দুনিয়া কিসিঞ্জারকে কেন মনে রাখবে

সংগৃহীত ছবি

দুনিয়া কিসিঞ্জারকে কেন মনে রাখবে

এম জে আকবর

হাইনজ আলফ্রেড কিসিঞ্জার, ১৯৩৮ সালে হলোকাস্ট (জার্মানিতে চলমান ইহুদি নিধনযজ্ঞ) থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন আমেরিকায়। এ ঘটনার ১৫ বছর আগে জার্মানির ব্যাভারিয়ায় তার জন্ম। আমেরিকায় তিনি হেনরি নাম ধারণ করেন। মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ১৯৪৩ সালে এবং বার্লিনে মোতায়েন সামরিক গোয়েন্দা ইউনিটে সার্জেন্ট পদে কাজ করে যুদ্ধবীর সম্মাননায় অলংকৃত হন।

পঞ্চাশ দশকে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উজ্জ্বল পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। ষাট দশকে তিনি রাজনীতি ও সরকারে তার উপযুক্ত জায়গার তল্লাশে নামেন। জায়গা পেয়েও গেলেন ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে। প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে বসিয়ে দিলেন।

কিসিঞ্জার আর উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসন, এ যেন একে অন্যের জন্য তৈরি। পরের পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি দূতিয়ালি আচার-রীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশ্বময় নতুন ধ্যান-ধারণায় সজ্জিত অক্ষভিত্তিক ভৌগোলিক রাজনীতির সমীকরণ প্রক্রিয়া নিরুদ্বেগে বাস্তবায়ন করে যেতে থাকলেন। তার এ প্রথম বিরাট সাফল্য বিশ্ব ইতিহাসে একটি আলাদা অধ্যায় হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার কারণও বটে।

কিসিঞ্জার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়ার দুই মাসের মধ্যেই ১৯৬৯ সালের ২ মার্চ উসুরি নদী সীমান্তে সোভিয়েত সেনাদের আক্রমণ করে বসে চীন। দুই পক্ষের গোলাগুলি চলে ছয় মাস। অবস্থাটা কিসিঞ্জার আগাগোড়া মূল্যায়ন করে ফেললেন। বুঝলেন, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নের সামনে কমিউনিস্ট ভাবাদর্র্শের গাঁথুনি টিকিয়ে রাখা অর্থহীন।

স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতার গোঁড়ামি দূর থেকে বোঝা কঠিন। দুই দুশমনই অন্তর থেকে প্রতিপক্ষকে বদ মনে করে। কেউই শয়তানের সঙ্গে সমঝোতা চায় না। দুই সীমান্তে রুশ সেনাদের নিথর করে দেবে, বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট সংহতিকে করে দেবে দুর্বল, দুই মেরু বিশ্বব্যবস্থা করে দেবে চুরমার-কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে এ রকম একটা দাঁতাঁত তৈরির চিন্তাভাবনা করছিলেন। নিক্সনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি কিসিঞ্জারের এ ভাবনাতে সায় দিয়েছিলেন। ব্যাপারটায় ঝুঁকি ছিল বিরাট। কারণ এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছুই জানত না। কিসিঞ্জারের এ উদ্যোগ জনসম্মুখে এলে মন্ত্রণালয় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। মাও সে দং এবং নিক্সন যতক্ষণে পিং-পং খেলা শেষ করলেন, ততক্ষণে তাইওয়ানকে বেচে দেওয়া হয়েছিল; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বেইজিংয়ের এ আসন নিয়ে আলোচনাও সেরে ফেলা হয়। ঘটনার একমাত্র নায়ক হেনরি কিসিঞ্জার। মিডিয়া তাকে নিক্সনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণায় মেতে উঠল।

বেইজিংয়ে তার প্রথম ও গোপন অভিযানের সফলতার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে চিরকৃতজ্ঞ ছিলেন কিসিঞ্জার। যদি কোনো তথ্য ফাঁস হয়ে যেত বা মিশন ব্যর্থ হয়ে যেত, কিসিঞ্জারকে তার রাজনৈতিক গুরু পত্রপাঠ বরখাস্ত করে দিতেন। কিন্তু বেইজিং ও ইসলামাবাদ তাদের তলে তলের কর্ম ভালোভাবেই চেপে রেখেছিল।

কিসিঞ্জারের সামনে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। এ ক্ষেত্রে তিনি তার আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। যদি ভেবেচিন্তে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিত তাহলে তিনি তার বন্ধু-মক্কেল ইয়াহিয়া খানের পক্ষে আরও উপকারী হয়ে উঠতে পারতেন।

যুক্তিসংগত বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে, টেকসই অর্থনৈতিক নব্য-ঔপনিবেশিকতা, যা পরে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা, জাতীয় উত্থান এবং লাখ লাখ মানুষকে দেশত্যাগ করে ভারতে প্রবেশের বিষয়টি উসকে দিয়েছিল। পরবর্তীতে, কিসিঞ্জার এ সংকটকে ব্যক্তিগত সমস্যায় রূপান্তর করেন, পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় আমেরিকার চরম ব্যর্থতার জন্য ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতকে দায়ী করেন। ইন্দিরা গান্ধী, নিক্সনের হস্তক্ষেপের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা ভারতের স্বার্থের সঙ্গে আপস করতে অস্বীকার করেছিলেন।

হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয় টেপরেকর্ডারে যে ধারণ করা হয় সে বিষয়ে বেমালুম হয়ে কিসিঞ্জার ও নিক্সন তাদের ব্যক্তিগত কথোপকথনে যে নোংরা ভাষা প্রয়োগ করতেন তা ধরা পড়ে যায়। ২০০৫ সালে ওই রেকর্ডের কিছু কিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, নিক্সন ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে ‘বুড়ি ডাইনি’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। কিসিঞ্জার মুদ্রণযোগ্য নয় এরকম আরও কিছু মন্তব্য করেন ইন্দিরা সম্বন্ধে।

মানুষের বাচনভঙ্গিতে তার মেধা ও বিচক্ষণতার প্রকাশ ঘটে। কিন্তু কিসিঞ্জার যখন কথা বলতেন তখন প্রতিপক্ষকে অযথা খাটো করার প্রয়াস চালাতেন। তার মৃত্যুতে ঢাকায় কেউ শোক করবে না; কেননা তিনি বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। হুল ফুটিয়ে কথা বলতে কিসিঞ্জার যেন সদা প্রস্তুত থাকতেন। তার অভ্যাস ছিল ভারতীয়দের ‘স্বভাবত মারমুখো’ বলা। এটাও বলতেন ভারতীয়রা ‘বেজন্মা’, তারা নপুংসক (সেক্সলেস)।

আমার কাছে কিসিঞ্জারের বদবুলির মধ্যে নপুংসক (সেক্সলেস) কথাটা সবচেয়ে মজাদার। কেননা হেনরি সর্বদা নিজেকে ‘যৌনউন্মুখ’ (সেক্সফুল) হিসেবে জাহির করতে সচেষ্ট ছিলেন। যখন একা নিঃসঙ্গ তখন তিনি হলিউডের যৌন আবেদনময়ী সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ঈর্ষান্বিতরা তা দেখে বলতেন, তার কাজ তো শুধু ‘কিসিংহার’ (চুমু খাওয়াই সার)।

কিসিঞ্জারের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেক আগেই úষ্ট হয়েছিল। হার্ভার্ডে ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়ার জন্য তিনি যে থিসিস রচনা করেন তাতে তার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ধরা পড়ে: ন্যায়পরায়ণতার চেয়ে বৈধতা বেশি প্রাসঙ্গিক। একেই বলে রিয়েলপলিটিক। পরাশক্তিরা যদি একটি নতুন বাস্তবতাকে মেনে নেয় তবে সেটাই হবে নতুন বাস্তবতা।

কিসিঞ্জারকে যে দেশ (আমেরিকা) দত্তক নিয়েছে সে দেশের পক্ষে সত্যকে বদলে নিতে চাইতেন। সর্বদা স্পষ্টবাদী, সর্বদা বুদ্ধিদীপ্ত এই ব্যক্তি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মানবাধিকার আমেরিকান নীতির একটি ‘প্রয়োজনীয় লক্ষ্য’ এবং জাতীয় নিরাপত্তাও সে রকমই প্রয়োজনীয় লক্ষ্য। তার মতে, ‘কিছু কিছু পরিস্থিতিতে, এ দুটোর মধ্যে কোনো একটাকে বেছে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে নৈতিক ব্যাপারটিকে তুলনামূলক সহজভাবে দেখা হয়। ’

নিক্সন জমানায় গণতন্ত্র আকস্মিকভাবে, এমনকি নৃশংসভাবে, একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চিলির নির্বাচিত নেতা সালভাদর আলেন্দেকে ১৯৭৩ সালে এক অভ্যুত্থানে জেনারেল অগাস্টো পিনোশের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী এবং অন্য নেতারা এতে যে আতঙ্কিত হয়েছিলেন তা তারা গোপন করেননি। কিসিঞ্জার খুব সূক্ষ্মচালে গালগল্প ছড়িয়ে দিতেন। এর একটি ছিল এমন : তার এবং চেয়ারম্যান মাও সে দং অথবা প্রধানমন্ত্রী জো এনলাইয়ের সঙ্গে আলাপ করছিলেন তিনি। সেখানে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? উত্তর পেলেন; ‘বিপ্লব বিষয়ে এখনই কিছু বলাটা খুব আগাম বলা হয়ে যাবে। ’

কিসিঞ্জারের প্রিয় ছিল নিউইয়র্ক ক্লাব। ওই ক্লাবে একদা মধ্যাহ্নভোজকালে তার সঙ্গে আমার কথা হয়। তখন আমি ওই গল্পের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সশব্দে হেসে উঠলেন তিনি। তিনি আমার প্রথম ‘বই দ্য শেডস অব সোর্ডস : জিহাদ অ্যান্ড দ্য কনফ্লিক্ট বিটউইন ইসলাম অ্যান্ড ক্রিস্টিয়ানিটি’ মাধ্যমে আমার সম্পর্কে জানতে পারেন। তার সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বলেন, ৭৩০-খ্রিস্টাব্দের দিকে মাত্র এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে হঠাৎ করে কীভাবে কোনো অতীত অস্তিত্ব ছাড়াই অজানা বেদুইন উপজাতি ইতিহাসের অন্যতম বিশ্বশক্তি হয়ে উঠল? এর উত্তরে আমি ইবনে খালদুনের ব্যাখ্যা পেশ করি : আসাবিয়া, গোষ্ঠী চেতনার সৃষ্টি, সাধারণ লক্ষ্য এবং উপজাতীয় বিশৃঙ্খলাকে অগ্রাহ্য করে সমন্বিত মানস গঠন।

আবার আমাদের দেখা হবে, কথা হবে-সে দিনের আলোচনা এভাবেই শেষ হয়। হেনরির একটা ভদ্রতা স্মরণীয়। তিনি আমার বই ‘ব্লাড ব্রাদার্স’-এর জন্য একটি চমৎকার ব্লার্ব (বই ও লেখকের পরিচিত বিষয়ক ক্ষুদ্র রচনা, যা প্রচ্ছদের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে থাকে)। বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে এটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমার বই ‘টিন্ডারবক্স : দ্য পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার অব পাকিস্তান’-এর জন্য তিনি ব্লার্ব রচনায় রাজি হননি। ওই কাজটা তিনি ভয়ের মনে করেছিলেন। এমনও হতে পারে যে, তিনি পাকিস্তান ধারণার বিরুদ্ধে কোনো বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চাননি।

আমি যখন কিসিঞ্জারের সঙ্গে একই মঞ্চে অবস্থান করছিলাম তখন তার বয়স ৯০। ওই অনুষ্ঠানটি সম্ভব হয়েছিল অরুন পুরি অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করার কারণে।

হেনরি কিসিঞ্জারের তাৎপর্যময় দুটি অর্জন। সত্তর দশকে মার্কিন-চীন দাঁতাঁত এবং ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের অবসান ঘটানো। এগুলোর কাঠামো তো পাঁচ দশক ধরে টিকে রয়েছে।

ভিয়েতনামের লি ডাক থোর সঙ্গে প্যারিসে শান্তি আলোচনা কি নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য? থো ওই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। কিসিঞ্জার ওই সম্মান ও নগদ টাকা প্রাপ্তিতে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু বোমা হামলা থামেনি। কিসিঞ্জার দায়িত্বে থাকাকালে ভিয়েতনামে যত আমেরিকান ছিল তার অর্ধেকেরও বেশি প্রাণ হারিয়েছে। শেষতক বিপদ আঁচ করে আমেরিকা তড়িঘড়ি ভিয়েতনাম ছেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনাম এই ঘোরতর দুই দুশমন সাবধানে বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে, এটা দেখার জন্য কিসিঞ্জার লম্বা হায়াত পেয়েছিলেন। ব্যর্থতা ও সাফল্যের স্বাদ পাওয়া হেনরি কিসিঞ্জারের মতো আর কারও দেখা আমরা পাব না, অন্তত একবিংশ শতাব্দীতে নয়।

লেখক : ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং লেখক

(লেখাটি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে নেওয়া)

news24bd.tv/SHS

সম্পর্কিত খবর