দামি গণতন্ত্র ডামি প্রার্থী ও গ্রাহকতন্ত্র

সংগৃহীত ছবি

দামি গণতন্ত্র ডামি প্রার্থী ও গ্রাহকতন্ত্র

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি 

প্রিয় পাঠক, যখন এ লেখা পড়ছেন, ততক্ষণে ঘটনাবহুল নভেম্বর বিদায় নিয়েছে। প্রতি বছর নভেম্বরে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের কারণে সুপ্রসিদ্ধ স্ট্রাসবার্গ শহরে বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান গণতন্ত্রের জটিল সমীকরণ ও ঝুঁকি নিয়ে বিতর্ক এবং আলোচনার জন্য বিভিন্ন দেশের নানা শ্রেণি-পেশার নেতারা সম্মেলন করে থাকেন। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক অঙ্গন, ব্যবসায়ী সংগঠন, শিক্ষাঙ্গন, গণমাধ্যম ও পেশাজীবী সংগঠনের জাঁদরেল নেতাদের কথা, বক্তৃতা, তর্ক-বিতর্কে জমজমাট হয়ে ওঠে এ সম্মেলন।

২০২২ সালের ৭ থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এমন এক সম্মেলনে আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সায়মন কোভনে এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন।

তার মতে, ‘অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের মধ্যে গণতন্ত্র বাইরে (বহির্বিশ্ব) থেকে এবং আরও ক্ষতিকারকভাবে ভিতর (দেশ) থেকে ক্রমাগতভাবে আক্রমণের মুখে পড়েছে। আমাদের মহাদেশে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ও স্বাধীনতার সুরক্ষার জন্য গ্রহণীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো : কীভাবে আমরা আমাদের সরকারি (সাংবিধানিক) প্রতিষ্ঠানের অখণ্ডতা রক্ষা করি; আমরা কীভাবে আমাদের নাগরিকদের সমৃদ্ধি প্রচার করি; গণতন্ত্রে গণদেবতাদের (ডেমোস) তথা জনগণকে আমরা কীভাবে বুঝি। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের চেয়ে আরও বেশি কিছু দাবি করে। অবাধ নির্বাচনের ভিত্তি, কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য আইনের নিরপেক্ষ শাসন এবং সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন।
গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য আমাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সভা-সমাবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এর অর্থ স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দক্ষ বিচার বিভাগকে উন্নীত করা। এর অর্থ আমাদের নির্বাচনব্যবস্থার অখণ্ডতা নিশ্চিত করা। ’

গণতন্ত্রের মূল্য প্রসঙ্গে ৩টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র আমাদের বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ধাতু, কিন্তু যদি যত্ন না করা হয় তবে এটি সহজেই কলঙ্কিত হয়। একটি মুক্ত সংবাদপত্র ছাড়া, একটি সুশীল সমাজ ছাড়া, স্বাধীন আদালত ছাড়া এটি সময়ের সঙ্গে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং অবশেষে ভেঙে পড়ে। ইউরোপের কাউন্সিল এ-সংক্রান্ত যে নীতিমালা প্রণয়ন করে, তার প্রতি আমাদের বারবার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে এবং তার মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোপরি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতকে পুনঃআবিষ্কার করে তার প্রতি আমাদের অবশ্যই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। ’ ভোট প্রসঙ্গে তার মত, ‘গণতন্ত্র (নাগরিকদের) মর্যাদা প্রদান করে। ভোট এবং কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে যে কোনো নাগরিক পরিবর্তন আনতে পারে। গণতন্ত্রে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা নাগরিকদের দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি প্রদানের সর্বজনীন পন্থা। গণতন্ত্র নিখুঁত (শুদ্ধতা) থেকে অনেক দূরে হলেও গণতন্ত্রই আমাদের সবার স্বার্থ রক্ষা করার সর্বোত্তম উপায়। ’

নাগরিক ও তরুণদের প্রতি করণীয় বিষয়ে তার চাওয়া ‘স্বল্পমেয়াদের মধ্যেই আমরা কী করার সক্ষমতা রাখি-এ বিষয়ে আমাদের নাগরিকদের, বিশেষ করে তরুণদের বোঝাতে হবে। এ সক্ষমতার মূল চাবিকাঠি হলো শাসনের মান উন্নত করা, যার একটি ধাপ হলো আমাদের নাগরিকদের কথা শোনা, সর্বোপরি তরুণদের কথা। গত এক দশকে নাগরিক সমাজের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ইতিবাচক। এটি গণতান্ত্রিক সম্পৃক্ততাকে আরও গভীর করার একটি উপায় প্রমাণ করেছে মানবাধিকার এবং আইনের শাসন গণতন্ত্রের সুনির্দিষ্ট শর্ত, যা লোকেরা বোঝে কিন্তু ইউরোপীয় কাউন্সিলের ৬৭৫ মিলিয়ন নাগরিকদের বেশির ভাগের জন্য সেগুলো কিছুটা বিমূর্ত ধারণা। একটি নতুন প্রজন্মকে তাদের মূল্য বোঝাতে আমাদের অবশ্যই আলাদাভাবে যোগাযোগ করতে হবে। ’
দেশ যখন গণতন্ত্রের এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, তখন দুটি শব্দ বেশ সাড়া জাগিয়েছে। একটি শব্দ হলো ‘থাবা’ যা উচ্চারণ করেছেন সাংবিধানিকভাবে এ সময়ে রাষ্ট্রের অন্যতম ব্যক্তিই কেবল নয়, অন্যতম ও ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। এ থাবা বলতে নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপকেই বোঝানো হয়েছে। যুগে যুগে আমরা এই থাবার শিকার হয়েছি। বর্গিরা একসময় আমাদের সবকিছু লুট করে নিত। আমাদের শাসন ও শোষণ করেছে মুঘল, ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানিরা। কিন্তু সেসব তো পুরনো ইতিহাস।

স্বাধীনতা পেয়েছি ৫২ বছর হলো। থাবার ভয় এ মুহূর্তে আমাদের স্বাধীনতার ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে বেমানান। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ এই দেশ, দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ তথা আলোচনা হয় দিল্লি, পিকিং, মস্কো ও ওয়াশিংটনে। ৫২ বছরেও সর্বস্তরের জনগণের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থতার সুযোগে কখনো বিদেশিরা আবার কখনো তাদের দেশীয় দোসর কিংবা অপরাপর অপশক্তি থাবা বসাতে চায় শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর। এই থাবা থেকে বাঁচতে না পারলে অনেক চড়া মূল্য দিতে হতে পারে আমাদের।

এ সময়ের আলোচিত আরেকটি শব্দ হলো ‘ডামি’। নির্বাচনে ডামি প্রার্থী দাঁড় করানোর কথা কান বন্ধ করলেও যেন শোনা যায়। আমার কাছে থাকা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বাংলা একাডেমির অভিধান খুলে দেখলাম ইংরেজি ডামি শব্দের অর্থ যথাক্রমে প্রতিরূপ নকল মূর্তি বা কাঠামো, নকল বা নেকি দ্রব্য, তাস খেলায় যে হাত নামানো হয়েছে (যিনি নিজে খেলবেন না-তিনি), কোনো ঘটনা ঘটার সময় যে ব্যক্তি উপস্থিত থাকে কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে না, সাক্ষী-গোপাল ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ২৩৪)। মজার বিষয় হলো একই পৃষ্ঠায় ডামি শব্দের পরের শব্দটি হলো ‘ডাম্প’ যার অর্থ আবর্জনার স্তূপ, আঁস্তাকুড়, নোংরা বা অপরিচ্ছন্ন স্থান ইত্যাদি। কারা কোন অর্থে কেন ডামি হয়ে আজ নির্বাচন করার কথা ভাবছেন, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বিষয়টা যদি ‘জোহি জিতা ওহি সিকান্দার’ অর্থাৎ যিনি জিতবেন, তিনিই দলের আপ্যায়ন পাবেন এমন হয়, তবে ডামি শব্দের নতুন অর্থ অভিধানে সংযোজন করতে হবে। আর ডাম্প শব্দের অর্থও হয়তো বদলাতে হবে। ডামিরাই যদি টাকা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, জনসমর্থন বা গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে কিংবা হোন্ডা, গুন্ডা ও ডান্ডার জোরে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হয়ে ওঠেন, তবে দল, দলের নেতৃত্ব, বিশেষত দলের মনোনয়ন বোর্ড ভবিষ্যতে ডাম্প হওয়ার সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? যারা এ দেশে থাবা দিতে চায়, তারাই যদি আবার ডামিদের শক্তি জোগায়, বিষয়টা কেমন হবে? রাজনীতিতে একজনের ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে ডামি প্রার্থী দাঁড় করানো দেশ-বিদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। তাই বলে ঘোষণা দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে এভাবে ডামি প্রার্থীর আবির্ভাব সত্যিই ডরের বিষয়।

