বিজয়ের এই দিনে এখনও যেসব গ্লানি রয়েছে

ফাইল ছবি

বিজয়ের এই দিনে এখনও যেসব গ্লানি রয়েছে

অজয় দাশগুপ্ত

এতোগুলো বছর পার হলেও আমাদের বিজয় সংহত হয়েছে কি না এ প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ রাজনীতি হাহানি মারামারির বাইরে পা রাখতে পারেনি। এখনো নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস। বিজয় দিবসে এর অবসান চাই বটে।

কিন্তু কীভাবে? 

একদল যখন আত্মগরিমায় মত্ত আরেক দল তখন দেশের নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গেও এক পা এগিয়ে আছে। ভৌগলিক স্বাধীনতা পতাকা জাতীয় সঙ্গীতের বিজয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছে আমরা তা অর্জন করেছি। যে বিজয়ের কথা বলছি তার পরিধি আরো ব্যাপক। এই বিজয় মানুষে মানুষে ভালোবাসা আর স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে বাঁচার বিজয়।

৫০ বছর পর এমন একটা জায়গায় প্রশ্ন থাকা কিংবা কিছু বলাটা অসমীচীন হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ এসব মৌলিক কথা বা চাওয়ার বাইরে এখনো পা ফেলেনি ।

শুরুতেই বলি গত কয়েক দফা দেশ শাসনে থাকা সরকার দেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। উন্নয়নের দৃশ্যমান রূপ দেখছে জাতি।  বাংলাদেশ আগে যা দেখেনি বা ভাবতে পারেনি তার অনেককিছুই এখন হাতের মুঠোয়। তাহলে অসন্তোষ বা অসন্তুষ্টি কেন? কেন এখনো বিরোধী দলের রাজনীতি বা তাদের কাজকর্ম উগ্র বলে মনে হয়? এ কারণে আসলেই কি তাদের দোষারোপ করা উচিত? গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ এ চার স্তম্ভের কথা বলে বিশ্বাস করে স্বাধীন  হওয়া দেশটিতে এগুলো এখনো হয়নি, নয়তো কঙ্কাল। গণতন্ত্র নামের সোনার হরিণ কতোটা প্রযোজ্য বা দরকার তারও কোনো হিসাব নেই। সমাজতন্ত্রের কথা এখন হাস্যকর। দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়া এই মতবাদ আঁকড়ে থাকার মতো নির্বুদ্ধিতা দ্বিতীয়টি নেই। ধর্ম বিষয়ে কিছু বলার চাইতে বর্তমান সমাজের ঘটনাবলীর দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব কি হচ্ছে? 

কদিন আগে চট্রগ্রামের একটি ঘটনা জানলাম। বাচ্চা দুটি ছেলে মেয়ের কথোপকথন। ছেলেটি মেয়েটিকে বলছিল , তুই কি হিন্দু? হিন্দু হলে আমি তোর সাথে কথা বলবো না। দুধের দাঁত পড়েনি এমন শিশুরা যদি এসব কথা বলে বা ভাবতে শিখে যায় সে সমাজে আসলেই কি অসাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু থাকে না আছে? বাকি থাকলো জাতীয়তাবাদ, এ জায়গাটিতে সরকারি দল বা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নীতি মার খেয়ে গেছে অনেক আগে।  

বাঙালি জাতীয়তাবাদ শক্তি হলেও এখন তার নাম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। বিএনপি শুরু থেকে এটাই বলে আসছিল। বুঝে বলুক আর না বুঝে বলুক সত্য এটাই আমরা বাংলাদেশি। তাই জাতীয়তাবাদের অহংকার বা উগ্র জাতীয়তাবাদ আসলেই পরিহার করা উচিত। যদিও কোনো দল তা করবে না ।

স্তম্ভগুলোর এই হাল যেখানে সেখানে নতুন পথের সন্ধান কি জরুরি নয়? সে পথ কি? কারা দেখাবেন সে রাস্তা? আমি বলি আমাদের তারুণ্যই পারে তা করতে। কিন্তু এখানেও কিন্তু আছে। এই তারুণ্য আজ বিভ্রান্ত।

এতগুলো বছর একনাগাড়ে সরকারে বা দেশ শাসনে থাকার পরও আওয়ামী লীগ তাদের মনোভাব পরিবর্তন করাতে পারেনি। বরং দিনকে দিন নানা চাপে তারা বিদ্বেষ আর হিংসার শিকার। সে আক্রোশ কখনো নিজেদের ওপর, কখনো অন্য কারো ঘাড়ে চাপায় মানুষ। আর তৈরি হতে থাকে অবরুদ্ধ পরিবেশ। বিজয় মানে যে আনন্দ আর খোলামেলা জীবনের প্রতিশ্রুতি তা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে সমাজ। মাঝা মাঝে এমনও মনে হয় একদিকে উন্নয়ন অন্যদিকে হতাশা কোনটা আসলে সত্য?

এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মানুষ স্বাধীন হতে চায় কি শুধু লাগামহীনতার জন্য? 

আমাদের অগ্রজ ও পূর্ববর্তীরা কেন জান দিয়েছিলেন? কেবল একটি ভূখণ্ডের কারণে? না পতাকা ও গানের জন্য? আপনি যদি ইতিহাসের দিকে তাকান, দেখবেন তাদের ধারাবাহিক সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মূল কথাই ছিল সবাই মিলে বাঙালির জন্য একটি দেশ গড়ে তোলা। বাঙালি যেন নিজেদের মাঝে নিজেরা শাসন করে ভালো থাকতে পারে। শাসন কর্তারা এসেছেন আবার বিদায় নিয়েছেন বটে বাঙালির দেশ কখনো মরু ঝড়ে কখনো প্রতিবেশীর চাপে কখনো নিজেদের কলহে আপন শক্তিতে জাগতে পারেনি। পাকবাহিনী চলে যাবার পর আত্মসমপর্ণের পর যে আনন্দ জোয়ার তা ও আজ দ্বিখন্ডিত। আজকাল দেশের তারুণ্যের কথা শুনলে বা তাদের মনোভাব বুঝলে পাকিস্তানিরাই চমকে যাবে। বিজয়ের যে কি মানে আর আসলে কাদের বিজয় ৫০ বছর পর এ আরেক নতুন ধাঁধা।
একাত্তর সাল চলে গেছে সে আর কোনোকালেই ফিরে আসবে না। কিন্তু যে রক্ত শ্রম আর ত্যাগ তার বিনিময়ে পাওয়া দেশটিতে ধনীরা ধনী হচ্ছে গরিবের কপালে সেই দুঃখ আর সামনে মরিচীকা। এভাবে কি আসলেই বিজয়ের মর্যাদা সমুন্নত থাকে? বিজয় দিবশ বা এই সময়টুকু এখন সে ভাবে পালিত হয় না। এ আরেক কাহিনী। দল যদি দেশের চাইতে বড় হয় আর দেশ যদি ইতিহাস কে মনে না রাখে তাহলে সব দিবসই এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি পড়তে বাধ্য। আমাদের অনেক আগে স্বাধীনতা প্রাপ্ত দুই দেশ ভারত পাকিস্তান তাদের মৌলিক বিষয়ে ঝগড়া করে না। তাদের জাতীব ঐক্য বা সমঝোতা বজায় রেখেই চলে রাজনীতি এবং সরকার পরিবর্তনের লড়াই।

 আমাদের দেশ নিয়ে যত গর্ব বা রক্তের বড়াই করি না কেন জাতীয় ঐকমত্যের কোন নাম গন্ধ নাই কোথাও। অচিরে যে হবে তারও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কারণ? একে অপরের বিরুদ্ধাচারণ আর হিংসার রাজনীতি। কে করেছে, কে করেনি বা কারা শুরু করেছিলো? তার চেয়ে জরুরি এর অবসান। জীবনব্যাপী প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এমন বিবাদ কোনোকালে ভালো কোনো ফল আনবে না। আর বিভক্তিও দূর হবে না কোন কালে। যে দেশের সমাজ দ্বিখণ্ডিত রাজনীতি কলহমুখর সে সমাজে শান্তি আসবে কীভাবে? গণতন্ত্র স্বাধীনতা ও বিজয় সমার্থক না হলে বিজয় দিবস কেবল একটি দিবসই থেকে যাবে। তার মুক্তি আসবে না কোনোদিন।  

লেখক : সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট ।

news24bd.tv/ডিডি