মহাকাশ স্টেশনটি ধ্বংস করা কেন জরুরি, খরচ ১ বিলিয়ন ডলার!

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস।

মহাকাশ স্টেশনটি ধ্বংস করা কেন জরুরি, খরচ ১ বিলিয়ন ডলার!

অনলাইন ডেস্ক

মহাকাশে গত ২৫ বছর নভোচারীদের আবাসস্থল এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার একমাত্র কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাজ করছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস। ১৫ বছর স্থায়ীত্বকালের এই ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ও এর বেশিরভাগ যন্ত্রাংশের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে প্রায় এক দশক আগে। তাই মানবজাতির পক্ষ থেকে গৌরবের প্রতীক এই স্থাপনাটিকে বিদায় দেয়া এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্টিফিক আমেরিকানে প্রকাশিত প্রবন্ধে এমনটি উঠে এসেছে।


   
এটি ধ্বংসের সময় যেকোন ধরনের বিপর্যয় ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পরিকল্পনা নিয়েছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনটিকে এর নিজস্ব কক্ষপথ থেকে নামিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়ে মহাসাগরে ধ্বংস করা হবে। প্রশান্ত মহাসাগরে নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আমেরিকার মাঝখানে ‘পয়েন্ট নেমো’ নামের জায়গায় শেষ ঠিকানা হবে স্টেশনটির। এ জায়গাটিকে প্রায়ই মহাকাশযানের কবরখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জায়গাটি মানুষের বসতি থেকে অনেকটা দূরে এবং এখানকার পানিতে সামুদ্রিক প্রাণীও খুবই কম।

বিশেষ মহাকাশযান `স্পেস টাগ` ব্যবহার করে আইএসএসকে ঠেলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে আসা হবে। এমন একটি যান তৈরি করতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার খরচ হবে। এমনটি জানিয়েছেন নাসার হিউম্যান স্পেসফ্লাইট কর্মসূচির প্রধান ক্যাথি লুডার্স। এই কাজে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে একটি যথাযোগ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খুঁজতে দরপত্র আহ্বান করবে নাসা। আগামী দশকের শুরুতে এটিকে স্পেস টাগ দিয়ে টেনে নামানোর কাজটি সম্পন্ন হবে।  

১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করা এই আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনটি আকারে ফুটবল মাঠের সমান। ৪০০ মেট্রিক টনের বেশি ভরবিশিষ্ট আইএসএস ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৫০ মাইল উপর দিয়ে পৃথিবীকে ঘণ্টায় ২৮ হাজার ৯৮০ কিলোমিটার গতিতে প্রদক্ষিণ করছে। এটি তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। আইএসএস-এর রক্ষণাবেক্ষণে বছরে খরচ হয় তিন বিলিয়ন ডলার।

গত ২৫ বছর এটি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। প্রথম সেখানে নভোচারীরা থাকতে যান ২০০০ সালে। তারপর থেকে ২০টি দেশের আড়াইশো’রও বেশি নাগরিক সেখানে থেকেছেন। এ যেনো মহাকাশে নভোচারীদের একমাত্র বসতি।
 
এই মহাকাশ স্টেশনকে মানবজাতির বিজ্ঞান গবেষণায় এক বিরাট সাফল্য উল্লেখ করে ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা ইএসএ’র প্রধান জোসেফ এ্যাশবাকার বলেন, আইএসএস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতারও একটি কেন্দ্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। স্নায়ূযুদ্ধকালীন দীর্ঘ দ্বন্দ্বের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের এ প্রকল্পে যোগ দেয় রাশিয়া।

আইএসএসের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি এখন কয়েক দশকের পুরোনো হয়ে গেছে। এর ফলে ভবিষ্যতে এই স্টেশনটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, এমনকি সঠিক কক্ষপথে রাখার জন্য তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। তাই যেকোন বিপর্যয় ঠেকানোর জন্যই নাসা পরিকল্পনা করেছে, আগামী ২০৩১ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনকে ‘ডি-অরবিট’ করা হবে অর্থাৎ কক্ষপথ থেকে নামিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে টেনে আনা হবে। এবং এটিকে নিরাপদে মহাসাগরে আছড়ে ফেলা হবে।

এখন পর্যন্ত যত মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরে এসেছে সেগুলোর মধ্যে এটিই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বিশাল। তবে নিরাপদে কীভাবে অতি উচ্চ গতির আইএসএসকে এর কক্ষপথ থেকে বের করে আনা হবে তা এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ।

এর আগে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢোকার সময়ই কয়েকটি মহাকাশযান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ২০০১ সালে রাশিয়ার মির স্পেস স্টেশন এবং ১৯৭৯ নাসার স্কাইল্যাবের ভাগ্যে তাই ঘটেছিল।

মহাকাশ স্টেশনটিকে ধাপে ধাপে কক্ষপথ থেকে নামিয়ে আনার কাজটা শুরু হবে ২০২৬ সালে। প্রথমে এটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছুটা নিচে নেমে আসতে দেয়া হবে। বর্তমানে এটা আছে ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৫০ মাইল ওপরে, আর ২০৩০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এটা নেমে আসবে ২০০ মাইল উচ্চতায়। এই পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অপেক্ষাকৃত ঘন গ্যাসের স্তরে ঢুকে পড়লে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে এর গতি কিছুটা বেড়ে ঘণ্টায় হবে ২৯ হাজার কিলোমিটার। এ পর্যায়ে প্রথমেই আইএসএসের সোলার প্যানেলগুলো মূল অংশ থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

৫০ মাইল উচ্চতায় নেমে এলে আইএসএস-এর মূল মডিউলগুলো আলাদা হয়ে যেতে শুরু করবে। তখন এগুলোর তাপমাত্রা হবে কয়েক হাজার ডিগ্রি। এই প্রচণ্ড গতি ও তাপে এগুলো গলে যাবে অথবা টুকরো টুকরো হয়ে তাতে আগুন ধরে যাবে।

রুশ স্পেস স্টেশন মিরকে যখন নামিয়ে আনা হয় সেই দৃশ্য টেলিভিশনের দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিল। মিরের ওজনের চেয়ে আইএসএস তিন গুণ ভারী। তাই আইএসএসের পৃথিবীতে ফেরার দৃশ্য হবে আরো অনেক বেশি চমকপ্রদ, যা দেখতে মুখিয়ে থাকবে গোটা বিশ্ববাসী।

এদিকে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের উত্তরসূরি কী হচ্ছে যা নিয়ে কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। জানা গেছে, আইএসএস-এর বিকল্প হিসেবে পৃথিবীর কক্ষপথে নতুন একাধিক বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করা হবে। নাসা ইতোমধ্যে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে মানুষ পাঠানোর কাজ স্পেসএক্স ও বোয়িং-এর মতো শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিয়েছে। নতুন মহাকাশ স্টেশন তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে যাচ্ছে মার্কিন সংস্থাটি। এসব স্টেশনগুলো হতে পারে ছোট ছোট গবেষণাগার অথবা মহাকাশ পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে বানানো গন্তব্য।

এসব প্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে অ্যাক্সিওম স্পেস। এটি ইতোমধ্যে স্পেসএক্স-এর রকেট ব্যবহার করে নিজেদের বেতনভুক্ত নভোচারীদেরকে কক্ষপথে পাঠাতে শুরু করেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এটি আইএসএস-এ নিজেদের মডিউল সংযুক্ত করার আশা করছে। তেমনটা হলে এ মডিউল পরে আবার খুলে নিয়ে আলাদাভাবে মহাকাশ স্টেশন হিসেবে রূপ দেয়া যাবে।  

news24bd.tv/AA