হাজার বছরে পবিত্র মসজিদুল আকসার সংস্কার কার্যক্রম

সংগৃহীত ছবি

হাজার বছরে পবিত্র মসজিদুল আকসার সংস্কার কার্যক্রম

 আমজাদ ইউনুস

মুসলিম শাসনামলে মুসলিম শাসকদের মসজিদুল আকসার প্রতি বিশেষ মনোযোগ ছিল। যখন মসজিদুল আকসার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হতো তখন তাঁরা এগিয়ে আসতেন। নিচে বিভিন্ন শাসনামলে মসজিদুল আকসার সংস্কারের ইতিহাস তুলে ধরা হলো :

ফারুকির শাসনামল

১৪ হিজরিতে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় করেন। অতঃপর উমর (রা.)-এর নির্দেশে কুব্বাত আস সাখরা থেকে ময়লা-আবর্জনা সরানো শুরু হয়।

তিনি নিজেই এই মহৎ কাজ শুরু করেন। নিজ চাদর বিছিয়ে তাতে ময়লা-আবর্জনা উঠাতে থাকেন। অন্য সাহাবিরাও এতে অংশগ্রহণ করেন। এভাবেই এই জায়গা পবিত্র করা হয়।


অতঃপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের পাশে একটি ছোট মসজিদ নির্মাণ করার নির্দেশ দেন, যা আজও মসজিদে উমর নামে প্রসিদ্ধ।

উমাইয়া শাসনামল

উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান (৬৫ থেকে ৮৬ হিজরি) ওমরের যুগে প্রতিষ্ঠিত মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেন এবং এর উত্তর দিকে একটি গম্বুজ নির্মাণের নির্দেশ দেন। গম্বুজটিকে একটি প্রাসাদের মতো করে নির্মাণ করা হয়। তার চারটি গেট বানানো হয়।

ছাদে শাল কাঠের ৬০ হাজার টুকরা দিয়ে কারুকার্য করা হয়। এক হাজার প্রদীপ দ্বারা আলোর ব্যবস্থা করা হয়।
মসজিদে আকসার হারামের জন্য ২০টি দরজা বানানো হয়। ভেতরে আলোর জন্য পাঁচ হাজার বাতি যুক্ত করা হয় এবং ৫০টি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। তিনি মারা যাওয়ার সময় নির্মাণকাজ অসম্পূর্ণ ছিল।

তাঁর পুত্র ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক অত্যন্ত সুন্দরভাবে সোনালি গম্বুজের নির্মাণকাজ শেষ করেন। এখনো এটি ইসলামী স্থাপত্যের বিরল রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়।

আব্বাসীয় শাসনামল

আব্বাসীয় শাসনামলে একটি মারাত্মক ভূমিকম্প হয়। এতে  আল-আকসা মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম অংশগুলো ভেঙে পড়ে। আবু জাফর মনসুর মসজিদের দরজায় মোড়ানো সোনা ও রুপার টুকরাগুলো বিক্রি করেন এবং তা দিয়ে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। তবে ১৫৮ হিজরিতে আবার ভূমিকম্প হয়। তখন তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সময় খলিফা ছিলেন মাহদি। তিনি নিজেই বায়তুল মুকাদ্দাসে যান। ১৬৩ হিজরিতে তিনি মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করেন।

ফাতিমি শাসনামল

৪০৬ হিজরিতে আল হাকিম বিআমারিল্লাহর শাসনকালে একটি বড় ভূমিকম্প হয়। এর ফলে মসজিদুল আকসা ও কুব্বাত আস সাখরার অনেক অংশ মাটি থেকে পড়ে যায়। ৪১২ হিজরিতে আজ জাহির খলিফা ছিলেন। তিনি তাঁর উজিরকে মসজিদের পতিত অংশ পুনর্নির্মাণ এবং ফাটা দেয়াল মেরামত করার নির্দেশ দেন। তিনি নির্মাণ ও মেরামতের কাজ পরিচালনা করেন এবং এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের দুটি বারান্দা ভেঙে মসজিদটিকে আরো ছোট করেন। ৪২৫ হিজরিতে আরেকটি ভূমিকম্প হলে ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো সংস্কার করা হয়। একইভাবে খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ ৪৪৮ হিজরিতে মসজিদে আকসার উত্তর দেয়াল এবং ভাঙা অংশগুলো পুনর্নির্মাণ করেন।

আইয়ুবি শাসনামল

সুলতান সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি ৫৮৩ হিজরির ২৬ রজব ক্রুসেডারদের হাত থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করেন। অতঃপর ডোম অব দ্য রকের মূর্তি ও ক্রুশ ভেঙে ফেলা হয় এবং মসজিদের আসল ইসলামিক রূপ ফিরিয়ে আনা হয়। তারপর আল-আকসা মসজিদের জন্য নূরুদ্দীন জাঙ্গি দ্বারা নির্মিত মিম্বরটি আল-আকসা মসজিদে আনা হয়েছিল এবং মসজিদের মিহরাবের কাছে স্থাপন করা হয়েছিল।

মামলুক শাসনামল

৬৬১ হিজরিতে মামলুক সুলতান আল-জাহির আল-আকসা মসজিদের ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশগুলো পুনর্নির্মাণ করেন। একটি সরাইখানাও তৈরি করেন, যেখানে প্রচুর বণিক থাকতেন। তারপর তিনি মসজিদের আশপাশের বেশির ভাগ সম্পত্তি আল-আকসা মসজিদে উৎসর্গ করেন, যার আয় ভ্রমণকারী ও অভাবীদের সাহায্য করার জন্য ব্যয় করা হতো। তিনি মসজিদুল আকসার ব্যয়ের জন্য পাঁচ হাজার দিরহামের বার্ষিক বাজেটও অনুমোদন করেন। এ ছাড়া মামলুক শাসনামলে মসজিদুল আকসার অভ্যন্তরে মাদরাসা তানকাজিয়া, বাব আল-আসবাতের ওপর একটি মিনার, একটি জলের ফোয়ারা এবং বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত মিম্বারও তৈরি করেছিলেন।

উসমানি শাসনামল

খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে উসমানি শাসনামলে পাঁচজন সুলতান আল-আকসা মসজিদের নির্মাণ ও অলংকরণে বিশেষ মনোযোগ দেন। বায়তুল মাকদিসের বাইরের চার দেয়াল নতুনভাবে নির্মাণ করেন। মসজিদের জানালায় রঙিন কাচ স্থাপন করা হয়। সুন্দর কার্পেট বিছানো হয়েছিল, রুপার মোমবাতি স্থাপন করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল এবং পুরনো রাস্তাগুলো নতুন করে তৈরি করা হয়।

ব্রিটিশ শাসনামল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) পর জেরুজালেম শাসনের অস্থায়ী কর্তৃত্ব ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তখন একটি উচ্চ তত্ত্বাবধায়ক কমিটি ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আল-আকসা মসজিদের সুরক্ষার জন্য দায়িত্ব পালন করেছিল এবং যখন পুনর্নির্মাণের কাজ প্রয়োজন হতো তখন তারা গুরুত্বের সঙ্গে তা সম্পন্ন করত।

ইহুদিবাদী শাসনামল

১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের অভ্যুদয়ের পর প্রাচীন জেরুজালেম জর্দানের হেফাজতে আসে। তখন মুসলমানদের তত্ত্বাবধানে আল-আকসা মসজিদের নির্মাণ ও সংস্কার চলতে থাকে। ১৯৫২ সালে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার জর্দানিয়ান দিনার খরচ করে এটির অনেক অংশ নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। ১৯৫৬ সালে অনেক সৌদি ঠিকাদারও নির্মাণ ও সংস্কারকাজ করেছিলেন।

তবে ১৯৬৭ সালে ইহুদিরা পুরো জেরুজালেম দখল করে এবং নির্মাণ ও মেরামতের কাজে বাধা দেয়। আল-আকসা মসজিদ ধ্বংস করার লক্ষ্যে এটির চারপাশে গর্ত ও পরিখা খননের কাজ শুরু হয়। তারপর ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে ইহুদিরা আল-আকসা মসজিদে আগুন দেয়, যা মসজিদের ব্যাপক ক্ষতি করে, মিম্বর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মসজিদের দক্ষিণ অংশ, যেখানে উমর (রা.)  মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, সেটিও পুড়ে যায়।  

লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক

এই রকম আরও টপিক