বড়শি দিয়ে মাছ শিকার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে

ফাইল ছবি

বড়শি দিয়ে মাছ শিকার সম্পর্কে ইসলাম কী বলে

 ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

মাছ মহান আল্লাহর এক বিশেষ নিয়ামত। মাছ জবাই করতে হয় না, মরে গেলেও খাওয়া যায় এবং ইহরাম অবস্থায়ও শিকার করা যায়। এমন সহজীকরণ মহান আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহের পরিচায়ক। আধুনিক যন্ত্রপাতি, দেশীয় সরঞ্জাম ব্যবহার এবং বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ শিকার করা হয়।

এ ক্ষেত্রে বড়শির ব্যবহার একটি পরিচিত পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মাধ্যমে খুব সহজে ও ভদ্রভাবে মাছ শিকার করা যায়। ইসলামে এ পদ্ধতির বিশ্লেষণ নিম্নরূপ :

টোপ হিসেবে জীবিত প্রাণীর ব্যবহার : মাছকে আকর্ষণ করতে বড়শিতে টোপ হিসেবে বিভিন্ন কিছু ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় জীবিত ছোট মাছ, ব্যাঙ, পোকামাকড় বা অন্য কোনো প্রাণী গেঁথে পানিতে ভাসিয়ে রাখা হয়।

জীবিত কোনো প্রাণীকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ইসলামসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে অন্য খাদ্যসামগ্রী দিয়ে টোপ বানিয়ে মাছ ধরতে কোনো সমস্যা নেই। হাদিসে কোনো প্রাণী বেঁধে রেখে সেটিকে তীরের লক্ষ্যস্থল বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। এ হাদিসের মাধ্যমে জীবিত কোনো প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা হওয়ার বিষয়টির ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো প্রাণী বেঁধে সেটিকে তীরের লক্ষ্যস্থল বানাতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৪৮৯৯)

বিনোদনের জন্য মাছ শিকার : প্রয়োজন ছাড়া কেবলই বিনোদনের উদ্দেশে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করা বৈধ নয়। কারণ এতে একদিকে নিষ্প্রয়োজনে আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দেওয়া হয়। অন্যদিকে অপচয় হয়। দুটোই নিষিদ্ধ। তবে মাছ শিকার করে খেয়ে বা বিক্রয় করে অথবা অন্য কোনোভাবে উপকৃত হলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। মহান আল্লাহ সৃষ্টিজগতের প্রতিটি বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানুষ তার প্রয়োজনে মাছ শিকার করতেই পারে। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া এমনিতে বড়শির ব্যবহার করে মাছকে কষ্ট দেওয়া ও অপচয়ের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ বলেন, ‘এবং আহার করবে ও পান করবে। কিন্তু অপচয় করবে না। তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ’(সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)

অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর কিছুতেই অপব্যয় করবে না। যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই আর শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ। ’ (সুরা : ইসরা, আয়াত : ২৬-২৭)

টিকিট কেটে বড়শি দিয়ে মাছ শিকার : অনেক সময় বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করার জন্য নির্দিষ্ট মূল্যে টিকিট ছাড়া হয়। অনেক জায়গায় তো স্থায়ীভাবে টিকিটের বিনিময়ে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। টিকেট সংগ্রহকারীরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাছ শিকার করে থাকে। যে যা শিকার করতে পারে সেটা তার হয়ে যায়। কেউ বেশি মাছ শিকার করতে পারে, আবার কেউ শূন্য হাতে ফিরে যায়। মাছ শিকারের এমন পদ্ধতি শরিয়তসম্মত নয়। কারণ এতে কে কী পরিমাণ মাছ পাবে, তা অস্পষ্ট। ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই মাছ না পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এটা এক ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা। এভাবে মাছ পাওয়া-না পাওয়া বা বেশি পাওয়া ইত্যাদি অনিশ্চয়তা মূল লেনদেনের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে এমন লেনদেন নাজায়েজ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, পাথরের টুকরা নিক্ষেপের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় ও ধোঁকাপূর্ণ ক্রয়-বিক্রয় রাসুল (সা.) বারণ করেছেন।
(মুসলিম, হাদিস : ১৫১৩)

এ ছাড়া এতে জুয়া ও লটারির সঙ্গেও সাদৃশ্যতা রয়েছে। কারণ এখানে সবাই টাকা দিলেও সবার মাছ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। আবার কে কী পরিমাণ পাবে, তাও জানা নেই। মাছ না পেলে বা কম পেলে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। টিকিটের মূল্য থেকে বেশি মূল্যের মাছ পেলেও সমন্বয় নেই। ফলে কেউ বেশি পায়, কেউ কম পায়, আবার কেউ বঞ্চিত হয়। ইসলামে জুয়া ও লটারি হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! মদ, জুয়া, মূির্ত ও ভাগ্যনির্ধারক তীর ঘৃণিত শয়তানি কাজ। তোমরা তা বর্জন করো, যাতে তোমরা সাফল্যমণ্ডিত হতে পার। ’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৯০)

তবে পুকুরে এভাবে মাছ ধরার ব্যবস্থা করা যেতে পারে যে প্রত্যেকে যা মাছ পাবে, তা মালিকের কাছ থেকে নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে নেবে। আর মাছ না পেলে পেল না। এতে কারো কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না।

মাছ শিকারে অপব্যবহারে শাস্তি : মাছ শিকারের অপব্যবহারের কারণে অতীতে পৃথিবীতে আসমানি আজাব নেমে এসেছে। বনি ইসরাঈলের জন্য শনিবার ইবাদত করার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। ওই দিন পার্থিব কাজকর্ম নিষিদ্ধ ছিল। লোহিত সাগরের উপকূলবর্তী ঈলাত নামক স্থানের অধিবাসীরা এই দিনে মৎস্য শিকার করে আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করেছিল। আল্লাহ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছেন। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সম্পর্কে সীমা লঙ্ঘন করেছিল, তোমরা তাদের নিশ্চিতভাবে জানো। আমি (আল্লাহ) তাদের (আজাবের আদেশ দিয়ে) বলেছিলাম, তোমরা ঘৃণিত বানর হয়ে যাও। আমি তা তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ এবং মুত্তাকিদের জন্য উপদেশস্বরূপ করেছি। ’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৬৫-৬৬)

পরিশেষে বলা যায়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের নির্দেশনা স্মরণ করে আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে চলাই মুমিনের লক্ষ্য হওয়া চাই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক