নবীজি (সা.)-এর প্রতি নারী সাহাবিদের ভালোবাসার অপূর্ব নজির

প্রতীকী ছবি

নবীজি (সা.)-এর প্রতি নারী সাহাবিদের ভালোবাসার অপূর্ব নজির

 শরিফ আহমাদ 

রাসুল (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। তাঁকে ভালোবাসা ছাড়া পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া যায় না। পুরুষ সাহাবিদের রাসুলপ্রেমের দৃষ্টান্তের কথা আলোচিত হলেও নারী সাহাবাদের রাসুলপ্রেম নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না । অথচ রাসুলের প্রতি তাঁদের ত্যাগ, অবদান ও আনুগত্যের নজির ছিল অতুলনীয়।

কয়েকটি বর্ণনা তুলে ধরা হলো :

মসজিদের মিম্বার নারীর দান

মসজিদ-ই-নববীতে মিম্বার তৈরির আগে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি খেজুরগাছের গুঁড়ির ওপর ভর দিয়ে জুমার দিনে খুতবা দিতেন। একসময় রাসুল (সা.) মিম্বারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখন এক নারী সাহাবি খিদমতের নিয়তে এগিয়ে আসেন। আবু হাজিম ইবনে দিনার (রহ.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আনসারদের এক নারীর কাছে লোক পাঠিয়ে বলেছিলেন, তোমার কাঠমিস্ত্রিকে আমার জন্য কিছু কাঠ দিয়ে এমন জিনিস তৈরি করার নির্দেশ দাও, যার ওপর বসে আমি লোকদের সঙ্গে কথা বলতে পারি।

এরপর ওই নারী তাকে আদেশ করেন এবং সে (মদিনা থেকে ৯ মাইল দূরবর্তী) গাবা এলাকার ঝাউ কাঠ দিয়ে তা তৈরি করে নিয়ে আসে। মহিলাটি রাসুল (সা.)-এর কাছে তা পাঠিয়ে দেন। নবীজির আদেশে এখানেই তা স্থাপন করা হয়। এরপর আমি দেখেছি, এর ওপর রাসুলুল্লাহ নামাজ আদায় করেছেন, এর ওপর উঠে তাকবির দিয়েছেন এবং এখানে (দাঁড়িয়ে) রুকু করেছেন।

এরপর পেছনের দিকে নেমে এসে মিম্বারের গোড়ায় সিজদা করেছেন। এবং (এ সিজদা) আবার করেছেন। এরপর নামাজ শেষ করে সমবেত লোকদের দিকে ফিরে বলেছেন, হে লোক সকল! আমি এটা এ জন্য করেছি যে তোমরা যেন আমার ইক্তিদা করতে পারো এবং নামাজ শিখে নিতে পারো। (বুখারি, হাদিস : ৯১৭)

আনুগত্যের অপূর্ব নজির

রাসুল (সা.)-এর যুগে বিশেষ প্রয়োজনে নারীদের মসজিদে আসার অনুমতি ছিল। তারা সবাই নিয়ম মেনে আসা-যাওয়া করত।

কিন্তু একদিন রাসুল (সা.) দেখলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক চিত্র। আবু উসাইদ আনসারি (রা.) বলেন, তিনি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছেন, যখন তিনি মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখতে পান যে পুরুষরা রাস্তার মধ্যে নারীদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তখন রাসুল (সা.) নারীদের বলেন, তোমরা অপেক্ষা করো! তোমাদের রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করা উচিত নয়, বরং তোমরা রাস্তার এক পাশ দিয়ে যাবে। এরপর নারীরা দেয়াল ঘেঁষে চলাচল করার ফলে বেশির ভাগ সময় তাদের কাপড় দেয়ালের সঙ্গে আটকে যেত। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৭২)

নবীর প্রতি তারা কতটা আনুগত্যশীল ছিল হাদিসটি থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

উপহার হলো দাফনের কাপড়

প্রিয়জনকে উপহার দেওয়া উত্তম কাজ। উপহার পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা বাড়ায়। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখে। রাসুল (সা.)-কে নারী সাহাবিরা বিভিন্ন উপহার দিতেন। তিনি সানন্দে গ্রহণ করতেন। তিনিও উপহার দিতেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, একজন স্ত্রীলোক একটি বুরদা নিয়ে এলো। সাহল (রা.) বলেন, তোমরা জানো বুরদা কী? একজন জবাব দিল হ্যাঁ ! বুরদা হলো, এমন চাদর, যার পাড় কারুকার্যময়। স্ত্রী লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এটি আমার নিজের হাতে বুনেছি আপনাকে পরিধান করাবার জন্য । রাসুল (সা.) তা গ্রহণ করলেন। তখন তার প্রয়োজনও ছিল। এরপর তিনি আমাদের কাছে বেরিয়ে আসলেন। তখন সে চাদরটি ইজার হিসেবে তার পরিধানে ছিল। দলের এক ব্যক্তি হাত দিয়ে চাদরটি স্পর্শ করল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে এটি পরতে দিন। তিনি বলেন, হ্যাঁ।

এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) মজলিসে বসলেন যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা ছিল। তারপর উঠে গেলেন এবং চাদরটি ভাঁজ করে এই ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। উপস্থিত লোকেরা বলল, নবীজি (সা.)-এর কাছে এটি তুমি চেয়ে ভালো করনি। তুমি তো জানো যে কোনো প্রার্থীকে তিনি ফিরিয়ে দেন না। লোকটি বলল, আল্লাহর কসম আমি কেবল এ জন্যই চেয়েছি, যে দিন আমার মৃত্যু হবে সেদিন যেন এ কাপড়টি আমার কাফন হয়। সাহল (রা.) বলেন, এটি তার কাফন হয়েছিল। (বুখারি, হাদিস : ৫৮১০)

রাসুল (সা.)-এর পরামর্শে বিয়ে

বিয়ে নারী-পুরুষ সবার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। সুখী জীবন গঠনে উত্তম সঙ্গী সবাই প্রার্থনা করে। আকাশ-পাতাল ভেবে সম্পর্কে জড়ায়। এমন স্পর্শকাতর বিষয় নবীর হাতে ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করার নজিরও স্থাপন করেছেন নারী সাহাবীরা। প্রসিদ্ধ দুটি বর্ণনা থেকে একটি এ রকম, ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.) ছিলেন হিজরতকারী নারীদের অন্যতম। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অঢেল ধন-সম্পদের অধিকারী।

অন্যদিকে রাসুল (সা.) উসামা ইবনে জায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা.)-এর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ফাতিমা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর এ বাণী শুনেছিলাম, যে আমাকে ভালোবাসে সে যেন উসামাকেও ভালোবাসে। তাই তিনি যখন উসামা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলেন, আমি তখন বললাম, আমার বিষয়ে আপনার হাতে সোপর্দ করলাম। আপনি যার সঙ্গে ইচ্ছা আমাকে বিয়ে দিন। (নাসায়ি, হাদিস : ৩২৩৭)

শোক হয়ে যায় শক্তি

রাসুল (সা.)-এর সুন্নত মেনে চলাই প্রকৃত উম্মতের কাজ। নারী সাহাবীরা তাঁর আদেশ পালনের মাধ্যমে গভীর ভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। প্রিয়জন হারানোর শোকপ্রথা ভেঙে শক্তিতে পরিণত করেছেন। যখন জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর ভাই ইন্তেকাল করল। মৃত্যুর পর চতুর্থ দিন তিনি সুগন্ধি ব্যবহার করে বলেন, সুগন্ধি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন আমার ছিল না। তবে আমি নবীজির কাছে শুনেছি, কোনো নারীর জন্য স্বামী ছাড়া অন্যের মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ করা বৈধ নয়। শুধু এ হুকুম পালনের জন্যই আমি এমন করেছি। (আবু দাউদ, হাদিস : ২২৯৯)

এভাবেই নারী সাহাবারা নবীজির প্রতি ভক্তি, অনুরাগ ও আনুগত্য প্রকাশ করেন।