পশ্চিমাদের চেয়ে আমাদের ‘নাম’ এলার্জি বেশি

শিশির ভট্টাচার্য্য

পশ্চিমাদের চেয়ে আমাদের ‘নাম’ এলার্জি বেশি

শিশির ভট্টাচার্য্য

‘কুকুরমারি’, ‘শেয়ালধরা’, ‘চোরের ভিটা’ ইত্যাদি গ্রামনাম হাজার বছর ধরে কারও কাছে শ্রবণকটু মনে হয়নি। হঠাৎ এসব নাম পরিবর্তনের হুজোগ উঠেছে বাংলাদেশে। নতুন নাম রাখা হচ্ছে, ‘শান্তিপুর’, ‘আদর্শনগর’ ইত্যাদি। এমন পরিবর্তন বাংলাদেশেই শুধু সম্ভব।

পাশ্চাত্যে এতো সহজে ব্যক্তি বা স্থানের নাম পরিবর্তন করা যায় না। কারণ টোপোনিমিক্যাল কমিশন সহজে অনুমতি দিতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গের ‘শেয়ালদহ’ স্টেশনের নাম পরিবর্তনের কথা কি ভাবা যায়?  নামের সঙ্গে এলাকার ইতিহাস জড়িত থাকে। ধরা যাক, উপজেলার নাম ‘বোদা’।
শব্দটি দিয়ে বাংলার কোনো উপভাষায় ‘যোনি’ বোঝায় বলে পুরো নামটি বদলে ‘গোলাপনগর’ বা ‘শিমুলপুর’ রাখতে হবে? ‘বোদা’ শব্দটি সম্ভবত এমন কোনো আদিবাসী ভাষার যে ভাষাভাষীরা ছিল বাঙালির অন্যতম পূর্বপুরুষ। শব্দটি বাদ দেওয়া মানে বাংলা ভাষার সঙ্গে সেই ভাষার সম্পর্কটা চিরতরে ছিন্ন করে দেওয়া।  
মন্ট্রিয়লে একটি বিখ্যাত সড়কের নাম ‘ভেজিনা রোড’। এই রাস্তায় প্রচুর বাঙালির বাস এবং যদিও রাস্তার এই নামের সঙ্গে যোনির কোনো সম্পর্ক নেই, এই নাম নিয়ে বাঙালিদের কমবেশি লজ্জা পেতে দেখেছি। পারিবারিক নাম যতো অশ্লীলই হোক না কেন, কানাডা বা ফ্রান্সে সেই নাম আপনি সহজে বদলাতে পারবেন না, কারণ নামের সঙ্গে ইতিহাস জড়িত। ইংরেজিতে কমপক্ষে ১৯০টি পারিবারিক ও স্থাননাম যৌনগন্ধী। ‘ডিক’, ‘লিক’, ‘কক’ পারিবারিক নাম এবং এই সব নাম নিয়ে দারুণভাবে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন এই সব পরিবারের হাজার হাজার সদস্য। হাত, পা, মাথা ইত্যাদি অঙ্গ দিয়ে যদি ব্যক্তি বা স্থানের নাম হয়, যোনি বা লিঙ্গ দিয়ে হলে কী সমস্যা? যে অঙ্গ দিয়ে নির্গত হয়ে মানুষ তো বটেই, প্রাণিমাত্রেই পৃথিবীর আলো দেখছে, সেই অঙ্গ-দ্যোতক শব্দ অশ্লীল হওয়া মানে নিজের জন্মটাই অশ্লীল হওয়া। জন্ম এবং যৌনতা নিয়ে এই সব ট্যাবু, কুসংস্কার ও ভণ্ডামির অবসান হওয়া প্রয়োজন।  
ইংরেজিতে ‘ভ্যাজাইনা’, ‘পেনিস’ বা বাংলায় ‘যোনি’ বা ‘লিঙ্গ’ শব্দ আছে এবং শব্দগুলো নিয়ে এতো ‘ঢাক ঢাক গুড় গুড়’ মানসিক স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়। কোনারক-খাজুরাহোর মন্দিরগাত্রের অলঙ্করণ, দেবমূর্তি শিবলিঙ্গের গঠন ইত্যাদিতে উপমহাদেশে হাজার বছর আগে যৌনতা সম্পর্কে বিদ্যমান সুস্থ মানসিকতার প্রতিফলন হয়েছিল। বাংলাদেশের তথাকথিত আধুনিক মানুষ মানসিকতার দিক থেকে ভণ্ড বলে তাদের ভাষাতেও ভণ্ডামির অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। ‘কুকুরমারি’ শব্দ বাদ গেলেই কুকুরের প্রতি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঘৃণাত্মক মানসিকতার অবসান হবে না। নাম বদলানোই প্রমাণ করে যে কুকুর প্রাণিটা আমাদের পছন্দ নয়। ‘কুত্তার বাচ্চা’ গালিটাও কি এর প্রমাণ নয়? নাম বদলালেই কি কাম বদলাবে? ‘চোর’ যদি আসলেই ঘৃণিত পেশা হতো, চোরের এমন উচ্চফলন হলো কী করে বাংলাদেশে? ঢাকা শহরের দামি এলাকাগুলোতে প্রচুর চোরের বাড়ি, চোরের ভিটা আছে এবং বহাল তবিয়তেই আছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য মানুষ এতোটাই ক্ষতিকর এক প্রাণি যে শিয়াল-কুকুরদের যদি ভাষাবোধ থাকতো, ‘মানুষের বাচ্চা’ গালিটা তারা আদৌ পছন্দ করতো কিনা সন্দেহ আছে!
 লেখক: ভাষাবিজ্ঞানী।

news24bd.tv/ডিডি

সম্পর্কিত খবর