বিশ্ব গণমাধ্যমে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার দিনে অপেক্ষায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। কোলে শেখ রাসেল। ছবি জাফর ওয়াজেদের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

বিশ্ব গণমাধ্যমে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

আনোয়ার কবির

৯ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘সানডে মেল, মালয় এশিয়া’ পত্রিকায় ‘মুজিব মুক্তি পেয়েছে’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি খুব সকালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনে পৌঁছেন। বিশেষ বিমান পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজ ৬৩৫-এ তিনি লন্ডন পৌঁছেন।

তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ বিদেশ সম্পর্কীয় এবং কমনওয়েলথ অফিসের তিন সিনিয়র মুখপাত্রের সাথে দেখা করেন। মুখপাত্র জানান, শেখ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুই বলবেন না।

তার বাংলাদেশ সমর্থকরা তাকে সদ্যোজাত দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এক বছর আগে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে তার পার্টির বিপুল বিজয়ের পর পূর্ব খণ্ডে সংকট শুরু হয়েছিল এবং সেই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে এ নতুন দেশটির জন্ম হয়েছে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে গত মার্চের শেষের দিকে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা শুরুর পূর্বাহ্নে গ্রেফতার হয়েছিলেন। অবশ্য বিমানটি লন্ডন বিমানবন্দরে অবতরণের পূর্ব পর্যন্ত ঢাকা বা দিল্লি কেউ জানত না শেখ মুজিব কোথায়? শেখের রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগের ১ ঘণ্টা পর যে ঘোষণা দেয়া হয়, তাতে তার গন্তব্যস্থলের কোনো উল্লেখ ছিল না।

রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ মুজিব একটি বিশেষ বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান সময় বেলা ৩টায় (মালয়েশিয়া সময় ৫টা ৩০ মিনিট) রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। রেডিও পাকিস্তান জানায়, শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী তিনি কোথায় যাচ্ছেন, এ সম্পর্কে কিছুই জানানো হবে না। ঘোষক আরো জানান, শেখ তার গন্তব্যে পৌঁছার পর নিজেই ঘোষণা দেবেন।

এদিকে রয়টার ঢাকায় রেড ক্রস মুখপত্র ও বিদেশী সংবাদদাতাদের টেলিফোন করেছিল, সেখানে শেখ মুজিবের গন্তব্য সম্পর্কে কোনো খবর পৌঁছায়নি। এমনকি কোনো গুজবও পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছায়নি। রেডিও পাকিস্তান জানায়, মি. ভুট্টো শেখ মুজিবকে রাওয়ালপিন্ডিতে বিদায় সংবর্ধনা জানান।
এরই মধ্যে আজ (৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়ে দিয়েছেন, মি. ভুট্টো যদি তার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চান বা উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হন, তাহলে যেন অবিলম্বে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন। মি. আহমদ আজ ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক কর্মিসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রিয় নেতাকে মুক্ত করার জন্য যেকোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকারে যেতে প্রস্তুত। যদি ভুট্টো তার পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চান, তাহলে তিনি যেন অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুকে (বাঙালির বন্ধু, একটি আবেগ মথিত নাম, এ নামে শেখ পরিচিত) তার জনগণের মাঝে ফিরে আসার ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া মি. আহমদ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকার জন্য তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন। তিনি অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যে তার দেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনামে পরিণত হওয়বার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, এজন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, যখন তার দেশের হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হচ্ছিল, সে সময় যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই তাদের মিত্র পাকিস্তানকে বাধা দেয়নি এবং তারা আরো হত্যার রসদ জুগিয়েছে। তিনি জানান, সোভিয়েত ইউনিয়নের হুঁশিয়ারির কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সৃষ্ট ভারত-বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী আরো দৃঢ় হবে।
৫১ বছর বয়সী শেখ মুজিবকে নয় মাস আগে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে নেয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল দেশদ্রোহিতার অপরাধে তার বিচার হবে। তিনি গত ডিসেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়েও পাকিস্তানের জেলখানায় ছিলেন। যুদ্ধের শেষে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বাংলাদেশের জন্মের পর ভুট্টো ক্ষমতায় আসেন এবং এ সময়ে শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে গৃহে অন্তরীণ করা হয়। গত ২২ ডিসেম্বর তাকে জেলখানা থেকে নিয়ে আসা হয়। ’

৮ জানুয়ারি ১৯৭২ রয়টার ‘লন্ডনে শেখ মুজিব’, ৯ জানুয়ারি লন্ডনের ‘সানডে টাইমস’ ‘শেখ মুজিবের সাথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ’, ১০ জানুয়ারি ‘জাম্বিয়া ডেইলি মেইল’ ‘শেখ মুজিব দিল্লির পথে’, ১০ জানুয়ারি ইউএনআই ‘নয়াদিল্লির জনসভায় শেখ মুজিবের ভাষণ’, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘রাইজিং নেপাল, কাঠমান্ডু’ পত্রিকায় ‘পরিবর্তনের সূচনা: শেখ মুজিবের মুক্তি’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, এদিনই ‘আল আয়আম খার্তুম’ পত্রিকায় ‘জিন্দাবাদ শেখ মুজিব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি ‘দি অ্যাডভোকেট ব্রুনাই, তাজমেনিয়া, অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় ‘শেখের দায়িত্ব’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১০ জানুয়ারি নেপালের ‘নিউ হেরাল্ড, কাঠমন্ডু’ পত্রিকায় ‘চিরন্তন সত্য’ শিরোনামে সম্পাদকীয়, ১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লির ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ‘দিল্লিতে শেখ মুজিবের স্মরণীয় সংবর্ধনা’, শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর প্রতি মুহূর্তের সংবাদ পরিবেশন করেছে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা
১০ জানুয়ারি ১৯৭২। রক্তের অক্ষরে বিজয়ী বাঙালির বিজয়ের পরিপূর্ণতার দিন। যুগ যুগান্তরের পরাধীনতার অবসানের পরিপূর্ণতার দিন। স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ফিরলেন তার স্বদেশে। বিজয়ী দেশে বিজয়ী মহানায়কের স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন। এদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাঙালি জাতিরও অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিন। ২২৪ বছরের পরাধীনতার অন্ধকারের নাগপাশ থেকে আলোয় ফেরার দিন। বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, তার এ প্রত্যাবর্তন ছিল অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তন। বঙ্গবন্ধুর এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল রূপকথার নায়কের প্রত্যাবর্তন। সমগ্র জাতি সেদিন উপচে পড়েছিল খুশিতে। জনগণের চোখে ছিল আনন্দের অশ্রু। দেশে ফিরে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনগণের আনন্দের অশ্রুর সঙ্গে মিশে গিয়েছিল তারও চোখের অশ্রু। বক্তব্য রাখতে গিয়ে সমগ্র জাতিকে নিয়ে কেঁদেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনও সারা বিশ্বের মিডিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধারণ করেছে। সারা বিশ্বে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে সেদিনের সবচেয়ে আলোকিত বিষয়টিকে। সব গণমাধ্যমেরই উল্লেখযোগ্য সংবাদ ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।

১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা শিরোনাম করে ‘শেখ মুজিব নিজদেশে: পাঁচ লাখ লোকের উচ্ছ্বসিত সংবর্ধনা’, এছাড়া ‘মুজিব ভারতের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের কথা বললেন’ শিরোনামেও নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি স্টোরি প্রকাশ করে। এদিনই লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ‘মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন’ শিরোনামে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে। সারা বিশ্বের গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সচিত্র বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে।
১১ জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিখ্যাত পত্রিকা ‘স্টেটসম্যান’ ‘ঢাকা এখন উল্লসিত: লাখ লাখ লোক মহান মুজিবকে স্বাগত জানায়’ শিরোনামে লেখে, “ঢাকা, ১০ জানুয়ারি, শেখ মুজিবুর রহমান আজ তার জনগণের কাছে ফিরে এলেন। নয় মাস কারাভোগের পর শেখ মুজিবের এ স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন। লাখ লাখ লোক তাকে স্বাগত জানা জন্য বর্ণনাতীত উল্লাসে ফেটে পড়ে। জনগণ বস্তুত ছিল উল্লাসে দিশেহারা; তারা কেউ নাচছিল, কেউ বা চিত্কার করে জয়ধ্বনি দিতেছিল। রয়েল এয়ারফোর্স জেটটি মাটি ছোঁয়ামাত্রই বিশাল জনতা এগিয়ে আসে এবং প্রায় বিমানটির দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। খুব কষ্টে এ জনতাকে ঠেকিয়ে রেখে তাকে তিন বাহিনী গার্ড অব অনার প্রদর্শন করে এবং তার সাথে কূটনীতিকদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
বিমানবন্দরে বিশাল জনতার সামনে উচ্চমঞ্চে শেখকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। উল্লেখ্য, এই সেই বিমানবন্দর, ১০ মাস পূর্বে যেখানে তাকে গভীর রাতে বন্দি হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছিল আর আজ সেখানে তার বিমান নামল সূর্যালোকে এবং তাকে বরণ করা হলো বিজয়ী বীরের সংবর্ধনায়। তোপগুলো তার সামনে গর্জন করে উঠল ৩১ বার। তাকে স্বাগত জানাতে প্রথমে এগিয়ে আসেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা। অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। কেবল ইরান ও চীনের কোনো প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিলর জেনারেল উপস্থিত ছিলেন।

জনতার স্রোতের ভেতর দিয়ে শেখ মুজিবের মোটর শোভাযাত্রা বিমানবন্দর থেকে রমনা রেসকোর্স পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পুরো ২ ঘণ্টা সময় নেয়। রমনা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব ভুট্টোর কনফেডারেশন স্বপ্নের প্রত্যুত্তরে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং এর একটি মানুষ বেঁচে থাকতেও এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। প্রিয় নেতাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়ার জন্য সমস্ত ঢাকা শহরের মানুষ এসে জড়ো হয়েছিল রমনা রেসকোর্স থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের এ চার মাইলের ভেতর। এছাড়া পার্শ্ববর্তী জেলা ফরিদপুর, বরিশাল, কুমিল্লা থেকেও হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল।
খুব সকাল থেকেই ঢাকাকে মনে হচ্ছিল একটি উৎসবের নগরী। অসংখ্য মিছিল রেসকোর্স ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের ভেতর ছোটাছুটি করছিল। সমস্ত রাস্তা ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অধিকাংশের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা এবং শেখ মুজিবের ছবি। বিমানবন্দর ছিল মুক্তিবাহিনীর কড়া নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণে শেখ মুজিবের মোটর শোভাযাত্রার পথ তৈরি করে। শেখ মুজিবের গতিপথের দুই ধারের সমস্ত ব্যালকনি ও ছাদ ছিল মানুষে পরিপূর্ণ। তাদেরও মুখে ছিল উল্লসিত স্লোগান। জনতার স্লোগান ছিল ‘জাতির পিতা দীর্ঘজীবী হোক’ ‘মুজিব ভাই দীর্ঘজীবী হোক। ’ কিন্তু কিছু কিছু মিছিল স্লোগান দিচ্ছিল, ‘সপ্তম নৌবহর জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’ ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক নিপাত যাক’ এবং বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী দীর্ঘজীবী হোক। ”

৫৩ বছর বয়সী বাঙালি নেতা জনসভায় পাকিস্তানিদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বারবার চোখের জল সামলাচ্ছিলেন। বিশাল জনতাকে উদ্দেশ করে শেখ মুজিব বলেন, লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার পূর্বে ভুট্টো সাহেব আমাকে বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোনোরূপ কনফেডারেশান রাখা সম্ভব কিনা। আমি বলেছিলাম, আমি আমার জনগণের সাথে আলাপ না করে কিছুই বলতে পারিনে। ভুট্টো সাহেব অপনার উদ্দেশে আমি এখন বলতে চাই, আপনার (পশ্চিম পাকিস্তান) সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল তার আজন্ম সাধনা, আজ সে সাধনা পূর্ণ হয়েছে। কবি গুরুর কথা আজ মিথ্যে হয়েছে, আজ বাঙালি মানুষ হয়েছে আজ আমার কোনো দুঃখ নেই। তিনি পৃথিবীর সমস্ত জাতির কাছে তার গৃহহীন, দুঃখী মানুষের জন্য ও বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন।
রমনা রেসকোর্সের জনসভায় শেখ মুজিব ১০০ ফুট লম্বা নৌকাকৃতি মঞ্চ থেকে ভাষণ দেন। উল্লেখ্য, নৌকা আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রতীক। শেখ মুজিব মঞ্চে আরোহণের সাথে সাথে সমস্ত জনসভা স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে। কেউ কেউ নেতার প্রতি পুষ্পবর্ষণ করতে থাকে। কেউ বা নেতার মুক্তির আনন্দে আকাশে পায়রা উড়াতে থাকে। সর্বত্রই হাসিখুশি মুখ। কারো মনে কোনো দুঃখের চিহ্ন নেই। আজ তাদের দেখলে বোঝাই যায় না, তারা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্যোগময় নয় মাসের গণহত্যার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বরং আজ তারা তাদের নেতাকে ফিরে পেয়ে যেন সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে নিশ্চিত।
জনতার করতালির ভেতর শেখ মুজিব ৩৫ মিনিট ভাষণ দেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ জানান সোভিয়েত ইউনিয়নকে। তিনি আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের জনগণ যারা তার মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করেছিলেন, সবাইকে শুভেচ্ছা জানান। শেখ মুজিব তার এক কোটি গৃহহীন মানুষকে খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে প্রতিপালন করার জন্য ভারতকে ধন্যবাদ জানান।
শেখ মুজিব কর্মীদের উদ্দেশ করে বলেন, যদি আমরা আমাদের জনগণের মৌলিক অন্ন, বস্ত্র ও কাজের সংস্থান করতে না পারি, তাহলে আমাদের এ কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে প্রশংসা করে বলেন, তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে আমাদের দ্রুত মুক্তিতে সাহায্য করেছে। শেখ আরো বলেন, তার প্রহসনমূলক বিচারে কিছু বাঙালিকে সাক্ষী দেয়ার জন্য নেয়া হয়েছিল, তিনি বিশ্বাস করেন, তাদের জোরপূর্বক নেয়া হয়েছিল। বক্তব্য শেষে শেখ জনসভার উপস্থিত শহীদদের স্মরণে প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান এবং তার সাথে সাথে স্লোগান ধরতে বলেন, জয় বাংলা ও ভারত বাংলাদেশ ভাই ভাই। উপস্থিত জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার এ আহ্বানে সাড়া দেয়। ’

১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দ্য মারকুরি, হাবার্ট, তাজমানিয়া, অস্ট্রেলিয়া’ পত্রিকায় শেখ মুজিবের প্রত্যাবর্তন শিরেনামে লেখে, ‘উত্তাল জনতা শেখ মুজিবকে ঢাকায় আবেগঘন সংর্বধনা জানিয়েছে। শেখ মুজিবকে তার জনগণ যে ধরনের সংবর্ধনা জানিয়েছে। উপমহাদেশে এ ধরনের সংবর্ধনা এর আগে দেখা যায়নি। শেখ মুজিবের জনগণের ভালোবাসার উচ্ছ্বাস উপমহাদেশ থেকে যেদিন ব্রিটিশ চলে গিয়েছিল, সেদিনের ইতিহাসকে সবদিক থেকে ম্ল্লান করে দিয়েছে। অবশ্য একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য তার নেতাকে যতদূর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, শেখ মুজিব তার চেয়ে অনেক বেশি পথ অতিক্রম করে এলেন।
বাংলাদেশে পশ্চিমাদের অবহেলার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সবসময়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি সরকার এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব সামান্যই করেছে এবং এ শোষণের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাদের রক্তাক্ত অপারেশন শুরু করেছিল। এখন স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ মুহূর্তে তাদের সমস্যা কীভাবে তারা পরিচালিত হবে। অবশ্য এটা পুরোপুরি নির্ভর করে শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর, তিনি কীভাবে তার জাতিকে পরিচালনা করবেন। কীভাবে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের দমন করবেন এবং কী ধরনের আইন ও প্রশাসন তিনি গড়ে তুলবেন।
’৭০-এর নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছিল, শেখ মুজিব তার দেশে বর্ণনাতীত জনপ্রিয়। তার প্রত্যাবর্তনের দিনও প্রমাণিত হলো যে জনপ্রিয়তায় এখনো ভাটা পড়েনি। তবে বাস্তব পরীক্ষা শুরুর সময় এখন। বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের গতি ধীরই হয়ে থাকে, এ সময়েই তার জনপ্রিয়তা বাস্তবের মুখোমুখি হবে। এ নতুন সদ্যোজাত স্বাধীন দেশটির পুনর্গঠনের জন্য এ মুহূর্তে প্রয়োজন কার্যকরী বিদেশি সাহায্য। অবশ্য এ লক্ষ্যে প্রয়োজন সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদান। এরই মধ্যে শেখ মুজিব ব্রিটেনের স্বীকৃতি আদায়ের পথ অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। আশা করা যায়, অস্ট্রেলিয়া শিগগিরই অনুরূপ সিদ্ধান্তে যাবে।
অবশ্য শেখ মুজিবও তার সরকারকে এরই মধ্যে প্রমাণ করতে হবে যে তার দেশ ও জনগণ তারই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটা প্রমাণিত হলে নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়া স্বীকৃতির ব্যাপারে তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেবে। বৃহৎ শক্তি কোনদিকে যায় এটা অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার ব্যাপার নয়। ’ ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ‘দ্য ওয়েস্ট অস্ট্রেলিয়ান, পার্থ’ পত্রিকায় ‘শেখ মুজিবের দায়িত্ব গ্রহণ’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে, ‘লাখো বাঙালির আবেগমথিত সংবর্ধনার ভেতর দিয়ে শেখ মুজিব ঢাকায় প্রবেশ করলেন। আর এর সাথে সাথেই তিনি প্রবেশ করলেন নতুন জাতিকে গড়ে তোলার এক বিশাল কর্মরাজ্যে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। শেখের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। এখন চোখের সামনে একমাত্র যুদ্ধ তার স্বপ্নের জাতিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার।
পৃথিবীর কোনো জাতির নেতাকে বস্তুত এমন দুর্গম পথ পেরিয়ে এবং এমনি নাটকীয়ভাবে ক্ষমতার মঞ্চে আরোহণ করতে হয়নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্যে বাংলাদেশ পাকিস্তানের শৃঙ্খল ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু এ পথে গত নয় মাস তাদের ওপর চলেছে এক রক্তক্ষয়ী ও বর্বর পাশব অত্যাচার। এক কোটির ওপর সর্বস্ব হারানো লোক এখন এ নতুন রাষ্ট্রকে পুনর্বাসন করতে হবে। তার ওপর অধিক জনসংখ্যাবহুল এ দেশটি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশের একটি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ লুণ্ঠিত, প্রশাসন বিধ্বস্ত, সর্বোপরি যুদ্ধের ভয়াবহতায় জনগণ হতাশ। এ মুহূর্তে এ নতুন জাতিকে একতাবদ্ধ করে গড়ে তোলার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা একমাত্র শেখ মুজিবেরই আছে। ’
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করেছিল। শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রার। বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের মধ্য দিয়ে আবারো চেষ্টা চালানো হয়েছিল অন্ধকারের দিকে টেনে নেয়ার। কিন্তু সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার গৌরবোজ্জ্বল বিজয় সমহিমায় ধরে রেখেছে। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় অন্ধকার থেকে আলোয় প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসকে।
লেখক :  গবেষক ও ইসলামি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা

news24bd.tv/ডিডি