদ নামে আরও এক সাংবাদিকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সকালে গরম বিকেলে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ জামায়াতের


সকাল সাতটা নাগাদ নানা কৌশলে ফকিরাপুল-আরামবাগে জড়ো হতে থাকে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা শাপলা চত্বরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেয় পুলিশ। পরে জামায়াত কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে আরামবাগে অবস্থান নেয় এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে সবচেয়ে বেশি উত্তাপ ছড়ানো বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী। সমাবেশ করতে দেওয়ায় সমাবেশ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদও জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগের সমাবেশ

বিএনপি-জামায়াতের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।

হরতাল বনাম শান্তি সমাবেশ


সমাবেশে পুলিশি বাধার অভিযোগ এনে বিএনপি রোববার সারাদেশে হরতালের ডাক দিয়েছে। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে আওয়ামী লীগও সারাদেশে শান্তি সমাবেশের ডাক দেয়। রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। শনিবার অবৈধ সরকারের পদত্যাগ, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন, সংবিধান সংস্কার করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এদিকে  হরতালের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতও।

বাসে আগুন


এ দিন রাজধানীতে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে কাকরাইল, মালিবাগ ও কমলাপুরে এসব ঘটনা ঘটে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সময়ে কমলাপুরে বিআরটিসির একটি বাসেও আগুন দেওয়া হয়। তবে কে বা কারা এ আগুন দিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর
প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলাকে নজিরবিহীন ঘটনা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

নিউজ টোয়েন্টিফোরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুর চালিয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের গেট ভেঙে তারা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য সমাবেশ শুরুর আগে সকাল থেকেই তারা সংঘর্ষ শুরু করে। এরপর তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়।  

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাড়িতে হামলা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে। সমাবেশ পণ্ড করা হয়েছে বিএনপির এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। যারা আজকে সমাবেশের নামে হামলা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে জানান তিনি।

র‌্যাব যা বলছে

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করা হচ্ছে। শনিবার বিকেলে এ কথা জানান তিনি।

খন্দকার মঈন বলেন, ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ কেন্দ্র করে কতিপয় দুষ্কৃতিকারী ও স্বার্থান্বেষী মহল রাজধানীর কাকরাইল, নয়াপল্টন, মতিঝিল ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী হামলা ও আক্রমণ চালিয়েছে।

তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। তারা প্রধান বিচারপতির বাড়িতেও হামলা চালায়। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা ও আক্রমণ চালায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাদের হামলায় আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত হন। সন্ত্রাসীরা রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে হামলা করে ও অ্যাম্বুলেন্সে অগ্নিসংযোগ করে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাড়িতেও হামলা করে।

এই কর্মকর্তা বলেন, যে সব সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমকর্মীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা ও আক্রমণ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত ছিল তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ করছে র‌্যাব।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বার্তা

ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে তার নিন্দা জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শ‌নিবার (২৮ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে এ নিন্দা জানায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।

দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার নিন্দা জানায়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রাজনৈতিক কর্মী হত্যা এবং একটি হাসপাতাল পোড়ানোর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও তেমনই।

বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য আমরা সব সহিংস ঘটনা পর্যালোচনা করবো। মার্কিন দূতাবাস সব পক্ষকে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানিয়েছে।

রাতেই বিজিবি মোতায়েন
বিএনপির সঙ্গে পুলিশের কাকরাইল ও পল্টন এলাকায় সংঘর্ষের পর হরতালের ডাক দিয়েছে দলটি। এ অবস্থায় রাত থেকেই রাজধানীতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

শনিবার (২৮ অক্টোবর) রাতে বিজিবি সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, নিরাপত্তার স্বার্থে রাত থেকে রাজধানীতে ১১ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এদের মধ্যে রমনায়-১, মতিঝিল-২ ও পল্টনে-২ প্লাটুন বিজিবি টহলে থাকবে। সচিবালয়ে-২ ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
news24bd.tv/aa