নতুন বছর: মুমিনের প্রত্যাশা যেমন হওয়া উচিত

নতুন বছর: মুমিনের প্রত্যাশা যেমন হওয়া উচিত

 আলেমা হাবিবা আক্তার

পার্থিব ও পরকালীন জীবনের কল্যাণ অনুসন্ধানই মুমিনের প্রধান কাজ। তাই মুমিন নতুন বছরে কল্যাণ লাভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করবে এবং সে অনুসারে এগিয়ে যাবে। পাশাপাশি পূর্ববর্তী কল্যাণের ধারাগুলো অব্যাহত থাকবে। কেননা আল্লাহ মুমিনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, ‘তারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তারা তাতে অগ্রগামী হয়।

’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৬১)

কোরআনে ভাষায় কল্যাণ

পবিত্র কোরআনে ‘খায়ের’ শব্দ দ্বারা কল্যাণ বোঝানো হয়েছে। আর খায়ের শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা মানবজীবনের সামগ্রিক কল্যাণকে নিশ্চিত করে। যেমন :

১. সম্পদ : পবিত্র কোআনে খায়ের শব্দ দ্বারা সম্পদ বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কারো মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে সে যদি ধন-সম্পদ রেখে যায়...।

’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮০)

২. খাদ্য : মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবে আমি তার কাঙাল। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৪)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মুসা (আ.) এই দোয়ার মাধ্যমে ক্ষুধা নিবারণের দোয়া করেছেন।

৩. শ্রেষ্ঠত্ব : খায়ের শব্দ প্রথমত কল্যাণকে বোঝায়, তবে এটি শ্রেষ্ঠত্বের অর্থেও ব্যবহৃত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ কি তারা, না তুব্বা সম্প্রদায় ও তাদের পূর্ববর্তীরা?’ (সুরা : দুখান, আয়াত : ৩৭)

৪. ভালো কাজ ও ইবাদত : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘(আমি) তাদেরকে ওহি প্রেরণ করেছিলাম ভালো কাজ করতে, নামাজ পড়তে এবং জাকাত দিতে; তারা আমারই ইবাদত করত। ’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭৩)

৫. ভালো অবস্থা : পার্থিব জীবনের ভালো অবস্থাকেও কোরআনে খায়ের বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি তোমাদেরকে সমৃদ্ধিশালী দেখছি, কিন্তু আমি তোমাদের জন্য আশঙ্কা করছি এক সর্বগ্রাসী দিবসের শাস্তি। ’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৪)

৬. কোরআন বা শরিয়ত : পবিত্র কোরআনে তথা ইসলামী শরিয়তকে কল্যাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহভীরু ছিল তাদেরকে বলা হবে, তোমাদের প্রতিপালক কী অবতীর্ণ করেছিলেন? তারা বলবে, মহাকল্যাণ। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৩০)

কল্যাণের মানদণ্ড

কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যাপারে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও ঘোষণাই চূড়ান্ত মানদণ্ড। মানুষের চিন্তা ও প্রত্যাশা কল্যাণ চূড়ান্ত করতে পারে না। কেননা মানুষ কল্যাণ মনে করে কখনো কখনো অকল্যাণও প্রত্যাশা করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মানুষ অকল্যাণ কামনা করে; যেভাবে কল্যাণ কামনা করে। মানুষ অতি মাত্রায় ত্বরাপ্রিয়। ’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১১)

কল্যাণের ধারা অব্যাহত রাখার গুরুত্ব

কল্যাণকর কাজ ও কল্যাণকর বিষয়গুলো অব্যাহত রাখা আবশ্যক। এটাই মহান আল্লাহর নির্দেশ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন নামাজ ও জাকাত আদায় করতে। ’ (সুরা : মারিয়াম, আয়াত : ৩১)

কল্যাণ হারিয়ে ফেলা কাম্য নয়

কোনো কল্যাণকর বিষয় অর্জনের পর তা হাতছাড়া করা মুমিনের জন্য কাম্য নয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সে নারীর মতো হয়ো না, যে তার সুতা মজবুত করে পাকানোর পর তার পাক খুলে নষ্ট করে দেয়। ’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯২)

কল্যাণ অর্জনে করণীয়

মুমিনরা আল্লাহর নির্দেশিত পথেই কল্যাণ অর্জন করে থাকে। আর তা হলো :

১. কল্যাণকর কাজ করা : কল্যাণকর কাজের মাধ্যমেই মুমিন কল্যাণ অর্জন করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ভালো কাজ করো, যেন সফলকাম হতে পারো। ’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৭)

২. কল্যাণের প্রতি আহ্বান জানানো : মুমিন অন্যদেরও কল্যাণের প্রতি আহ্বান করে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হোক যারা কল্যাণের পথে আহ্বান জানাবে। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৪)

৩. কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করা : আল্লাহ কল্যাণের কাজে পরস্পরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘অতএব তোমরা ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করো। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৪৮)

৪. কল্যাণের কাজে বিলম্ব না করা : আল্লাহ কল্যাণকর কাজগুলোতে অগ্রগামী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং মুমিন কল্যাণের কাজে বিলম্ব করবে না। ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে, তখন সকালের জন্য অপেক্ষা কোরো না। আর যখন তোমার সকাল হয়, তখন সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা কোরো না। অসুস্থ হওয়ার আগে তোমার সুস্থতাকে আর তোমার মৃত্যুর জন্য জীবনকে কাজে লাগাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪১৬)

৫. আত্মোন্নয়নে মনোযোগী হওয়া : মুমিন যখন আত্মোন্নয়নের চেষ্টা করতে থাকে এবং প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন তার জীবন অর্থময় ও মূল্যবান হয়ে ওঠে। সাঈদ ইবনে জাবের (রহ.) বলেন, ‘মুমিনের প্রতিটি বেঁচে থাকার দিনই লাভজনক। ’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম :  ১/৩৮৬)

৬. জাতির উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়া : মুমিন শুধু নিজের উন্নয়নে সচেষ্ট হবে না, বরং দেশ ও জাতির উন্নয়নেরও চেষ্টা করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। ’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১১)

৭. আল্লাহর কাছে দোয়া : মুমিন কল্যাণ প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে। কেননা এটাই নববী শিক্ষা। মুসা (আ.) দোয়া করেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমার প্রতি যে অনুগ্রহ করবে আমি তার কাঙাল। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৪)

পরকালীন মুক্তিই চূড়ান্ত কল্যাণ

মুমিন পার্থিব ও পরকালীন উভয় জীবনের কল্যাণ অনুসন্ধান করবে, তবে পরকালীন কল্যাণকে প্রাধান্য দেবে। কেননা পরকালীন মুক্তিই চূড়ান্ত কল্যাণ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কিন্তু তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দাও, অথচ পরকালই উৎকৃষ্টতর এবং স্থায়ী। ’ (সুরা : আলা, আয়াত : ১৬-১৭)

আল্লাহর সবার জন্য কল্যাণের ফায়সালা করুন। আমিন।