ভাইয়ার 'মনাভাই'

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৩

ভাইয়ার 'মনাভাই'

অনলাইন ডেস্ক

শুরুতেই বলেছি ভাইয়া ছোটবেলায় আমাকে 'মনাভাই' বলতো। এই শব্দটির একটা ভিন্ন তাৎপর্য আছে আমার কাছে। ঈশ্বর আমাকে ছেলে বানাতে গিয়ে কী মনে করে যেন মেয়ে বানিয়ে দিয়েছেন। দিয়ে তো ফেলেছেনই, রক্ষাও করেননি সেভাবে (আসলে করেছেন হয়তো, আমি টের পাইনা।

সেই সম্ভাবনা থেকে কৃতজ্ঞতা ঈশ্বরের প্রতি। আমার ভেতরের বাউণ্ডুলে স্বভাবকে নিশ্চিহ্ন না করে দিয়ে কেন নারীরূপে মর্ত্যে পাঠালেন ঠিক বুঝতে পারি না। কিংবা অর্ধেক নারী অর্ধেক পুরুষ কিনা তাও বুঝি না।
 তবে ছোটবেলা থেকেই আমি বেশ অদ্ভুত ছিলাম।
চাচাতো ভাই হাসবু-খোসবুরা যখন বাইরে হিসু করতে যেত মা আমাকে তাদের সঙ্গে হিসু করতে যেতে দিতেন না। এটা কেন কিছুতেই বুঝতাম না। মা আমাকে এ ধরনের আদব আর সমাজ-শিক্ষা বিষয়ক অনেক শিক্ষাই দিতে চাইতেন। এই যেমন মুরগির রান, মাছের মাথা খেতে হবে বাড়ির পুরুষদের। পরপুরুষের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করা যাবে না, মেয়েদেরকে ঘরের কাজ শিখতে হবে, একাডেমিক পড়াশোনা করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি বরাবরই রান, মাছের মাথা আর পেটি পছন্দ করতাম। সংখ্যায় বেশি থাকায় মা পাতে এক পিস পেটির মাছ দিতেন, কিন্তু মাথা আর রান যেত ভাইয়া অথবা আব্বুর পাতে। পরে সেগুলো স্নেহ ও আদরের সূত্র ধরে আমার পাতে সুড়সুড় করে চলে আসত।

তখন ভীষণ রাগ হতো। আমিই যদি খাবো, তাহলে মা সরাসরি আমাকেই তো দিতে পারতেন। পারতেন না?

কী বলেন আপনারা?

আরও পড়ুন ‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব

মা যে পারতেন না, এই না পারাটা আমাদের এখানকার পারিবারিক শিক্ষা। ঘরের স্ত্রী সবসময় সবার খাওয়ার পরে খাবে, খাবে সবার রেখে দেয়া ঝুটা অংশ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ব্যাপারকে সবসময় দেখি গ্লোরিফাই করা হয়। আমাদের অবিকশিত নিম্নশ্রেণির চিন্তার শুরু এখান থেকেই।
আমার মাকে অনেক সময়ই পরে খেতে দেখেছি, কখনো কখনো একসঙ্গেও বসেছেন। কিন্তু খেয়েছেন সব থেকে শেষের অংশটা। যেমন মাছের ক্ষেত্রে লেজের কাছের অংশ, মুরগির ক্ষেত্রে পিঠের হাড়ের অংশ বা পাখনা ইত্যাদি। এখন আমার বাসায় এলে জোর করে মাথা দিই, রানটা অবশ্য বাচ্চাকেই দেই, তবে রানের পরের অংশটা দেই। মা নিতে চান না, জোর করে দিই। শাশুড়িকে অবশ্য জোর করা লাগে না। এটা ভালো।

আমার মাকে তাও আমাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসানো যায়, কিন্তু নানিকে কিছুতেই বসানো যেত না। সবার খাওয়া শেষ হলে নানিকে দেখতাম খেতে বসেছেন। এ ব্যাপারে অবশ্য আমার দাদি এগিয়ে ছিলেন। দাদি সবসময় আমাদের সঙ্গেই বসতেন খেতে।
এবং খাবারের ভালো অংশই খেতেন। আমাদের পরিবারে এটা একটা ভালো ব্যাপার ছিলো। দাদির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই বৈশিষ্ট্যটাও জিনেটিক্যালি পেয়েছিলাম। অর্থাৎ আমাকেও ভালো খেতে হবে, ভালো পরতে হবে। ভালো পড়ার ক্ষেত্রে অবশ্য আমার বরের অনুপ্রেরণাকে ক্রেডিট দেবো। সেটা অনেক পরের ঘটনা। বলবো ধীরে ধীরে।

তো, একবার মায়ের স্কুলে (গার্লস স্কুল) প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলছিলেন, 'মাছের মাথা, মুরগির রান শুধু ছেলেরাই খাবে, তা হবে না। তোমরা মেয়েরা বাবা-মাকে বলবে তোমরাও তাদের সন্তান, ফলে এগুলো তোমরাও খাবে। কোনোপ্রকার ছাড় দেবে না। কেমন?'

বক্তব্য শুনে আমি মাকে রেগে গিয়ে বলেছিলাম, 'মা শুনছো স্যার কী বলতিছেন?'
মা তাঁর মিছরির দানার মতো দাঁতগুলো বের করে হাসতে হাসতে বললেন, 'হ্যাঁ, শুনছি। তা বাসায় মাছের মাথা, মুরগির রান তো তুই ই খাইস। '
আমি বললাম, 'তুমি দেও নাকি? আমি জোর কইরে খাই, তাই। '

আমার আরও অনেক ব্যাপারেই রাগ হতো। রাগ হলেই ধুতুরায় ছেয়ে থাকা লাল অডিটোরিয়ামের ধূসর সিঁড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম।
 
আমার মায়ের এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তো আর আসমান থেকে একদিনে আসেনি? এসেছে নানির কাছ থেকে। নানির এসেছে বড়মায়ের কাছ থেকে। এভাবে পরম্পরা ধরে চলে এসেছে।  

আম্মুর এমএডের ট্রেনিঙের সময় নাকি অন্য কোনো কারণে যেন আমাকে বেশ কিছুদিনের জন্য রাখা হয়েছিলো নানুবাড়ি আলফাডাঙ্গায়। তখন অবশ্য কুটি (ছোট খালা) আর মেঝো (মেঝো খালা) ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কারণে তাঁদের অসীম আদর ছাড়াই ওখানে থাকতে হতো। ফলে আমি যথারীতি পাড়া বেড়িয়েছি। ওখানে এক নিম্নবিত্ত কৃষকের মেয়ে ডালিয়ার সঙ্গে খুটিমুচি খেলতাম। এসব নানির একদম পছন্দ না৷ মেয়ে বাচ্চারা ঘরের কাজ করবে, লক্ষ্মীমন্ত হয়ে থাকবে – তা না এসব কী!

তো, নানিকে দেখতাম আব্বু অথবা ভাইয়া বাড়িতে এলে তিনি পালের মুরগি ধরতে লেগে যেতেন। ব্যাপারটা আমার মোটেও ভালো লাগতো না। বাড়িতে মেহমান এলে বিশেষ পদ হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমিও তো তাঁর বাড়ির মেহমান। কই, আমার জন্য তো কোনোদিন পালের মুরগিটা খোপ থেকে ধরতে যেতেন না! 

এটা বড়োই পীড়া দিত আমাকে, এখনও দেয়।

আমার মা-নানিদের বেড়ে ওঠার পরিবেশকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। ওঁদের সময়ে অল্প বয়সে শ্বশুরবাড়িতে এসে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। সেসব ত্যাগ অনস্বীকার্য।  কিন্তু, তাঁদের মনস্তত্ত্ব যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে একটু অযৌক্তিক ছিলো, সেটা বোঝার মতো সাহস তাঁদের হতো না, বোঝার চেষ্টাও কোনোদিন করেননি। অথচ যখন পরিবারের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কাছ থেকে অন্যায্য বিচার পেতেন তখন একেবারে বিদ্রোহী রণক্লান্ত হয়ে উঠতেন একেকজন। পরে আবার যা তা-ই। এটিই আমাদের সমাজের চিরাচরিত চালচিত্র। এর ব্যতিক্রম মানেই পথভ্রষ্ট।
 
ফলে সংসারে চিৎকার-চেঁচামেচিতেই সব উদগীরণ হতো। যেভাবে সমাজ তাঁদেরকে চালিয়েছে সেভাবেই তো তাঁরা চলবেন! আমি ঠিক ওই অর্থে সামাজিক ছিলাম না। নানি, দাদি, মা-খালা বা ফুফুদের মতো। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকতার শেকড় অনেকদূরে প্রোথিত। একে ট্র্যা কে ফেরানো এতো সহজ? শিক্ষা ও প্রাত্যহিক অভ্যাস কিছুতেই এই অবিচ্ছেদ্য মনস্তত্ত্বকে আলাদা করতে পারছে না। কিন্তু হতাশায় সবাই তড়পাচ্ছে। আমিও তড়পাই, কিন্তু তল পাই না কোনো।

তড়পানোর অংশ হিসেবেই প্রচুর পাড়া বেড়াতাম, হা-করে করে মানুষ দেখতাম, প্রকৃতির নিত্য-নতুন ঘটনা দেখে বেড়াতাম, কিন্তু কিছুতেই 'মেয়েমানুষ' হতে পারতাম না – এটা আমার মনে হতো। অবশ্য আমার বর আমাকে বলে থাকেন, আমি নাকি মেয়েমানুষই। হয়তোবা! আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশে কারো হাত থাকে না। নিজের হাতকে বাড়িয়ে দিতে হয় অনেকটা জবরদস্তি করেই। আর আমি কিন্তু বায়োলজিক্যালি একজন মেয়েই শেষপর্যন্ত। কীভাবে নিজের বেড়ে ওঠার পরিবেশকে অস্বীকার করি! ছেলে হয়ে জন্মানো তো ভাগ্যে ছিলো না।
 
কিন্তু তবুও আমি যে ভাইয়ার 'মনাভাই'টি ছিলাম, সেটা মিথ্যে নয়।

আমার ভাইয়া ছিলো সাংঘাতিক কোমল হৃদয়ের মানুষ, আমিও কিছুটা। তবু আমার ভেতরে ভাইয়ার বলা 'মনাভাই'-এর কিছু বৈশিষ্ট্য ছোটবেলা থেকেই ছিল।
যেমন, বন্ধুদের সঙ্গে ভাইয়ার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিনেমা দেখার জন্য বাসায় ক্ষুব্ধ আব্বুকে আমি গার্ডিয়ানের মতো করে কীভাবে ম্যানেজ করতাম সেটা বলি। আমি দেখতাম আব্বু চ্যালাকাঠ নিয়ে অপেক্ষা করছে। একটু সুযোগ পেলেই আমি ভাইয়াকে গেইট খুলে ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে আসতাম। তখন আমি টু/থ্রিতে আর ভাইয়া এসএসসি দেবে। আব্বুর হাতে ধরা পড়লে পা ধরে আমি ক্ষমা চেয়ে বলতাম, 'আব্বু ভাইয়াকে আজকের মতো মাফ করে দাও। এ ভাইয়া, তুইও মাফ চা, পাও ধর আব্বুর। '

আরও পড়ুন :সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

আমার এই অদ্ভুত আচরণ দেখে আব্বু আর সেদিন ভাইয়াকে মারতে পারতেন না। ভাইয়াকে কেউ কিছু বললে, কষ্ট দিলে আমার সহ্য হতো না। একবার এক দুঃসম্পর্কের ফুফাতো ভাই বাজি ধরেছিলো ভাইয়ার সঙ্গে, বাটা লবণ-মরিচ খাওয়ার। যে খেতে পারবে সে নতুন একটা ঘড়ি পাবে। ভাইয়া পেরেছিলো, কিন্তু নতুন ঘড়ি তাকে দেয়া হয়নি। আমি ওইদিনের পর থেকে ওই ভাইটাকে দেখতে পারতাম না। আমার ভাইটা ঝাল খেয়ে মরে যাচ্ছিল, আর ওই ভাই এই কাজ করলো! আমি তখনই এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি নিশ্চিত আমার প্রতিবাদ তখন বাচ্চা বেড়ালের ডাকের মতো শুনিয়েছিলো। আর সমাজে এটাই বা কেমন নিয়ম যা কথা থাকে তার বেশিরভাগই ঘটে না?

আগেকার ওয়াশরুমগুলো ঘরের বাইরে বানানো হতো কেন কে জানে! তাও আবার ঘর থেকে অনেক দূরে। আস্ত একটা ভূতের কারখানার মতো লাগতো। এর একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে আগে মানুষ তো জঙ্গলে, নদীর ধারে গিয়ে কাজ সারতো। ফলে দূরত্বের স্মৃতি হয়তো মাথায় থাকতো টয়লেট-মেকারদের।

তো রাতে হিসু ধরলে আমার ভাই যখন বাইরে যেতে ভয় পেত, আমি তখন বলতাম, 'ভয় পাসনে ভাইয়া, আমি যাচ্ছি তোর সাথে। ' আমার কথা শুনে ভাইয়া পেত লজ্জা। দুটো কারণ।
এক. ছেলে হয়েও ভয় সে পাচ্ছে, আর মেয়ে হয়ে আমি অভয় দিচ্ছি।
দুই. যার ভয় পাচ্ছে, সেই ভূতের চেয়ে একটা মেয়ের সামনে হিসু করার ভয় আর লজ্জা কিছুতেই কম না।

এখন মনে পড়লে খুব হাসি পায়।

আমি ভাইয়ার 'মনাভাই'ই ছিলাম আসলে। ভাইয়ার যেকোনো দুঃখকে নিজের বলেই ভাবতাম অনেকদিন পর্যন্ত। ভাইয়াকে ছাড়া আমার জীবনের সমুদয় আনন্দ-বেদনা ম্লান হয়ে যেতো। কোরবানির ইদে গরুর সঙ্গে খাসিও জবাই হতো। সেই খাসি বানাতাম আমি আর ভাইয়া মিলে। ভাড়া করা কসাই বানাতো গরু। আমাদের দুই ভাই-বোনের এই মিল দেখে প্রতিবেশী লিচু ফুফুর মা বলতেন, 'আহারে, দুই ভাই-বোন যেন স্বর্গের দূত!'

২০১২ সালে যখন অসুস্থ আব্বুকে ধরে ধরে নিয়ে নানা ডাক্তার দেখানো, টেস্ট করানোর কাজ করতাম, তখন আব্বু আমাকে বারবার বলতেন 'মারে, তুই আমার একটা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেই ভালো হতি। '

কথাটা খুব কানে বাজে এখনও।
যখন কোনো মেয়েকে মেয়ের কাজের পাশাপাশি ছেলের কাজটা অনেক বেশি পরিমাণে করতে হয়, তখন তাকে শুধু ছেলে বা শুধু মেয়ে বলা যায়?
পাঠক কী বলেন?

ছোটবেলা বোধ হয় সব বাবা-মাই সন্তানকে বেদে নারীর ভয় দেখান। আমাদের দুই ভাইবোনকেও দেখানো হতো। ভাইয়া ঘুমের মধ্যেও ভয়ে জেগে উঠে বলতো, 'ও মা, আমারে বদ্যি বিটি ধইরে নিয়ে গেল!'
ভাইয়া মাকে খুব ফিল করতো। তাই মাকে ফেলে নিজের আপন মায়ের (বানোয়াট আপন) কাছে যেতে চাইতো না। কিন্তু আমি চাইতাম। উলটো মাকে ঝাড়ি দিয়ে বলতাম, 'যার মাইয়ে তার কাছে দিয়াসো। '
অন্যের সন্তানকে কাছ-ছাড়া করাকে উলটো আমার অপরাধই মনে হতো।

একটা প্রবল পুরুষতান্ত্রিক অনুশাসনের ভেতর দিয়ে বড়ো হয়েছি। আর নিজের কাছে নিজের 'মনাভাই' পরিচয়টি জারি রেখেছি।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিঙে খুব কম দিন ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্যেই এক্সট্রা পড়া গোছানোর জন্য কুদ্দুস ভাইয়ার কাছে বাংলা (বর্তমানে তিতুমীর কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক), নজরুল ভাইয়ার কাছে ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞানের জন্য সবুজ ভাইয়ার কাছে পড়া শুরু করি। নিজ দায়িত্বে এইসব ভাইয়াদের কাছে পড়া শুরু করি।  এতে ভাইয়ার সায় থাকলেও যার বাসায় থাকতাম সেই ফুফুর সায় ছিলো না । কারণ, আমি পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম না ছোটবেলা থেকে, কোচিঙের টাকাটা শুধু শুধু নষ্ট হবে – ফুফু ভাইয়াকে এমনটাই বুঝিয়েছিলেন।  ফলে ভাইয়া ভর্তি-পরীক্ষার আগে আমাকে শর্ত দিয়েছিলো আমি যেন অন্তত ইডেনে চান্স পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চান্স পাবো এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। ভাইয়াও না। রেজাল্টের পরে ভাইয়ার সেই কী খুশি! বলেছিলো, 'বু রে, আমি তো পারলাম না, তুই পেরে দেখালি! আব্বু-আম্মুর মুখ তুই রাখলি!' বলতে দ্বিধা নাই, এই চান্স পাওয়াতে আমার ফুফু মোটেও খুশি হননি। প্রায় সর্বত্রই বলে বেড়িয়েছেন, আমি মনে হয় দুই নাম্বারি করে চান্স পেয়েছি। এর প্রমাণ আমি অনেক জায়গাতেই পেয়েছি। কিন্তু ফুফুকে দোষ দেই না। তার নিজের মেয়ে অনেক ভালো ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও তার চান্স হয়নি। মানুষ তো, নিজের কষ্টকে ঢাকনা দিতে মানুষ অনেক ধরনের কষ্ট ছড়িয়ে বেড়ায়।

তবে আমার ব্যাপারে ফুফা খুব আশাবাদী ছিলেন। ফুফার সঙ্গে আমি পড়াশোনার ব্যাপারে খুব আগ্রহের সঙ্গে কথাবার্তা বলতাম। ফুফা আমাকে ম্যাপ দেখে দেখে দেশ, রাজধানী, মহাদেশ, মহাসাগরের জ্ঞান দিতেন। আর এসব আমি এতো দ্রুত আয়ত্ত করতে পেরেছি দেখে নিজের মেয়ের সামনেই খুব প্রশংসা করতেন আমার। ফুফার এটা উচিত হয়নি। তিনি নাকি আমার সঙ্গে আলাপ করে খুব আরাম পেতেন । ফুফা আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছিলেন, কৃতজ্ঞতা ফুফার প্রতি। নিজের একান্ত চেষ্টা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ করে দিয়েছিলো।
 ভালো ছাত্র, বিখ্যাত ছাত্রেরা যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না, সেখানে আমি পেলাম। এই ঘটনায় আমার মতো অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছে। আসলেই, এটা কি শুধু ভাগ্য নাকি চেষ্টার্জিত ভাগ্য? পড়াশোনার এই ভৌতিক স্পিড বিসিএসের প্রস্তুতির সময় এবং সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার সময়ও ভর করেছিলো। বাংলা বিভাগে মোটামুটি ভালো ছাত্রীই ছিলাম। লিটারেচার বুঝতাম, মজা পেতাম, আশা করতাম আরও ভালো করার। কিন্তু ভাগ্যাহত হয়ে বাধ্য হই বিসিএসের প্রিপারেশন নিতে। মনে আছে যখন 'ওরাকল কোচিঙে' ভর্তি হই, তখন ক্ষিতি পেটে। এত্তো বড়ো একটা পেট নিয়ে নিয়ে কোচিং করতাম। আমাকে দেখে সবাই বিস্মিত হতো। কেউ কেউ ভয়ও পেত, যদি কিছু হয়ে যায়! আমি ভয় পেতাম না। আমার কোনো কিছুতেই কিছু হয় না।
 
৩১শ/তম বিসিএস পরীক্ষায় ক্ষিতির জন্মের কাছাকাছি সময়ে প্রথমবারের মতো অ্যাটেন্ড করি। চান্স হয়নি। এরপর ক্ষিতি এলো। ক্ষিতিকে নিয়ে ১৭ দিনের মাথায় বাড়িতে চলে যাই। ক্ষিতিকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে অংক নিয়ে বসতাম, হাগু পরিষ্কার করতে করতে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো মেমোরাইজ করতাম, দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে প্রণালিগুলোর কী অবস্থা চেক করতাম। আমার জগত ছিলো তখন ক্ষিতি আর বিসিএস-প্রস্তুতি। সামাজিকতা, লৌকিকতা করার অতো টাইম ছিলো না। ফলে, প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে আমার সেই সময়ে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিলো, তা পরে শত চেষ্টা করেও কমাতে পারিনি। এই দূরত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্য একজন বেশ ভালোভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তাকেও দোষ দেই না। আমাদের সমাজে আত্মনির্ভরশীল হবার প্রাক্টিস কম থাকায় পুরোপুরি স্বামী-নির্ভর হওয়া অনেক নারীই কর্মজীবী নারীদেরকে সহ্য করতে পারেন না। ফলে, তাদের অনেক রকমের ত্রুটি বিছড়ানো এবং সেগুলো জনসম্মুখে প্রতিষ্ঠা করার একটা ক্ষুদ্রমতি প্রচেষ্টা থাকাই স্বাভাবিক।

মাঝে মাঝে নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হই, এইসব পেছনে-টানা মুহূর্তগুলোকে পাশ কাটিয়ে কী করে নিজের লক্ষ্যের দিকে ভূতের মতো দৌড়েছি। জীবনে প্রচুর দৌড়েছি আমি ভাইয়ার 'মনাভাই' হয়ে।

বিসিএস চাকরির সময় আমি বরের চাকরিসূত্রে ঢাবির ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকতাম। ৪২৩ নাম্বার রুমে। ছোট্ট একটা ছিমছাম ঘর, সাথে একটা কিচেন আর একটা বাথরুম। দুইজনের জন্য একদম পারফেক্ট রুম। এই রুমটি আমার অনেক রকম সংগ্রামের সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষার সংগ্রামেরও সাক্ষী। প্রিলি পরীক্ষার সময় আমার এক দেড় বছরের ছেলে ক্ষিতির পেট খারাপ হয়। সেই অবস্থায় ওর বাবার কাছে রেখে আমি প্রিলি পরীক্ষা দেই, এবং টিকি। রিটেন পরীক্ষার সময় ছেলের আমার প্রচণ্ড অসুখ হয়। ভোকাল কর্ডে সিভিয়ার ইনফেকশান, সাথে প্রবল কাশি। আব্বুর ছাত্রী ডা. শাহিদার শরণাপন্ন হয়ে সেগুনবাগিচাস্থ বারডেমে ভর্তি করাই ক্ষিতিকে। সেখানে আমি আর ক্ষিতির বাবা। আম্মুর স্কুলে তখন অডিট চলে, শাশুড়িদের কেউ একা একা আসতে পারেন না। আর আমাদের দুইজনের পরিবারেই এমন কাউকেই কোনোদিন পাইনি যে আমাদের একটু উপকারে আসবে! ফলে আমাদের ফাইট সবসময় আমরাই করি। জানি না ভবিষ্যতে কী আছে! 

তো, সেই বারডেম থেকে হেঁটে হেঁটে প্রেসক্লাব গিয়ে বাসে উঠে পরীক্ষার ভেন্যু মোহাম্মদপুর যেতাম পরীক্ষা দিতে। সেখান থেকে ইন্টারন্যাশনাল হলের বাসায় গিয়ে বাচ্চার জন্য সবজি খিচুড়ি রান্না করে ব্লেন্ড করে নিয়ে আবার সেগুনবাগিচায় বাচ্চার কেবিনে যেতাম। মাঝখানে ফিডারটাও ফুটিয়ে নিতাম। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। মাথার মধ্যে শুধু ক্ষিতি। সারাদিন ক্ষিতির বাবা একা একা সব সামলেছেন। সন্ধ্যায় আর কিছু পড়া হয়? বাচ্চাকেই সময় দিতাম। এভাবে ছয় দিন চললো। প্রতিবেশী ডেইজি ভাবি আমার অনেক দুঃসময়ের সাহায্যকারী। সেই ভাবিও আমার কষ্ট দেখে বলেছিলেন পরীক্ষা না দিতে। মহাবিরক্ত হয়ে এমনও বলেছিলেন, 'এতো ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করছো, শেষে দেখো এই ক্যারিয়ার ফাঁকা টিফিন ক্যারিয়ার হয়ে না যায়!' ভাবি আমার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারতেন না। ডেইজি ভাবির কাছে আমার অনেক ঋণ। এই লেখার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানাই।

অবশেষে আমি রিটেনেও টিকি।

এলো ভাইভার সময়। ঠিক পনেরোদিন আগে আমার প্রাণের আব্বুটা ফটাশ করে মারা যান। ভাইভাতে কী বলেছি না বলেছি – মাথায় ছিলো রাজ্যের শোক। ভাইভার আগে শুধু কাঁদতাম।
রেজাল্ট হলো। আমি এখানেও টিকলাম।

ভাইয়া এবারও আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলেছিলো, 'বুরে, তুই আব্বু-আম্মুর মুখ রাখছিস, আমি তো কিছুই হতে পারলাম না। ' বলা বাহুল্য এই সময় কিন্তু নানা কারণে ভাইয়ার সঙ্গে আমার অনেক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তারপরেও ভাইয়ার এই উচ্ছ্বাস দেখে আমি খুব আপ্লুত হয়ে পড়ি।  
আজ আমি এই লেখার মাধ্যমে ভাইয়ার কাছে বার্তা পৌঁছাতে চাই – 
ভাইয়া দেখ, আমি কোনো কিছুতেই থামিনি। তোর সেই ছোট্ট 'মনাভাই'টি আজ নিজের আত্মজীবনীও লিখে ফেলছে!

জীবনের কোথাও কোনো আপস করিনি, করবোও না। নিজে অন্যায্য কিছু করলে অনুশোচনায় শেষ হয়ে গেছি। কোনোদিন কাউকে জানতে-অজান্তে কষ্ট দিলে রাজ্যের মর্মপীড়ন বোধ করেছি, কারো কারো কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। তবে ক্ষমা চাইতে গেলেই মানুষ পেয়েও বসেছে, দুর্বল ভেবেছে। এই একটা বিরাট সমস্যা জীবনে। বিনয় দেখালেও সহজলভ্য, সস্তা আর দুর্বল ভাবে। আমি অবশ্য ওসব নিয়ে পড়ে থাকি না। নিজের জগতে ডুবে যাই। 'কিছুই করার নাই' টাইপের অন্যায্যতা দেখে মাঝে মাঝে চুপ থাকি। দূরত্ব বাড়াই। আর, যার যা ইচ্ছা তাকে সেটা ভাবতে সাহায্য করি। কিন্তু জীবন থেকে স্কিপ করিনি। করবোও না হয়তো। হয়তো বলছি কারণ, যেহেতু পৃথিবীতে সত্য বড়ো সাপেক্ষ-চরিত্র, তাই সন্দেহে রেখেই কথা বলা নিরাপদ।
 মান্নাদে'র একটা গান আছে না? – 'সে আমার ছোট বোন, বড়ো আদরের ছোট বোন'! আমাদের দুই ভাইবোনকে একটা সময় পর্যন্ত দেখে এটা যে কেউ বলতো। গানের মতোই দুইজনের একজন চলে গেছে!
এখনও আমি বেঁচে আছি ভাইয়ার 'মনাভাই' হয়ে।

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি