‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

অলংকরণ:কামরুল

কিস্তি-১

‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

অনলাইন ডেস্ক

“আমার যতো দূর মনে হয়, আমি নিজের জীবনটা নিয়ে এতোটাই বাড়াবাড়ি করেছি,আপনারা
যার অর্ধেকটা করতেও সাহস পেতেন না; উপরন্তু নিজের কাপুরুষতাকে আপনারা সুবুদ্ধি বলে ধরে
নিয়েছেন, তাতেই আরাম বোধ করেছেন, সুখ পেয়েছেন নিজেদের ধোঁকা দিয়ে। সুতরাং আমি সম্ভবত
আপনাদের সবার চেয়ে বেশি ‘প্রাণময়’। ” (ফিওদর দস্তইয়েফ্স্কি, “তলকুঠুরির কড়চা”, মশিউল
আলম অনূদিত)

এক.
‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’
আমার জন্ম আষাঢ় মাসে, ঘোর কদম আর জোর বৃষ্টির প্যাচপ্যাচে কাদার দিনে। জন্মের কাহিনি মা আর ভাইয়ার কাছ থেকে বহুবার শুনেছি।

মাকে প্রায়ই বলতাম, “মা, ওই গল্পটা আবার বলো
না; ওই যে ভাইয়া যে বলেছিলো, মা, মনাভাইরি ছুঁচোয় নিয়ে যাবেনে, শিগ্গির মনাভাইরে খাটে
উঠাও। ”
আট বছরের একটি টিনের ঘরের ভেতর তিরিশ বছরের একজন নারী প্রসব করলেন একটি কন্যাশিশু। প্রসবের আগে তাঁর দেখভাল করার জন্য আব্বু একজন ‘পঁচার বৌ’কে নিয়ে এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। কিন্তু সেই ‘পঁচার বৌ’-এর একমাত্র কাজ ছিল ঘুমের ভেতর দিল্লি-হিল্লি জয় করে আসা, আর জাগ্রত দশায় পানের সুবাস দিয়ে আশপাশে সেই সব জয়ের গল্প ছিটানো।
রান্নায় লবডঙ্কা, কুসংস্কারে ‘বিলাসী’ গল্পের মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া; তবে হিসেবের ব্যাপারে চাণক্যের বস হবেন।
এভাবেই চলছিলো। আষাঢ় মাসের একদিন মা আমাকে জন্ম দেন রাত আটটা-নয়টার দিকে। রাতে আব্বু, ভাইয়া, পঁচার বৌ কী খাবে সেই কথা ভেবে দুপুরেই মা সবার জন্য বেশি করে রান্না করে রেখেছিলেন। তখনকার দিনে খড়ির চুলায়ই রান্না চলতো। পঁচার বৌকে আনা হয়েছিলো সার্বক্ষণিক সব ধরনের কাজে সাহায্য করা, কিঞ্চিৎ ধাত্রী-বিষয়ক অভিজ্ঞতার প্রয়োগ আর নার্সিঙের জন্য।
কিন্তু আমার আবির্ভাব-মুহূর্তে তিনি আমাকে ওয়েলকাম করার জন্য ছিলেন না। তিনি তখন হয়তো স্বপ্নলোকে শ্রীরবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বসে বসে অপেরা সঙ হজম করছিলেন। ফলে, আমার জন্মলগ্নের চিৎকার তার কানে পৌঁছায়নি সে বেলা।  
কিন্তু ভদ্রমহিলাকে আমি পৃথিবীতে ল্যান্ড করার অনেক পরেও দেখেছি। তার ঘোর অন্ধকার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হতো এই জন্য যে, যে আদর বা উচ্ছ্বাস আমাকে পরে দেখিয়েছেন সেটা জন্মলগ্নে দেখানোর মতো সেই লেভেলের র্যাশনাল বৃদ্ধি তার ঘটেনি। অথবা পঁচার বৌ যেই শ্রেণিভুক্ত মানুষ, সেখানে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মায়েরা হয়তো এত কম মনোযোগ পায় যে,আমার জন্মের ব্যাপারটা তার কাছে গরু বিয়ানোর মতো অগুরুত্বপূর্ণ ঠেকেছে! কে জানে!


তাকে আমি তখন কী ডাকতাম মনে নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে মাটিতে পুঁতে রাখা তালের আঁটি ডাকতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে জানি না। কোনোপ্রকার ব্যাখ্যায়ও যাবো না। পঁচার বৌয়ের কাজটি ইদ্রিস খাঁর বাড়ির পাশের মুচি-বাড়ির দেবকীর মা করে দিয়েছিলেন। আমাকে মর্ত্যে ল্যান্ড করিয়েছিলেন একজন হিন্দু মুচি ধাত্রী।
মায়ের পেট থেকে বের করেই আমাকে মৃত্তিকা-মায়ের পিঠে শুইয়ে রাখা হলো। একটু রাতের দিকে মায়ের যখন হুঁশ ফিরলো তখন তিনি শুনলেন, নয় বছরের একটি ছেলে-শিশু (আমার ভাইয়া) মাকে ডাকছে আর বলছে – ‘ও মা, আমার মনাভাইরে শিগগির খাটে উঠোও,ওর গায়ে পিঁপড়ে ধরছে, ছুঁচোয় টাইনে নিয়ে যাবেনে। ও মা, শিগগির ওঠো। ’
মা তখন আমাকে যেভাবে দেখতে পেলেন, সেই বর্ণনা কিছুতেই ভুলবার নয়।
দৃশ্যটা এমন : পঁচার বৌ ঘুমে, আব্বু ঘুমে, মা প্রসবজনিত অবসাদে ঘুমের ঘোরে, আমার নয়
বছরের ভাইটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত একটি ইহুদি-বাড়ির মৃত মানুষদের ভিড়ে
একটি পোষ্য কুকুরের মতো আহত ও মৃতপ্রায় আমার মতো একটি ক্ষুদ্র জীবন বাঁচানোর জন্য
অব্যক্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথবা বাড়িটা গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রে আহত ফিলিস্তিনের কোনো
বাড়িও হতে পারে।
এই দৃশ্যটা আমি ভুলতে পারিনি। ভবিষ্যতে কখনো অ্যালঝেইমার আক্রান্ত হলে পারবো কি না জানি
না।  
ঠিক এরকম মুহূর্তে দৃশ্যে আমার সর্বংসহা মা ঢুকে পড়লেন। তিনি দেখলেন, আমার চোখের পাপড়ি কালো হয়ে গেছে পিঁপড়াদের মেগাফেস্টে। ভেবেছিলেন, আমি মনে হয় মারাই গেছি। কোলে তুলে নিয়ে চোখ থেকে পিঁপড়াদের দূর করলেন, দুধ পান করালেন এবং মায়ের মাতৃত্ব ও মানবিক যত্নের ঠ্যালায় আমি কেঁদে উঠলাম। এ কান্না সুখের কান্নাই হবে হয়তো। অনেক অবহেলার পরে এক রত্তি স্নেহ-পদার্থ যেমন চোখের মধ্যে যমুনা ছেড়ে দিতে পারে, সেরকম ছিল মনে হয়। মা আমাকে তাঁর গর্ভের পানি থেকে বের করে, পিঁপড়ার মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে এই মহামায়ার কবলে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার  দু-দুবার পানিতে পড়ে সরাসরি যমালয়ে যাবার রাস্তায় ব্যারিকেড বসিয়ে নতুন করে প্রাণ দিয়েছেন। মা আমাকে আমার এক জন্মে তিন-তিনবার জন্ম দিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য আর কারো আছে? পরম অবহেলা আমার কিছুই করতে পারে না আসলে।
একজন কলেজ শিক্ষক এবং একজন কৃষকের ছেলে আমার আব্বা, যার ঘরে কন্যা-সন্তানের জন্ম হয়েছে। এটা তখনকার দিনে অতোটা খুশির খবর না, যতোটা আমার ভাইয়ের জন্মের খবরে ছিলো।  
দাদু-বাড়ি থেকে পরদিন আমাকে দেখতে এলেন দাদু, সঙ্গে নিয়ে এলেন ‘বাজারে পাটের গুদামে আগুন লেগেছে’ খবরটি। আমাকে দেখে উপাধি দিলেন ‘রওশন এরশাদ’। তখন চলছিলো এরশাদের স্বৈরশাসনের আমল। রাষ্ট্রের রাজনীতি-ফাজনীতির ধার না-ধারা আমার মাটির-সঙ্গে-মিশে-থাকা দাদুর কাছে আমার গায়ের রঙটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। কন্যাশিশু ফুটফুটে না হলে আমাকে হয়তো কোলেও নিতেন না। গায়ের রঙের ব্যাপারে আমার দাদুর ছিলো সেইরকমের ফ্যাসিনেশন। দাদির গায়ের রঙে মজে গিয়ে তিনি এলাকার মাতবরকে ঘুষ দিয়ে বিয়ে করেছিলেন দাদিকে। গায়ের রঙের জন্য আব্বুও কোলে নিলেন, কন্যাশিশু হবার পরেও। ‘গায়ের রঙ’ যে খুব বড়ো ব্যাপার দুনিয়ায় তা বুঝতে পেরেছিলাম যখন ছোটবেলায় তুলনামূলক কালো এবং দরিদ্র মেয়েদের সঙ্গে খেলতাম। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ দারুণ রিয়্যাক্ট করতেন এবং আম্মু-আব্বুকে পরামর্শ দিতেন, আমাকে যেন ওরকম বাচ্চাদের সাথে না মিশতে দেয়। আমার নানা ছিলেন  একেবারে কৃষ্ণ-কালো, নানি ছিলেন গৌর বর্ণের। নানি নানাকে যেসব কারণে দেখতে না পারার ভান করতেন (সংসারে যা হয় আর কি!) তার কারণ তখন বুঝতে না পারলেও কারণগুলোর মোদ্দা কারণ এখন বুঝি, সেটা হলো নানার গায়ের রঙ। নানা-নানির গাত্রবর্ণ সম্পর্কিত সম্পর্কের একই হকিকত ছিলো আমার শ্বশুর-শাশুড়ির মধ্যেও, অর্থাৎ আমার শ্বশুর ছিলেন কালো, শাশুড়ি অসম্ভব ফর্সা। কিন্তু পারস্পরিক মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বর্ণবাদের কী অবস্থা সেটা আমার মতো পরের বাড়ির মেয়ে এবং ভিন্ন অঞ্চলের মেয়ের সামনে খুব যত্ন করে আড়াল করতে পেরেছেন সবাই। তবে ‘ফর্সা’র প্রতি ফ্যাসিনেশন যে এই পরিবারের সবার মধ্যেই ছিলো, সেটা আমার শাশুড়ি-মায়ের অলিখিত কিন্তু অনস্বীকার্য একচ্ছত্র আধিপত্যবাদী অবস্থানের মধ্যে অনেকটাই সুস্পষ্ট।
আমার জন্মের পর এলো ষাটুরে (জন্মের ষষ্ঠ দিন)। দাদু-দাদিরা এলেন গ্রাম থেকে। আর কে কে এলেন ঠিক জানি না। তবে আমার ভাই যে পুরো ঘরটাকে কদম ফুল দিয়ে সাজিয়েছিলেন সেটা জানি। আমাদের প্রজন্ম থেকে সাধারণত প্রথম সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তানের প্রতি চাপা ঈর্ষা কাজ করতো। ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাওয়ায় ছোটকে ঠিকঠাক যত্ন নিতো না, বাবা-মায়ের প্রতি এক ধরনের বিরাগ ও বিরক্তি পোষণ করতো। ব্যতিক্রমও যে ছিলো না তা নয়। ব্যতিক্রম না থাকলে আমার ভাইয়ের এতো ভালোবাসা আমি কোথায় পেতাম? কদম ফুল, প্রবল আবেগের ‘মনাভাই’ডাক, ‘মনাভাই’ জন্মাবার খুশির খবরটি জনে-জনে পৌঁছে দেয়া, আর মায়ের অবাধ্যতা স্বীকার করার মতো এতো আদর আমার জীবনের সকল অবহেলাকে ম্লান করে দেয়। আমি আমার ভাইয়ের ছায়ায় বড়ো হতে থাকি। অজান্তেই একদিন ভাইয়ার ‘মনাভাই’ থেকে ‘বু’ হয়ে যাই!  

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি