ভারতের তিন রাজ্যে কেন বিজেপির বিজয়?

ভারতের তিন রাজ্যে কেন বিজেপির বিজয়?

অমল সরকার

২০১৮-তে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগড় বিজেপির হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। শতাব্দী প্রাচীন দলের সভাপতি তখন নবীন নেতা রাহুল গান্ধী। আগের বছর সভাপতির চেয়ারে বসে পরের বছর তিন রাজ্যে বাজিমাৎ করেছিলেন সনিয়া পুত্র। প্রচারে সরাসরি টক্কর হয়েছিল মোদী-রাহুলের।

হার মানতে হয়েছিল মোদীকে।  পাঁচ বছর পর বিজেপি মোক্ষম জবাব দিল। ২০১৯-এই অবশ্য কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরেছিল পদ্ম শিবির। এবার সেই মধ্যপ্রদেশ ধরে রাখার পাশাপাশি রাজস্থান ও ছত্তীসগড়ের বেশিরভাগ আসনে তারা পদ্ম ফুটিয়েছে।
ছত্তীসগড় নিয়ে বেশিরভাগ এক্সিট পোলের ফলই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তেলেঙ্গানাকে ধরে চার রাজ্যের মধ্যে দুই দুই ফল হবে এমনটা ধরে নিয়েছিলেন বিজেপি ও কংগ্রেস নেতারা।  

সে জায়গায় তিন রাজ্যে অভাবনীয় ফল হওয়ার রীতি মেনেই আঞ্চলিক নেতারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী চার রাজ্য মিলিয়ে ৪০টি সভা করেছেন। ৭৩ বছর বয়সি প্রধানমন্ত্রী পক্ষে এতটা শারীরিক ধকল নেওয়া কম কথা নয়। সভার পাশাপাশি আছে রোড শোও। রাজস্থান ও ছত্তীসগড়ে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। সেখানেও বিজেপির ক্ষমতায় ফেরার পিছনে প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্বকে দল প্রকাশ্যে খুবই বড় করে দেখাবে এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে লোকসভা ভোট যখন শিয়রে।

কিন্তু বিজেপির অন্দরমহল এবং রাজনৈতির বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করছেন, তিন রাজ্যের সাফল্যে মোদীর জন্য কিছু দুশ্চিন্তার দিকও আছে। রাজস্থান, ছত্তীসগড় এবং মধ্যপ্রদেশে মোদী-শাহ-নাড্ডা জুটি এবার রাজ্যের মুখ বদলের পথে এগচ্ছিলেন। মধ্যপ্রদেশে চারবারের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানকে টিকিট দেওয়া নিয়ে টালবাহনা চলতে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে শিবরাজ নাগপুরে আরএসএসের সদর দফতরে গিয়ে হত্যে দেন। দিল্লি গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও। শেষে পঞ্চম তথা শেষ তালিকায় মুখ্যমন্ত্রীকে ফের প্রার্থী করার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী মুখ ঘোষণা করেনি পার্টি। প্রকাশ্য সভায় অমিত শাহ জানিয়ে দেন, কেউ মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী নন। ওসব ভোটের পর ঠিক হবে।  ওদিকে, রাজস্থানে দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকেও বিজেপির দিল্লির নেতৃত্ব বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি। একটা সময় বসুন্ধরা দলে এতটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন যে ভেসে থাকতে এনজিও গঠন করে কর্মসূচি চালিয়ে যান। এমনকী ভোটের মাস ছয় আগে একাই রাজ্য সফরে বেরিয়ে পড়েন। রাজ্য বিজেপির প্রথমসারির নেতাদের তাঁর রথে দেখা যায়নি। সেই বসুন্ধরাও টিকিট পান শেষ তালিকায়। শুধু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নন, তাঁর অনুগামীদেরও টিকিট দিতে বাধ্য হয় দিল্লির নেতৃত্ব। অথচ, ভোটের কয়েক মাস আগেও দিল্লির নেতারা জয়পুর, যোধপুরে গেলে ডাক পেতেন না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দলে ব্রাত্য করে তোলা হলেও নিজের রাজনীতির জমি চাষ করে গিয়েছেন ৭২ বছর বয়সি এই নেত্রী।

ছত্তীসগড়েও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তিন বারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা রমন সিংকেও গোড়ায় পাত্তা দেয়নি। তাঁর নাম প্রথম দুই প্রার্থী তালিকায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁকেও টিকিট দিতে বাধ্য হয় দল। অর্থাৎ মোদী-শাহ বুঝতে পারেন, আঞ্চলিক তিন মুখকে উপেক্ষা করে ভোট বৈতরণী পেরনো কঠিন হতে পারে। তাছাড়া ফল আশানরূপ না হলে লোকসভা ভোটের মুখে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ স্লোগান অচল হয়ে পড়বে। তাই মোদী প্রার্থীপদ জমা করার দিন কয়েক আগে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে দলেও ‘ভোকাল ফর লোকাল’ নীতি নেন।

ভোটের ফল বলছে, শিবরাজ সিং চৌহান, বসুন্ধরা রাজে এবং রমন সিং’রা প্রমাণ করে দিয়েছেন রাজ্যে তাঁদের গুরুত্ব। এই তিন নেতার খাদের কিনারা থেকে ঘরে দাঁড়ানো মোদী জমানায় বিজেপিতে নয়া ঘটনা। বিজেপির বহু নেতা একান্তে মানছেন, তিন রাজ্যের ফলে মোদীর তুলনায় আঞ্চলিক এই তিন নেতার ভূমিকা কিছুমাত্র কম নন। প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়ে দেওয়া গেল আঞ্চলিক নেতাদের মর্যাদা না দিলে তাঁরও মুখ পুড়ত।  

শিবরাজই ফের মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হবেন ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাবে না। ফের তাঁকে ভুপালের কুর্সিতে দেখা গেলে তিনি মুখ্যমন্ত্রিত্বের ইনিংসে নরেন্দ্র মোদীকে ছুঁয়ে ফেলবেন। রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করেন, মোদী গুজরাতে নিজের রেকর্ড অক্ষত রাখতে শিবরাজকে টিকিট না দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে বুঝেছেন তাতে তারঁও যাত্রাভঙ্গ হতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য রমন সিং এবং বসুন্ধরার ক্ষেত্রেও। তিন নেতাই প্রধানমন্ত্রী-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন দলে তাঁদেরও যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ, সমর্থন ও কর্তৃত্ব আছে।

লেখক: ভারতীয় সাংবাদিক । দ্য ওয়ালের নিয়মিত কলাম লেখক।

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক