শঙ্কায় থাকা নারীরা চান সুষ্ঠু ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা

ছবি- সুমন শিকদার।

শঙ্কায় থাকা নারীরা চান সুষ্ঠু ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা

সুমন সিকদার, বরগুনা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের সমীকরণে বরগুনা-১ (বরগুনা সদর-আমতলী-তালতলী) আসনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন নারী ভোটাররা। অথচ এই নারী ভোটাররাই ভোট কেন্দ্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করছেন।

বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, প্রচার প্রচারণায় ক্ষমতাসীনদের হুমকি ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নারী ভোটারদের অনেকেই ভোটাধিকার প্রয়োগে নিরুৎসাহী হয়ে উঠেছেন। বরগুনা-১ আসনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

বরগুনা সদর, আমতলী ও তালতলী এই তিন উপজেলা নিয়ে গঠিত বরগুনা-১ আসন। আয়তন ও ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় দেশের শীর্ষ আসনগুলোর মধ্যে বরগুনা-১ আসন অন্যতম। এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯১০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৪ জন ও ২ লাখ ৪২ হাজার ১৬৬ জন নারী ভোটার রয়েছে।

অর্থাৎ, পুরুষের তুলনায় এ আসনে নারী ভোটার সংখ্যা বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিটি নির্বাচনে নারী ভোটাররা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরগুনা-১ আসনের বিভিন্ন এলাকার নারী ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়ে চিত্র তুলে এনেছে এই প্রতিবেদক। প্রতি ১০জন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদের মধ্যে দুজন নারী ভোটার কারও সহযোগিতা ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী। তবে নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত তারা। এছাড়া তিনজন হ্যাঁ বা না, কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এরা পুরুষের ইচ্ছে অনিচ্ছার প্রতি নির্ভরশীল। অর্থাৎ, এই নারীদের অভিভাবক চাইলে ভোট দিতে যাবেন, না চাইলে যাবেন না। বাকি পাঁচ নারী সাফ জানিয়েছেন, তারা ‘নিরাপত্তার ভয়ে’ ভোট দিতে যেতে চান না।

বরগুনা সদর উপজেলার প্রত্যন্ত জনপদ ঢলুয়া ইউনিয়নের ডালভাঙা এলাকা। এই এলাকার একজন গৃহবধূ পারভীন আক্তার যার স্বামীর পেশা নদীতে মাছ শিকার করা। ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী কিনা জানতে চাইলে পারভীন বলেন, ‘হ্যারা যেইরহম হুমকি ধামকি দেয় মোবাইলে দেহি, হ্যাতে মুই এবার ভোট দেতে যামনুা। গ্যাছে বচ্ছর (একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে) হ্যার (স্বামীর) কতায় ভোট দেতে যাইয়া ফিররা আইছি। মোর ভোট বোলে দেওয়া অইয়া দিয়া গ্যাছে। এবারও যা দ্যাকতে আছি, হ্যাতে মোর মোনে অয় যে সেন্টারে যাইয়া মোর ভোটটা মুই দেতে পারমু না। ’

একই প্রশ্ন করা হয় পারভীনের প্রতিবেশী মাকসুদা বেগমকে। মাকসুদা বলেন, মোগো ভোট দেলেও বা কি না দেলেও বা কি। হুনছি বোলে এবারও হ্যারা (ক্ষমতাসীনরা) রাইতে নিজেরা ভোট দিয়া লইবে, নাইলে কাইট্টা লইয়া যাইবে। ফাও কষ্ট করে হইর‌্যা কেডা ভোট দেতে যাইবে। ’

জেলার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া এলাকার জেলে পল্লীর কয়েকজন নারীর সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের। ওই নারীরা অবশ্য জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাদের স্বামীর সঙ্গে গিয়ে স্বামীর পছন্দমত প্রার্থীকেই ভোট দিয়ে আসছেন। সংসদ নির্বাচনেও স্বামীর পছন্দের প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে। এদের মধ্যে একজন নিলুফা বেগম বলেন, ‘মোরা হারাজনম হ্যার (স্বামীর) কথামত প্রার্থীরে ভোট দিয়া আইছি। এইবারও তাই হবে।

ভোটাধিকার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভরশীল নন, এমন কয়েকজন নারী জানান, প্রচার-প্রচারণায় যেমন পরিবেশ, এখনো ভোট দিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তারা সিদ্ধান্তহীন। আমতলী উপজেলার চাওড়া এলাকার বাসিন্দা রেজওয়ানা পারভীন (৩৪)। ভোট দিতে যাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন ‘অবশ্যই যাওয়া উচিত। এটা নাগরিক অধিকার। তবে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারণ, প্রার্থীরা পরস্পরকে যেভাবে হুমকি ধামকি দিচ্ছে, এতে এখনো নিরাপদ বোধ করছি না। তবে ভোটের দিন ভোট দিতে যাবো মানসিকভাবে এমন প্রস্তটি নিয়ে রেখেছি। ’ একই রকম বক্তব্য পাওয়া গেছে আরও বেশ কয়েকজন নারীর।

বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন নারীপক্ষের প্রকল্প সমন্বয়কারী সামিয়া আফরিন বলেন, প্রতিটি নির্বাচনেই নারীরা ভোটের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তবে আমাদের নারীদের একটা বড় অংশ এখনো নির্ভরশীল ব্যক্তির মতামতে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধ্য হন। আবার অনেকে নিরাপত্তার ভয়ে কেন্দ্রে যেতে চান না। তবে কিছু নারী আছেন, যারা যেকোনো পরিবেশে স্বাধীন মত প্রকাশ করেন। তবে এমন নারীর সংখ্যা খুব কম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হবার মত কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করছি না। নারীদের উচিত ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। নিজের পছন্দ মতো প্রার্থী নির্বাচনে ভূমিকা রাখা। ’

বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, বরগুনার দুটি আসনেই সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারী ভোটারদের মুখ্য ভূমিকা থাকে। সেই জায়গা থেকে বিবেচনা করলে গত দুটি নির্বাচনেই বরগুনায় নারী ভোটাররা ঠিক মতো ভোট প্রদান করতে পারেননি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন কমিশনের যে তৎপরতা আমরা দেখেছি তাতে এবার অন্তত আশা করা যায় একটি সুষ্ঠু ভোট বরগুনায় হবে। তবে প্রশাসনকে ৭ জানুয়ারি নারী ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান করতে পারে তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বরগুনা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, নারী ভোটারদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধকরণে আমরা বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। এছাড়াও বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর মাধ্যমেও নারীদের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধকরণ করা হয়েছে। এর বাইরেও প্রার্থীদেরকেও বলা হয়েছে যাতে নারীরা নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ বজায় রাখতে।

তিনি আরও বলেন, সকল ভোটার যাতে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে বিষয়টি বিবেচনা করে নির্বাচনকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন বদ্ধপরিকর।

news24bd.tv/SHS