করোনা মহামারি ও যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় নিত্যনতুন ধ্যান-ধারণার আবির্ভাব কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এমনই একটি পাশ্চাত্য ধারণার নাম ‘ক্লায়েন্টিসিজম’। ইংরেজি ‘ক্যাপিটালিজম’কে যেমন বাংলায় ধনতন্ত্র আর ‘সোশ্যালিজম’কে সমাজতন্ত্র বলা যায়, তেমন করে বলতে গেলে ‘ক্লায়েন্ট’ (গ্রাহক) থেকে উৎপত্তি হওয়া ‘ক্লায়েন্টিসিজম’কে বাংলায় গ্রাহকতন্ত্র বলা যায়। ম্যারিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান কিংবা উইকিপিডিয়া ঘেঁটে ক্লায়েন্টিসিজম সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, তার সারমর্ম হলো এমন এক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রথা, যা পৃষ্ঠপোষক (নেতা) ও গ্রাহকের (ভোটার) সম্পর্কের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ প্রথায় একজন গ্রাহক বিশেষ কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির বিনিময়ে পৃষ্ঠপোষককে সমর্থন প্রদান করে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আজ দলছুট, দল-ত্যাগী, বহিষ্কৃত, কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রীত ইত্যাদি কদর্য শব্দে ভারী হয়ে উঠেছে। এসব দেখে গ্রাহকতন্ত্রের কথা মনে পড়ে। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার ইমেরিটাস অধ্যাপক জোয়েল এস মিগডাল দাবি করেন, একটি অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষকে তাৎক্ষণিক খরচের দিকে মনোনিবেশ করতে এবং আরও দীর্ঘমেয়াদি এবং বিমূর্ত ধারণা ত্যাগ করতে অনুপ্রাণিত করে। আয়ের পরিবর্তনশীলতা দারিদ্র্যের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাহিদাকে চালিত করার ক্ষেত্রে গ্রাহকবাদ বর্তমানকালে এভাবেই অনিরাপদ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটায়। গ্রামীণ এবং শহুরে পরিবেশে গ্রাহক ও পৃষ্ঠপোষকদের জন্য ‘বেঁচে থাকার রাজনীতির’ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গ্রাহকবাদ।

আমেরিকারই টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাভিয়ের আউয়েরো ২০০০ সালে আরেক গবেষণায় দেখেছেন সাধারণত সমাজের দরিদ্র এবং প্রান্তিক পর্যায়ের সদস্যরা তাদের ‘সমস্যা-সমাধানের’ বাস্তবসম্মত উপায় হিসেবে গ্রাহকতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়। তারা প্রায়ই সহায়তা লাভের আনুষ্ঠানিক ঁঃংযড় উৎসগুলো সহজে খুঁজে পায় না বিধায় তাদের এমন চক্রে টানা হয়। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-অফিস অব ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স’ গ্রাহকতন্ত্রকেন্দ্রিক ৫০ পাতার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। এ গবেষণাপত্রের দ্বিতীয় পাতায় আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লাস্ট ওয়েলসের রাজনীতির আলোচিত একটি সংজ্ঞায় বলা হয়, ‘রাজনীতি হলো সমাজে কে, কী পায়-তারই বিজ্ঞান ও কৌশল (আর্ট)। ’ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বা দেনা-পাওনার রাজনৈতিক ডামাডোলে আজ থেকে ১৬০ বছর আগে (১৯ নভেম্বর ১৮৬৩) ইংল্যান্ডের গ্র্যাটিসবার্গে উচ্চারিত রাজনীতির প্রবাদপুরুষ আব্রাহাম লিংকন উচ্চারিত, বহুল আলোচিত ও গণতান্ত্রিককামীদের বেদবাক্যতুল্য কথাটি স্মরণীয়। আমেরিকায় চলমান গৃহযুদ্ধ ও কয়েক লাখ মানুষ হতাহতের প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছেন যে, এত আত্মদানের মৃত্যু ঘটবে না। এ জাতি স্রষ্টার কৃপায় নতুন স্বাধীনতার জন্ম দেবে এবং জনগণের সরকার, যা জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য গঠিত, তা কখনো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে না।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক