‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

সংগৃহীত ছবি

কিস্তি-২

‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

অনলাইন ডেস্ক

১৯৮৭ সাল। এরশাদের বহুবিধ খারাপ কাজের মধ্যে আমার মা-বাবা তাঁর একটি ভালো কাজের সুফল পেয়েছিলেন। বাবা বেসরকারি কলেজে, মা বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন। হু. মু. এরশাদ আমার মা-বাবার এ দুই প্রতিষ্ঠানকে তখন সরকারি ঘোষণা দেন।

ব্যাস, কন্যাশিশু জন্ম-সংক্রান্ত প্রাচীন ট্যাবু কাটিয়ে আব্বু তখন  নতুন সংস্কারের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। ‘আমার মাইয়েডা বড়ো কপাইলে’ বলতে শুরু করলেন। তাঁর আদরের মাত্রা তখন গায়ের রঙের ডিমান্ড ছাপিয়ে ভাগ্যলক্ষ্মীর
মহাদৃষ্টির দিকে ছুটতে লাগলো।

মনে হলো যেন মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের স্লিপার দিয়ে তিনি সরাসরি আধুনিক মধুসূদনে প্রবেশ করলেন।

চিরকালের অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলিত কন্যাশিশুর জয়গান ধ্বনিত হতে শুরু করলো তখন। আস্তে আস্তে আব্বুর সঙ্গে আমার অ্যাটাচমেন্ট বাড়তে থাকলো। আব্বুর ভুড়িওয়ালা পেটের উপরে আমাকে এমনভাবে বসিয়ে জাস্ট হাত দিয়ে ধরে রেখে ঘুরে বেড়াতেন যে, পেছন থেকে বোঝাই যেতো না সামনে একটা শিশু পেটের উপরে আছে। এটা খুব বিস্ময়কর আর অভিনব বেবি-সিটিং পদ্ধতি। এখন বেবিপ্যাকও পাওয়া যায় এরকম। আব্বুর আদর এমন পর্যায়ে চলে গেল যে আমি প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পার করা পর্যন্ত জানতাম, আমি আমার আব্বুর পেট থেকেই বের হয়েছি। মায়ের পেট খুবই ছোট, এতো ছোটো পেটে আমি কিছুতেই থাকতে পারি না। আব্বুর পেট যেহেতু বড়ো, আমি আব্বুর পেটেই ছিলাম। রীতিমতো মিথিক বিশ্বাস ছিলো আমার। সবাই হাসতো এটা নিয়ে। আমি রাগ করে তখন পোটলাপুটলি গুছিয়ে নিয়ে অডিটোরিয়ামের ধুতুরায় ছেয়ে যাওয়া সিঁড়িতে বসে থাকতাম।

ভাইয়া গিয়ে আমার মান ভাঙাতো, আর আমি যে আব্বুর পেটেই ছিলাম এটা হাসতে হাসতে মেনে নিতো। আগেই বলেছি, তিন তিনবার জীবন পেয়েছি আমি। আসলে তিনবার নয়। বহুবার মরতে গিয়েছি, ন্যাচারালি, নানান অসুখ-বিসুখে; মা আমাকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। হার-না-মানা এই জীবনটা ধীরে ধীরে আব্বুর মমতার স্বাদ পেতে শুরু করলো। আমার জন্মগ্রহণ আর বৃদ্ধির সাথে সাথে আব্বুর অর্থনৈতিক অবস্থানেরও নাকি পরিবর্তন হতে শুরু করলো। একজন প্রতাপশালী অংকের শিক্ষক তাঁর দারিদ্র্যপূর্ণ ভাগ্যকে চাবুক মেরে মেরে স্বাচ্ছন্দ্যের পথে আনতে শুরু করলেন। ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁর কথাও নাকি বেশ ভালো করে শুনছিলেন আমার জন্মের পর থেকেই। আগে ছিলো শুধু অনটন আর অভাবের ছেঁড়াফাটা জীবন। এসবই আব্বুর মুখে শোনা। ফলে আদরের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আমার মনস্তাত্ত্বিক বৃদ্ধিতে কোনো বাজে বিষয় আর যুক্ত হতে পারলো না। গায়ের রঙের কারণে দাদির খুব অন্যরকম আদর পেয়েছি জীবনে। নিজের উচ্চতা, গাত্রবর্ণ, স্বামীর সোহাগে আমার দাদি ‘মাটিতে পা পড়তো না’ অবস্থায় জীবন কাটিয়ে গেছেন। দারিদ্র‍্য ছিলো; কিন্তু স্ত্রীর প্রতি প্রবল যত্ন আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা প্রদানে কোনোপ্রকার মধ্যযুগীয় বিপত্তি-বীজ দাদুর অভিধানে ছিলো না বললেই চলে। সেই দাদির কাছে আমি ছিলাম পরম আরাধ্য এক ক্ষুদে প্রাণী।

এর দুটো কারণ আমার মনে প্রায়ই ঘোরে। এক. আমার আব্বা ছিলেন দাদির প্রথম এবং খুবকাঙ্ক্ষিত সন্তান। দীর্ঘ ১১ বছর পর(ভুল করে না-থাকি যদি) আমার আব্বা জন্মগ্রহণ করেন।  
দুই. গায়ের রঙ। দাদির সঙ্গে আমার সখ্য ছিলো অনেকটা নদীর সঙ্গে স্পিডবোটের মতো। আমি দাদিকে শুধু বিরক্তকরতাম, আর দাদি আমাকে বলতেন: ‘আমার প্যাটের ছাও, তুমি আমারে ধইরে খাবার চাও?’
দাদি প্রায়ই এ কথা বলতেন। আমি জিজ্ঞেস করতাম,  ‘দাদি, আমি তো তোমার পেটে হইনি, তবু এই কথা বলো কেন?’ দাদি বলতেন, আব্বু তো দাদির পেটে ছিলেন, আব্বু ছাড়া আমি পৃথিবীতে এলাম কী করে। ফলে, আদিমাতার আধিপত্য আমাকে মেনে নিতেই হতো! 
আব্বুর মতো দাদি-ভাইয়া-আম্মুও বিশ্বাস করতে শুরু করেন, আমি আসলে ভাগ্যবান এক কন্যাশিশু। আমার ভাগ্যে নাকি আমাদের পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে। আমরা টিনের ঘর ছেড়ে পাকা দালানে উঠে যেতে পারলাম। আমি নাকি আব্বুকে এই উন্নতির পেছনে অদৃশ্য প্রেরণা জুগিয়েছি। এই বিশ্বাস থেকে আব্বু এবং ভাইয়া আমার নামে নার্সারি ও মাছের হ্যাচারির ব্যবসা শুরু করেন।

আরও পড়ুন...‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

আমার নামে আমার বাপ-ভাইয়ের এসব করা নিয়ে প্রাইমারি বা হাইস্কুল পর্যন্ত কোনো অভিযোগ বাআনন্দ কিছুই আমার মধ্যে ছিলো না। কারণ, এসবের তেমন কিছুই আমি বুঝতাম না।  বরং নার্সারিতে আব্বু, দাদু, আম্মুর (ভাইয়াকে খুব কমই এ কাজে পাওয়া গেছে) সঙ্গে মেহগণির ফল শেডের মধ্যে পলিথিনের ছোট ছোট প্যাকেটে পুরে দিতে বেশ আনন্দই লাগতো। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় যখন রাস্তায় ছেলেরা 'সেঁজুতি হ্যাচারি' বলে বলে ক্ষেপাতো তখন সাংঘাতিক বিরক্ত হতাম। এবং নামকরণ নিয়ে আমার এই বিরক্তিবোধ এখনও জাগ্রত। আবার, যখন বাড়ির পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরা, গরুর খড় কাটা, আব্বু ও কাজের লোকেদের সঙ্গে বসে গোবর দিয়ে জ্বালানি বানানো, আব্বুর সাইকেলে চড়ে চিকন চিকন দুই পা সামনে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে চতুল গ্রামে দাদুবাড়িতে যাওয়া, উঠোনের পাশের মাটির চুলার পাশে বসে আম্মুর হাতের চিতোই পিঠা আর গরুর মাংস ভাইয়ার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খাওয়া, দুই ভাইবোন আর আব্বু
মিলে মোড়ায় বসে আম্মুর বড়ো মাছ কাটার দৃশ্য দেখতে দেখতে কে কোন পিস খাবে সেটা ঠিক করা, পশু-হাসপাতালের গাছ থেকে চুরি করে চালতে পেড়ে আনা, বাজার থেকে কেনা নতুন জলপাই কিংবা গাছের কাঁচা আম পাটায় বাটার পর পাল্লাপাল্লি করে পাটা চেটে খাওয়া, ভাইয়ার কালেকশনে থাকা মাইকেল জ্যাকসন-ম্যাডোনা-জেমস-মর্ডান টকিঙ-ত্রিরত্নে ক্ষ্যাপার গান ফুল ভলিউমে একসঙ্গে শোনা, ভাইয়ার কাছ থেকে পাঠ্য বইয়ের ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে মাসুদ রানা-তিন গোয়েন্দা-হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ার তালিম নেয়ার দৃশ্যগুলো মনে পড়ে তখন আমার সব বিরক্তি, সব অনুযোগ, ক্ষোভ-রাগ একেবারে পানি হয়ে যায়। আমার অনুভূতিগুলো উপর্যুক্ত বাক্যের চেয়ে আরও দীর্ঘ বা ছোট করলেও তার মধ্যে ঠিক ধরা যাবে না। অনুভূতিগুলো ভীষণ রকমের অদ্ভুত। হয়তো আব্বু আর ভাইয়া বেঁচে নেই বলে!

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি