প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

অলংকরণ:কামরুল

কিস্তি-৪

প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

অনলাইন ডেস্ক

আদর করতো সবাই, কিন্তু সেটা শুধু গায়ের রঙের জন্য যে, তা না। দেখতে তথাকথিত কিউট ছিলাম। কিউট বাচ্চাদের আদর করার প্রবৃত্তি মানুষের অন্তর্গত আদি-অভ্যাস আর সামাজিক রেওয়াজও। কিন্তু প্রায় কোনো ব্যাপারেই খুব একটা যত্নবান ছিলাম না।

সেটা খুব একটা টেরও পেতাম না। আমি ওসবকিছু না বুঝেই পাড়া বেড়াতাম। বুঝতামই না যে আব্বু-আম্মুর স্ট্যাটাসের বাচ্চাদের এভাবে তুলনামূলক ‘নিম্নশ্রেণি’র বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে নেই! পরিত্যাক্ত ভাঙা দালানের পান-খাওয়া কালো দাঁতের বেগমের মায়ের হাতের ডাল আর রুটি খেতে আমার কোনো অসুবিধাই হতো না। মা বাসায় থাকতেন না দীর্ঘ একটা সময়।
এই সুযোগে বা অভাবে আমি যেখান থেকে একটু স্নেহ পেয়েছি, বসে গেছি তাদের কাতারে। বেগমের এই মাকে আমাদের ওখানে কেউই পছন্দ করতো না। করার কথাও না। প্রকাশ্যে বা গোপনে বেগুনি ও সবুজ কমদামি এক কালারের শাড়ি-পরিহিতা এই নারী কী করতো ঠিক জানি না; তবে তিনি দেখতে অন্যদের মতো ছিলেন না, আচরণেও না। অস্তিত্বের লড়াইয়ে খুব সাংঘাতিক রকমের অনুভূতিশীল। অল্পতেই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতেন। গায়ের রং ঘোর কালো, মাথায় পাতলা কোঁকড়ানো তেল-চিটচিটে চুল, হাসলে দাঁত দেখা যেতো না। মনে হতো ফিলিস্তিনের কোনো তরমুজ খেতে পঁচে যাওয়া তরমুজের বিচিগুলো একসঙ্গে অসহায় মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এমন নারীর কাছ থেকে আমি কখনোই অবহেলা পাইনি। বেগমের মা আমাদের তুলনায় দরিদ্র ছিলো, ঠিক এই কারণই তো যথেষ্ট ছিলো আমাকে অবহেলা,অযত্ন করবার জন্য। কিন্তু শিশু যে সমাজের কোনো পরিবারের একক আদর ও অধিকারের বস্তু নয়, সেটা আমি বেগমের মায়ের কাছ থেকে দেখেছি।  দেখা যেতো ঘরে দুটো রুটিই আছে, তিনি তার মেয়েকে একটা এবং আমাকে একটা খেতে দিয়েছেন। আমি তার মেয়ে নাজমার সঙ্গে প্রাইমারিতে থাকাকালীন বেশ কিছু সময় ওই ভাঙা দালানেই কাটাতাম। এর জন্য ঢাকাইয়া নীহার আপারা (সখি সুমনির বড়ো বোন) এবং সালাম স্যারের মেয়ে লিচু ফুফুরা আমাকেও বেগমের মায়ের মেয়ে, অর্থাৎ নাজমা এবং বেগমের বোন ডাকতো। আমি ঠিক বুঝতাম না এতে আমার রাগ হওয়া উচিত ছিলো কিনা। কিন্তু আম্মু-আব্বু খুব অপমান বোধ করতেন এতে। সেটা করবারই কথা। সদ্য-শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তাদের গা থেকে দারিদ্র্যোর গন্ধ দূর করার জন্য গরিব-সংশ্রব থেকে দূরে থাকা এবং অপেক্ষাকৃত ‘বড়োলোক’ শ্রেণির সঙ্গে মেলামেশা করার ঝোঁক গড়ে তোলে। আব্বু-আম্মুর অবশ্য ‘বড়োলোক’-সংশ্রব থেকে শিক্ষিত-ভদ্রলোক-সংশ্রবের দিকেই বেশি ঝোঁক ছিলো।

আরও পড়ুন:ভাইয়ার 'মনাভাই'

তুলনামূলক শিক্ষিত ভদ্রলোক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন প্রতিবেশী সালাম স্যার। চলে যেতাম সালাম স্যারের বাড়িতে। প্রায়ই ভোরে সালাম স্যারের স্ত্রীর হাতে বানানো দুধ চা আর মুড়ি খেতাম। সালাম স্যারের স্ত্রী হয়তো ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হতেন, কিন্তু চা-টা তিনি খুব যত্ন করেই দিতেন।

আবার কখনো কখনো অপেক্ষাকৃত কম ‘ভদ্রলোক’ প্রতিবেশী বাঁশি চাচাদের (সখি নিপার বাবা) বাড়িতে চলে যেতাম। মাঠ থেকে খুঁটে আনা পাঁচমিশালি শাক আর জাউ ভাত খেত ওরা প্রায়ই। লাল চালের জাউভাত আর সেই শাকের স্বাদ আমি এ জীবনে ভুলবো না।

এরা প্রত্যেকেই হয়তো বিরক্ত হতেন, কিন্তু তাদের যত্নটা ছিল রিয়েল।

মা আমাকে ‘উড়নচণ্ডী’, ‘পাড়াবেড়ানি’, ‘ঘোড়া-মেয়ে’ বলতেন হরদম। আমি আসলে ছিলামও তাই।  আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গার মতো পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে দুনিয়ার সবকিছু দেখে বেড়ানো। শুধু পাড়ায় পাড়ায় না, কোথায় মাটির নিচে বড়ো বড়ো নৌকা খুড়ে পাওয়া গেছে, হাসপাতালের বাগানের রানিগোলাপ গাছে কয়টা গোলাপ ফুটেছে বা তার গন্ধ কতোদূর পর্যন্ত ছুটেছে, কে কবে বিষ খেয়েছে, কে মারা গেছে ভোরে – আব্বু-আম্মু ঘুমে থাকতেই আমি চলে যেতাম এসব দেখে বেড়াতে। প্রতিবেশী ‘ঢাকাইলে’ (ঢাকাইয়া বলে কিছু বাড়ি ছিলো আমাদের বাড়ির পাশেই, যাদের আদিবাস মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে) একটা মেয়ে সুমনি (ভালো নাম সুবর্ণা খান), হেলথ ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ে রূপা, ‘বাঁশির মাইয়ে’ নিপা, আর ভাঙা দালানের ‘ব্যাগমের মার মাইয়ে’ নাজমা ছিলো আমার খেলার সাথি। এছাড়াও আজিজ স্যারের মেয়ে মুক্তার সঙ্গেও খেলতাম। ‘খুটিমুচি’, ‘জামাই-বৌ’, ছি-বুড়ি, সাত-পাতা, দাড়িয়াবান্দা, বাস-বাস খেলতাম। এর মধ্যে সব থেকে বেশি খেলা হতো জামাই-বৌ আর দাড়িয়াবান্দা। আমার কাজ ছিল বরাবরই বৌ সাজা। নাজমা, নিপা, সুমনিদের বৌ হতাম শুধু। মাথায় লাল গামছা দিয়ে চুল বানাতাম আর ঢঙ করে কথা বলতাম। রান্না করতাম কচুরিপানার মাংস, ধঞ্চের ডাল, পিঁপড়ার মাটির পোলাউ। কখনো কখনো মাথায় কলাপাতা দিয়েও চুল বানাতাম। চাকরির কারণে আব্বু-আম্মু বাসার বাইরেই থাকতেন দিনের বেলা। সেই ফাঁকে স্কুল ছুটির সাথে সাথে আমি আমার এইসব সখিদের নিয়ে আসতাম বাসায়।

আরও পড়ুন:‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

এদের মধ্যে ভাঙা দালানের নাজমা, আর বাঁশির মেয়ে নিপার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। পড়াশোনাও তেমন একটা করতো না। মুক্তা আর সুমনির লেখাপড়ার অবস্থাও সুবিধার ছিলো না খুব একটা। তবে বিত্তে আমাদের শ্রেণির সঙ্গে মিলতো। আর রূপা ছিলো তুলনামূলক আমাদের থেকে ভালো। ফলে বাসা থেকে রূপা ছাড়া আর প্রায় সবার সাথেই মিশতে মানা করা হতো। প্রতিবেশীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত সালাম স্যার আর পোস্টমাস্টারের পরিবার থেকে আম্মু-আব্বুকে আমার এসব সঙ্গ পরিহার করতে বলা হতো।

প্রচুর মার খেয়েছি আমি এদের সঙ্গে ঘুরতে যাবার কারণে। অবশ্য শিক্ষিত ও নব্য-সচ্ছল পরিবারের তথাকথিত ‘কিউট’ মেয়েটা এভাবে ঘুরে বেড়াবে, সেটা কোনো মা-বাবাই চাইবেন না। শীতের দিনে আমার গাল আর পা ফেটে থাকতো খিরাইয়ের চামড়ার মতো। কতোবার যে এর জন্য আম্মুর কাছে মার খেয়েছি তার নান্দনিক ও সাংকেতিক হিসাব করার জন্য মৃত অ্যালেন টিউরিঙকে ভাড়া করতে হবে।

পাড়াবেড়ানো দমাতে ও পড়ায় মনোযোগ ফেরাতে আব্বু কম চেষ্টা করেননি ছোট বেলায়। আমার সহপাঠী জর্জ একাডেমির হুজুর স্যারের ছেলে চঞ্চলকে ডেকে আনতেন অংক বোঝানোর জন্য। যাতে আমিও বসি। অশোক স্যারের মেয়ে মৌসুমীকে আনতেন। কোনো কিছুতেই আমি দমিনি। ‘টম এন্ড জেরি’ কার্টুনে জেরির চেয়ে ছোট একটা সাদা রঙের জেরি থাকতো না? আমার দুর্দমনীয় পাড়া-বেড়ানোর ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা ওর মতো লাগে।

আরও পড়ুন: ‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

ক্লাস টুতে যখন পড়তাম, সাক্ষাৎ হয়েছিলো একজন ভালো ছাত্রী মোসলেমা হোসেন তান্নি এবং একজন ভালো ছাত্র মো. সাইদুজ্জামানের সঙ্গে। এদের দুইজনই রোল নিয়ে খুব কম্পিটিশনের মধ্যে থাকতো। কখনো একজন প্রথম হতো, অন্যজন দ্বিতীয়। আমার রোল হতো বত্রিশ-তেত্রিশ। তবু আমি এদের মধ্যে ঢুকে পড়ি ভিন্ন কারণে।  

প্রিয় পাঠক, আপনারা কি ভাবছেন না যে ভালো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে একজন খারাপ ছাত্রী কী করে ঢুকে পড়ছে?

জ্বি, আমি অবধারিতভাবে ঢুকে পড়েছি। এবং সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক ও বাজেভাবেই।
ভালো ছাত্রী তান্নির মা ছিলেন আমার মায়ের সরাসরি ছাত্রী। সে যখন খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করে ভালো ফল করছে, সেখানে আমি পাট-কাঠির মাথায় জিকার আঠা লাগিয়ে জার্মানি লতার ফুলের ওপর বসে থাকা রঙ-বেরঙের ফড়িঙ ধরে বেড়াচ্ছি। খেজুরের বিচির চারগুটি খেলছি, ইটের খোয়া দিয়ে বানানো পাঁচগুটি খেলে বেড়াচ্ছি। বাজারের রাইপুরের অচ্ছুত বুনো স্টুডেন্টদের সঙ্গে কুতকুত খেলছি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে। আমার নামের সঙ্গে যে এসব বিষয় যায় না, সেজন্য তান্নি আমাকে ‘সেনজুতি’ বলে প্রায়ই বিদ্রূপ করতো। বলতো, ‘সেনজুতি’ একজন চন্দ্রবিন্দু-যুক্ত সম্মানিত ব্যক্তি – কাদের সঙ্গে খেলে, কী করে এইগুলা? আমি জোঁকের মাথায় লবণ দেবার মতো সারাক্ষণ চুপসে থাকতাম। তখন আমার মায়ের মান-সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকত এবার বুঝুন তো? আমি উড়নচণ্ডী হই আর যাই হই, নামটা তো আমার মায়েরই রাখা!  জন্মসূত্রে সম্ভ্রান্ত না হতে পারি, কিন্তু শিক্ষিত পরিবারের সন্তান তো ছিলাম। ফলে, আম্মু-আব্বুর কাছ থেকে পড়ার জন্য হিউজ পরিমাণ নিন্দাবাদ সহ্য করেছি। তখন থেকেই আদরের ঝোলে টান পড়া শুরু হয়।
দাদি শুধু বিয়ে দিয়ে দিতে বলতেন। কারণ, দাদির নিজের বিয়ে হয়েছিলো মাত্র ৯ বছর বয়সে। ফলে, নাতজামাই দেখার শখ থেকে তিনি শুধু বিয়ের কথা পাড়তেন।  

প্রাইমারি স্কুলে আরও দুজন ভালো ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। কিন্তু সেই পরিচয় আরও পুষ্ট হয়েছে বড়ো হয়ে। একজন হেলথ ইঞ্জিনিয়ারের মেয়ে রূপা, আর অন্যজন এক সরকারি অফিসারের (পদ মনে নাই) ছেলে তৈমুর রেজা। দুইজনেই ক্লাস থ্রিতে বাবার বদলিসূত্রে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু বড়ো হয়ে এই দুজনের সঙ্গে আমার অন্যরকম সখ্য তৈরি হয়। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম না, কিন্তু আমার ছিলো দুনিয়াদারি দেখার জন্য চোখ। সেটা ওদের দুইজনেরও ছিলো। ফলে কেতাবি বিদ্যা-শিক্ষার বাইরে জ্ঞানজগতের এক-আধটু চর্চা আমি ওদের সঙ্গে করতে পেরেছি। আর তৈমুরের সঙ্গে পুনঃযোগাযোগ হয় আমার বিয়ের পরে আমার স্বামী মোহাম্মদ আজমের সূত্রে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে বসে তৈমুরসহ অনেকের সঙ্গে আমি আর আমার স্বামী আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমাদের একই প্রাইমারি স্কুল আবিষ্কৃত হয়ে যায়। স্কুলের অংকের রব স্যারের কড়মড়ে মেজাজের কথা আমরা দুজনেই স্মরণ করলাম। একবার স্যারের ক্লাসে আমি ওয়াশরুমে যাবার নাম করে বেরিয়ে গিয়ে আর ফিরিনি। কারণ, স্কুলের ওয়াশরুমের পাশেই একটি জলায় একটা ডাল বা কিছুর ওপর একটা কচ্ছপ দেখতে পেয়েছিলাম। কচ্ছপ আমি জীবনে ওই প্রথমবার দেখি। তাই কচ্ছপটা আমাকে অদৃশ্য শেকলে আটকে রেখেছিলো। আমার দেখাদেখি একে একে ক্লাসের অধিকাংশই বেরিয়ে এসে কচ্ছপ দেখছিলো। রব স্যার তো সেই রাগ! স্যারও রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বেরিয়ে এলেন। উনি আসামাত্রই কচ্ছপটা টুপ করে পানিতে ডুব দিয়ে দিলো। ব্যাস, আর যাবে কোথায়! রব স্যার একে একে প্রত্যেককেই বেত দিয়ে পিটিয়ে ক্লাসে ঢোকালেন। রূপা আর তৈমুর রেজাও ওই দর্শকশিশুদের মধ্যে ছিলো। কে কে ওবেলা রব স্যারের ঝাঁঝালো বেতের টেস্ট পায়নি তা মনে করতে পারছি না, তবে তান্নি আর সাইদুজ্জামান যে পায়নি তা নিশ্চিত।
রূপা শুধু আমার বেতের টেস্ট খাওয়া, পড়ার সহপাঠী আর খেলার সাথিই ছিলো না, ও ছিলো আমার আত্মার বন্ধু।

প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়েছে হাতে গোনা দুই চারজনের সঙ্গে। তাদের মধ্যে ‘রূপা’ নামটা অন্যতম নানা অর্থে।

রূপাকে গানের শিক্ষক দেয়া হলো। গলা ভালো না। তার মায়ের খুব ইচ্ছা মেয়েকে গান শেখানো। ওকে রূপকুমার স্যার শেখাতেন। আমাকে শেখাতেন তারাপদ স্যার। রূপার মা আমার গান শেখাকে খুব পছন্দ করতেন। ভদ্রমহিলা আমাকেও খুব পছন্দ করতেন। আমার পাড়া-বেড়ানোর আরেকটি ক্ষেত্র ছিলো রূপাদের সরকারি বাসা। অপেক্ষাকৃত উন্নত রুচির মানুষ ছিলো ওরা। আমাদের টিনের চালের ঘরে দারিদ্র্যতমুক্তির আভাস ছিলো, কিন্তু আভিজাত্যের পরশ কিছুতেই ছিলো না। ফলে, রূপাদের বাসায় আমি একদম পড়ে থাকতাম। প্রচুর মারও খেতাম। মানুষের বাসায় এভাবে পড়ে থাকে কেউ? আম্মুর বাসায় না থাকার দায়কে কোনো যুক্তিতেই কার্যকর করা যাবে না। কারণ ভাইয়াও তো মা-ছাড়া থাকতো, ভাইয়া তো এভাবে পাড়া বেড়াতো না!

রূপাদের বাসায় প্রথম যখন ফ্রিজ দেখলাম, বিশেষ করে গরম কালের রোজায়, তখন মনে হতো রূপাদের বাসায় স্বর্গ আছে। গিয়ে গিয়ে ফ্রিজের পানি খেতাম। আর ভিসিপিতে ‘সাজন’ মুভি দেখতাম। আমার কাজ ছিলো যেন সবকিছু শুধু দেখে যাওয়া। দেখাতে আমার মতো লিপ্ত মনে হয় কেউ হয়নি কোনোদিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু খুশি আর সিলভিয়া আমার তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটাতে খুব আনইজি ফিল করতো। এটা বহুবার ওরা বলেছে আমাকে। বলতো, ‘এই সেঁজুতি, প্লিজ তুমি এভাবে তাকিয়ে দেখো না, মনে হয় নাড়িভুড়িসহ সব দেখে নিচ্ছো। ’
 
এই সত্য কথাটা খারাপ শোনালেও আমি মেনে নিয়েছি। কারণ, হাইস্কুলে একই কথা একবার স্কুলের জাহানারা আপা আম্মুকেও বলেছিলেন। আমি খুব গাঢ়ভাবে তাকাই। উনি অবশ্য এই তাকিয়ে থাকাকে বোকা-দৃষ্টি বলেছিলেন।

আমি রূপাকে দেখতাম। কী দারুণ একটা মেয়ে। মেধাবী, ক্রিয়েটিভ আর মানবিক। কিন্তু কণ্ঠে সুর নাই। কণ্ঠে সুর ছিলো ন্যান্সির। ন্যান্সি মানে বাংলাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ন্যান্সি। ও তারাপদ স্যারের ছাত্রী ছিলো। আলফাডাঙ্গা একাউন্টস অফিসারের মেয়ে, থাকে ওখানকারই সরকারি বাসায়। বাসাটা আবার ছিল আমার নানাবাড়ির পাশেই।  

ন্যান্সিরা দুই ভাই-বোন।  ভাইটার নাম সম্ভবত জেমস ছিলো, বিরাট দুষ্টু। আর ন্যান্সি ছিলো উলটা, চুপচাপ আর শান্ত। আমি নানুবাড়িতে গেলে ন্যান্সি আর জেমসের সঙ্গে খেলেছি একদুইবার। ওদেরকে খুব একটা বাইরে বের হতে দিতো না। তবু বিকালে বের হতো। ন্যান্সির বাবা বদলি হয়ে যাবার পর দীর্ঘদিন আর কোনো যোগাযোগ ছিলো না। পরে একদিন ‘দ্বিধা’ গান রিলিজ হওয়ার পরে টিভিতে সাক্ষাৎকারে ও তারাপদ স্যারের কথা আর আলফাডাঙ্গার কথা বলাতে আমি ওকে চিনতে পারি। সালটা সম্ভবত ২০০৯। তখন রেডিও টু-ডেতে চাকরি করা বন্ধু কবি ও সম্পাদক রুহুল মাহফুজ জয়ের কাছ থেকে ন্যান্সির নাম্বার জোগাড় করি। ফোন দিই। ও খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে ওর সাভারের বাসায় নিয়ে যায়। একরাত ওর সঙ্গে কাটাই। কতো কতো স্মৃতি হাতড়াই। ও তখনও বেশ চুপচাপই ছিল। বলল, প্রেমের বিয়ের কারণে বাবা-মা-ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নাই।
এরপর অনেক ঘটনার স্রোতে তলিয়ে গেল ন্যান্সি। ফোননাম্বারটাও বদলে গেল। যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেল। মিডিয়ায় দেখেছি সে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল।
আর আত্মহত্যা করে আমার বন্ধু রূপা ২০১৭ সালে মরেই গেল! 
কী হয় আমাদের? রূপার কথা আরও অনেক আছে জমা। তার আগে ন্যান্সির প্রসঙ্গ শেষ করি।

তারাপদ স্যার ন্যান্সির কণ্ঠ আর চেষ্টার খুব প্রশংসা করতেন আমাদের বাসায় এসে। আমার কণ্ঠ ছিলো, কিন্তু চেষ্টা ছিলো না তেমন। শুধু ঘুরে বেড়ানোই মাথায় ঘুরতো। তারাপদ স্যার বলতেন, ‘তোর গলা না থাকলে শেখানো বাদ দিতামরে। সুর সবার মধ্যে থাকে না। ’

আম্মু খুব চেষ্টা করেছিলেন ভাইয়াকে গান শেখানোর, একদমই হয়নি, ভাইয়ার মধ্যে সুর বলতে কিছু ছিলো না। আমার কিছুটা হয়েছিলো। নানা অনুষ্ঠানে অংশও নিতাম। তারাপদ স্যার ‘ছোট্টখুকি কাঁদছো কেন’ ছড়াগানটি শিখিয়েছিলেন হারমোনিয়ামে। ক্লাস টুতে এটা আমি স্কুলের কালচারাল অনুষ্ঠানে গেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলাম৷ পুরস্কার পেয়েছিলাম একটা পাউডার কেস। আম্মু সেটাতে কিউট পাউডার রেখে অনেকদিন ধরে ব্যবহার করেছেন।

আম্মুর ঠ্যালাঠেলিতে রবীন্দ্রসংগীতে মোটামুটি দখল ছিলো। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে হাইস্কুল ও কলেজ পর্যায়ে রবীন্দ্রসংগীতের পুরস্কার অনেকদিন পর্যন্ত আমার দখলে ছিলো। প্রতিবছর গাদা গাদা সার্টিফিকেট পেতাম। ভাবতাম এগুলো দিয়ে আর কী হবে! অযত্নে শোকেসের পাশের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু এগুলো আমাকে অন্যরকম সাপোর্ট দিয়েছে জীবনে।

প্রসঙ্গত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটা ঘটনা বলি। মাত্র ২ মাস পড়াশোনা করে ২০০৩/০৪ অনার্স সেশনে আমি ভর্তির সুযোগ পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। হলে সিটের জন্য আবেদন করেছি আমিসহ বিভাগের আরও অনেক সহপাঠী। সবার আগে আমার সিট হয় এবং সেটা ননপলিটিক্যালি।  
এটা কীভাবে?
আচ্ছা দাঁড়ান বলছি।
একটু কফিতে গলা ভিজিয়ে নিই।
আমার হলটি ছিলো বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। নতুন হল। আজিমপুর গোরস্থানের একদম সামনেই। প্রভোস্ট তখন ‘বাংলা’ ব্যান্ডের বুনোর মা। আমরা ওঁকে বুনোর মা হিসেবেই চিনতাম। কারণ, ‘বাংলা’ ব্যান্ডের আমরা খুব ভক্ত ছিলাম তখন। আমরা মানে রুমমেটরা। তিন্নি আপু, মুন আপু, মোনালিসা আপুরা। প্রফেসর নাসরিন আহমেদ ম্যামকে আমি যেভাবে হলের সিটের জন্য ফেস করেছি, এটা আমার জীবনে খুব স্মরণীয় একটি ঘটনা। শুধু আমার কেন, যে কেউ শুনে অবাক হয়।  
মেরিট লিস্টে আমার নাম একটু মাঝের দিকে ছিলো। প্রতিদিন হলে যেতাম, কিন্তু ডাক পড়তো না। ওদিকে ঢাকায় থাকি মেঝোমামার শান্তিনগরের বাসায়। মামা চাইতেন না আমার হলে সিট হোক। কিন্তু মামির মনোভাব, আমার পড়াশোনা – সবমিলিয়ে সিটটা জরুরি ছিলো। মামাকে কোনোদিন বলিনি যে মামি আমাকে একদম সহ্য করতেন না। মামার সামনে অবশ্য সেটা কিছুতেই প্রকাশ করতেন না, বা সবার সামনেও অতোটা প্রকাশিত ছিল না ব্যাপারটা। এর একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ আমি এখন টের পাই। কারণ মামির মেয়েটা ছিল শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। আমি পরের মেয়ে, আবার আমার সব ব্যাপারে মামা খুব উচ্ছ্বসিত থাকতেন, এটাতে মামির মনে আঘাত লাগতো। শত হোক মানুষ তো! জটিলতা বেড়ে যাবার আগেই আমি হলের জন্য হন্যে হই।
 
তো, প্রতিদিন ক্লাস শেষে ৫ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে হলে যেতাম, হতাশ হয়ে ২০ টাকা দিয়ে শান্তিনগর ফেরত আসতাম। সালটা ২০০৫।

এর ভেতরেই একদিন লাঞ্চ আওয়ারে টুক করে প্রোভোস্ট নাসরিন ম্যামের রুমে ঢুকে পড়লাম। গম্ভীর একটা রুম। ম্যাম নিজেও। আমি ঢুকতেই একজন হাউস টিউটর ক্যাটক্যাট করে উঠলেন। তাঁর ক্যাটক্যাট শুনে আমি বললাম ‘ম্যাম, সিটের আবেদনের সঙ্গে যে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজের সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছিলো, ওটা কী জন্য?’
আমার প্রশ্ন শুনে ক্যাটক্যাটি হাউস টিউটরসহ নাসরিন ম্যাম অবাক হয়ে গেলেন। নাসরিন ম্যাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন তুমি কী পারো?’
বললাম ‘গান পারি, রবীন্দ্র সংগীত। ’
ম্যাম শুনতে চাইলেন, আমিও একছত্র ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে’ গাইলাম।
নাসরিন আপা আমাকে বললেন, ‘না, ঠিকাছে, চর্চা করে যেও, আর হলের প্রোগ্রামে ডাকলে যেন পাই। ’
যেহেতু অর্থ, রাজনীতি আর যৌনতা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও কোনো মিরাকল ঘটে না বলে সমাজে ধরে নেয়া হয় না, সেহেতু আমার আত্মপ্রচেষ্টার এই কাহিনি সতীর্থদের কেউ বিশ্বাস করলো না। আব্বু-আম্মু করেছেন, গর্বও করেছেন।
সংগীত শিক্ষা আমাকে শিল্পী না করলেও  হলে একটি বহুকাঙ্ক্ষিত সিট দিয়েছে। এও বা কম কী জীবনে?

বলে রাখি, আমার মা শুধু একজন গর্ভধারিণী বা একজন শিক্ষকই নন, একজন কবি এবং গীতিকার সুরকারও।
মায়ের একটা সংগঠন ছিল 'সরগম শিল্পীগোষ্ঠী' নামে। মা ছিলেন সেটার সভাপতি। আর রূপাকে শেখানো রূপকুমার স্যার ছিলেন আম্মুর গানগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম। । মা নিত্য নতুন গান লিখতেন, সুর করতেন আর রূপকুমার স্যারকে দিতেন। মা খুব চাইতেন আমরা ভাইবোনেরা তাঁর গান গাই। সুরের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটুক। কিন্তু দুইজনই ছিলাম মহা ফাঁকিবাজ। আমি একটু আধটু যা শিখতাম, তাতে করে আমি চাইতাম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আধুনিক গান গাইতে মা জোর করে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়াতেন। অনেক ব্যাপারেই তিনি তখন জোর না করলে হয়তো অনেক আগেই ডিরেইলড হয়ে যেতাম! 

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি