বর্তমানে অনেক বাম নেতারা যেভাবে সম্পদশালী হয়েছেন

ফাইল ছবি

বর্তমানে অনেক বাম নেতারা যেভাবে সম্পদশালী হয়েছেন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

আমরা সবাই দেখছি, শাসক দলের মধ্যে এমপি হওয়ার জন্য সবাই মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এতো বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী যার বেশির ভাগই শাসক দল থেকে এসেছে বা অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে, যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ আছে।  

আমরা যদি আমাদের যৌবনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারার হারাবার আর কিছু নেই বলে যেই বাম নেতারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন; তারা কিন্তু আসলে কখনোই সর্বহারা ছিলেন না। বরং তারা আরও বেশি সম্পদশালী হয়েছেন।

বর্তমানকালে এসে শাসকদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা এখন বড় আকারের ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
 
রাজনীতি যে ধনী হওয়ার উপায় এটা কমবেশি সবাই আমরা জানি। কিন্তু রাজনীতি করলে যে আলা-দ্বীনের চেরাগের চাইতেও বেশি কিছু পাওয়া যায়, এটা বোধয় এমপিদের হলফনামা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আপনারা জানেন, আপনার পাড়ারই হয়তো সাদাসিধে লোকটার জীবন, তারা বাড়ি হয়তো আছে বা নেই থাকলেও খুব মলিন কিন্তু একদিন দেখলেন তার বাড়িটা চকচকে হয়ে উঠছে একতলা বাড়ি তিনতলা হয়ে যাচ্ছে, তিনতলা বাড়ি পাঁচতলা হয়ে যাচ্ছে এবং তাঁর শান-শকৌত বেড়ে যাচ্ছে তখন আপনি বুঝতে পারবেন লোকটা রাজনীতি করে এবং শাসক দলের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সে ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করেছে।
কারো কারো সম্পদের পরিমাণ দুই হাজার, তিন হাজার গুন বেড়ে গেছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো তাদের স্ত্রীদের সম্পত্তি। কারো কারো স্ত্রীরা অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কিন্তু জানা মতে তাদের কোনো বৈধ আয় নেই। এইযে বৈধ আয় নেই অথচ অনেক সম্পত্তির মালিক এটি অনেককে উদ্বুদ্ধ করছে যে আমাকে এমপি হতেই হবে। আবার এমপি হতে গেলেও টাকা লাগে। আমরা দেখি একেবারে মফস্বল শহরের একটি সাধারণ যুবসংগঠনের নেতা তিনিও নাকি চার-পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচার করে দিতে পারে।

রাজনীতি বর্তমানে বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর জীবিকা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এখন দুটি পেশা। একটি হলো বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করতে হবে তাহলে আপনার শানশওকত, ক্ষমতা, টাকা সব হবে অথবা আপনাকে রাজনীতি করতে হবে এবং সেটা শাসক দলের সঙ্গে হলে সবচাইতে ভালো। কারণ এতে নিরাপত্তা পাবেন কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না। কোনো কোনো পত্রিকা এমনভাবেও লিখেছে যে একজন এমপির পাঁচ বছর আগে যে ১০ লাখ টাকার সম্পদ ছিল তা এখন ১০ কোটি টাকার উপরে হয়ে গেছে।

 ঢাকা শহরে তিনি ১০-১২টি ফ্ল্যাট, নির্বাচনী এলাকায় পুকুর, বাগান বাড়ি-সহ নানা কিছু কিনেছেন। এরকম খবর প্রতিদিন আসছে। একজন এমপিকে নিয়ে বলেছেন ব্যাংকে তার টাকার পরিমাণ হাজার গুন বেড়ে গেছে। অথচ ব্যাংক নিজে গরিব হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে এখন নগদ টাকার সঙ্কট। অথচ ব্যক্তিমানুষ কেউ কেউ এমনভাবে ধনী হয়েছেন বাংলাদেশে যা দেখে নিশ্চই আনন্দ লাগে। এগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারি দেশ কতো এগিয়ে যাচ্ছে।  
বাংলাদেশ যে ধনী দেশ হয়ে উঠছে সেখানে আবার অনেক ধনী কৃষকের আবির্ভাব হচ্ছে। এসব রাজনীতিবিদদের অনেকই নাকি কৃষক। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশের কৃষকরা কতো দরিদ্র। তাদের দুটিই চাহিদা একটি হলো তার স্ত্রীর জন্য একটি শাড়ি আর নিজের জন্য একটি লুঙ্গি ও গামছা। এটুকুও তারা পূরণ করতে পারেন না। বাংলাদেশে এমন ধনী কৃষক আছেন, এটা শুনতে নিশ্চই ভালো লাগে। দেশে এখন এটিই সেরা পেশার একটি। বিত্তশালী হতে চাইলে সমাজের সর্বনাশ করে নির্লজ্জভাবে রাজনীতি করতে হবে এবং সেটাই টাকা উপার্জনের সেরা পথ। রাজনীতি করলে অগাধ সুযোগ পাওয়া যাবে, আপনার হাতে টাকা হবে ক্ষমতা হবে, সুযোগ-সুবিধা হবে। সুতরাং কে না চায় এমপি হতে।

 কোনো কোনো উপনির্বাচনে এমনও দেখেছি আমরা ৫ শতাংশ ভোটও পায়নি। কিন্তু তারা সব সুবিধা ভোগ করেছে ৫ বছরে। শুল্কমুক্ত গাড়ি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমিটির প্রধান, বিনিয়োগ-বাণিজ্য, স্কুল কমিটি-সহ সবকিছুতে শুধু টাকা, আর টাকা এমপিদের বেলায়। আমার ধারণা পৃথিবীর কোথাও এরকম কোনো বিধান নেই যে এমপিরা মানুষের রাজনীতি করার বিনিময়ে এমন সুবিধা পায়। কিন্তু নির্লজ্জভাবে আমাদের এমপি মহোদয়রা এই সবিধাটা পাচ্ছে। এমপিরা হলো আইনপ্রণেতা। তারা আইন প্রণোয়ন করবে, তারা সংসদে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলবে। তারা কথা বলবে আইনের নানা চুলচেরা বিষয় নিয়ে। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেখি না।  
আমরা দেখি এমপিরা এলাকায় এলাকায় ঠিকাদার হয়ে গেছে। উন্নয়নের ঠিকাদার। তারা নিজেরা যার যার এলাকায় কাজ নিয়ে যাচ্ছে, নিজেরা সেই কাজের ভাগ-বাটোরা করছে। আইন প্রণোয়নে তাদের বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই। ফলে সংসদে বিন্দুমাত্র আইন নিয়ে বিতর্ক হয় না। কোনো কোনো আইন এমনও হয়েছে মাত্র ২ থেকে ৫ মিনিটে পাস হয়ে গেছে। কিন্তু এটা নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই। আরেকটি হলো ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধান। সেখান থেকেই আমাদের একটা ভয় যে বাংলাদেশ ক্রমেই ভালো মানুষদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনতাম যে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। কিন্তু এখন দেখছি দুর্বৃত্তে রাজনীতিকায়ন। আগে রাজনীতিবিদরা কারণে অকারণে বা প্রয়োজনে হয়তো দু’একটা মাস্তান পালতো। কিন্তু এখন মাস্তানরা তাদের প্রয়োজনে রাজনীতিবিদ পালে।

 পুরো রাজনীতির পথটা পাল্টে গেছে। সেখানে চাঁদাবাজি, সম্পদ দখল থেকে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ছাড়া এমপিদের মানুষের ব্যাপারে কোনো ভাবনা আছে বলে কেউ দেখাতে পারবেন? আমার কাছে মনে হয় এমপি মানেই হলো শুধু নিজের ভাবনা, নিজের পরিবার, নিজের জগৎটাকে বড় করা এবং একই সঙ্গে সম্পদের পাহাড় বানানো। রাজনীতিতে একসময় যে শালীনতা ছিল তা এখন অনেকটাই নেই। রাজনীতি আসলে দেশের সার্বিক সংস্কৃতিরই অংশ। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি শাসন ব্যবস্থায় মানুষের ভাবনা অনুপস্থিত। মানুষ নগণ্য; ব্যক্তি পূজনীয় এবং সেই ব্যক্তি যদি এমপি হয় অথবা এমপি নাও হতে পারে কোনোরকমে যদি মনোনয়নপত্রে তার নামটা তুলতে পারে, তাতেই তার বহু ধরনের সম্পদের পাহাড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই সবাই মড়িয়া হয়ে এমপি হতে চান। বিশেষ করে শাসক দলের লোকেরা।

পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক
news24bd.tv/ডিডি