‘মোর প্রথম মনের মুকুল
ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৫

‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

অনলাইন ডেস্ক

পাড়াবেড়ানি সেঁজুতির আর একটা নাম ছিলো 'বৈঁচি'। বুনো আর উড়নচণ্ডী ছিলাম বলেই মা হয়তো এই নামে ডাকতেন। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ এই নামে বহুদিন ধরে ডেকেছেন। আবার নাকখানা বায়োলজিক্যালি মঙ্গলীয়দের মতো বোঁচা হওয়ায় মা মজা করে 'বুঁচি' নামেও ডাকতেন।

এই মতো একখানা বোঁচা নাকেও আমি জীবনে কতোবার যে ঘষা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। এ নামটাই হয়তো আমার জন্য যথাযথ ছিলো। কিন্তু মা কী মনে করে যেন আমার সবগুলো নাম থেকে একটা বিশুদ্ধ কৌটার ভেতরে শুধু চন্দ্রবিন্দুটুকু রেখে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন:প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

পাড়া-বেড়ানোর অংশ হিসেবে একবার প্রতিবেশী ও সহপাঠী চঞ্চলের ছোটভাই তনুকে নিয়ে সুপারির খোলা দিয়ে তৈরি  টানাগাড়ি খেলতে খেলতে অ্যাক্সিডেন্ট করি।

বোঁচা নাকটা আমার ছিলে গিয়ে আরও বোঁচা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। আহা, সেই নাকটা আমার চিরকাল বোঁচাই রয়ে গেল, একটু মাথা জাগিয়ে আকাশের চেহারাটা একবার দেখলো না! মা আবার কোনো একটা কারণে একটা ছবি তোলারও ব্যবস্থা করেছিলেন তখন। এবং এই ছবি নিয়ে আমার মা-ভাই আত্মীয়-স্বজনের কতো মজা যে সহ্য করেছি, তার হিসাবও নাই। আম্মু আর ভাইয়া আমার এই ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে সবসময় বৌদ্ধ ভিক্ষু বলে বলে ক্ষেপাতেন।

জীবনের সকল নাকঘষা এতো ইনোসেন্ট ছিলো না কিন্তু।

নাকঘষাসমেত আমার এহেন পাড়াবেড়ানি স্বভাবের কারণে স্বভাবতই আব্বু-আম্মুর টেনশন হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁদের টেনশনের আরেকটা বড়ো কারণ ছিলো। খেলতে খেলতে পাড়ার একটা প্রায় বখে-যাওয়া ছেলের সঙ্গে আমার খণ্ডকালীন তথাকথিত প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। আসলে এটাকে ঠিক প্রেম বলে কিনা জানি না৷ ক্লাস ফাইভের শেষ দিকের কথা। ছেলেটা আমার ইয়ার-ফাইনালের প্রশ্ন নিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো কী কী ভুল করেছিলাম। ওইদিন মনে হয়েছিলো, উরে বাবারে, এই ছেলে আমার পরীক্ষার ভুল ধরতে পারে!
ভুল ধরতে পারা মানেই তখন অনেক কিছু জানা মনে হতো!
ছেলেটা তাহলে অনেক কিছু জানে!

আরও পড়ুন:‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

আর আমি চিরকালই ভুল করার মহা ওস্তাদ!
মা আব্বুর কাছে নালিশ করতেন, আমি নাকি প্রশ্নের উত্তরে একটুও চিন্তা-ভাবনা না করে খৈয়ের মতো করে উত্তর ফোটাই। এবং প্রথম উত্তরটা বরাবরই ভুল দিই। এই বদ-অভ্যাসটা মজ্জাগত হয়ে গেছে কীভাবে কীভাবে যেন! এর একটা কারণ হতে পারে হয়তো নিজের মনের চেয়ে অন্যের মনের ওপর নির্ভর করার অভ্যাস বা প্রবণতা। অর্থাৎ যে প্রশ্ন করছে, তার মন-দিল আসলে কী শুনতে চাইছে, খুব দ্রুত সেটা বলতে চেষ্টা করতাম।

প্রথম ও দ্রুত উত্তরের মতো জীবনের প্রথম ও দ্রুত প্রেমের ক্ষেত্রেও ভুল তার গোটা গোটা ডিমগুলো ফুটিয়ে বাচ্চা উৎপাদন করতে নির্ভুলভাবে সফল হলো।

ছেলেটার সঙ্গে আমার প্রেম যতোটা না ছিলো তার থেকে বেশি ছিলো রটনার ঘনঘটা। পাড়ার মধ্যে ব্যাপারটা খুব মুখোরোচক উপায়ে প্রচারিত হতে থাকলো। অনেকটা আচার দিয়ে মাখানো ঝালমুড়ির মতো জিহ্বার জল-ভেজা অবদমিত আকাঙ্ক্ষার মতো মুখরোচক।

'শোন্ছেন নাকি,পরফেসারের গ্যাদা মাইয়ে নাকি প্রেম কইরে বেড়ায়!'

পাড়ায় এটা একটা দারুণ খবর। অন্তত বহুদিন পর্যন্ত পাড়া এবং বাজারের মানুষের খেয়ে পরে বাঁচবার একটা উপায় হিসেবে খবরটা ফলহীন পানি-মারা মানিপ্ল্যান্টের মতো তাজা ছিল।  

দারিদ্র্যেহর অস্টিওপরোসিস আক্রান্ত ভাগ্যকে কেবল শিক্ষা দিয়ে পরিবর্তন করা দম্পতির সামাজিক স্ট্যাটাসে একটু ঝামা-ঘষা পড়লে মনের মধ্যে যে গোপন সুখ অনুভূত হবে, তার তুলনা কেবল মায়া-সভ্যতার ৩৬৫টি সিঁড়ি আবিষ্কারের মতো হবার কথা।

আরও পড়ুন:‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

সে যাক, আমার প্রথম অনুগ্রহী ছেলেটা বহু চেষ্টা করেছিলো আমাকে পটানোর জন্য। কৃষ্ণের মতো ত্রিভঙ্গ মুরালি বাজিয়ে লীলা করে অনেক মুগ্ধ করতে চাইতো। আমি মুগ্ধ হতে হতে আবার আব্বু-আম্মুর কড়া শাসনে শেষ পর্যন্ত মুগ্ধ হতে পারতাম না। আহা বেচারা! চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। চিঠি, দেয়াল লিখন, সিনিয়র আপু ও বান্ধবীদেরকে পটিয়ে গিফট চালাচালি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা, আরও কতো কী! এই বয়সে যা হয় আর কি!

আরও পড়ুন :ভাইয়ার 'মনাভাই'

ক্লাস সিক্সে টিয়া আপু (ছদ্মনাম) ছিল আমার বার্তাবাহক। উনি পড়তেন ক্লাস সেভেনে। টিয়া আপুকে দেখতাম হাতে করে মোটা মোটা চিঠি নিয়ে আসতে। ওকে দেখে আমার একইসঙ্গে বুক কাঁপতো এবং ভালো লাগা কাজ করতো।
 
কী পুরু পুরু চিঠিরে বাবা! যে মনোযোগ আর সময় ব্যয় করে ছেলেটা আমাকে চিঠি লিখতো সেই মনোযোগ আর চেষ্টা যদি নিজের উন্নতিতে দিত তাহলে হয়তো একদিন সে আমার রুচিকে দখল করলেও করতে পারতো! কে জানে! আব্বু অবশ্য ছেলেটাকে অনেক মোটিভেশান দিত, পড়াশোনার ব্যাপারে ইন্সপায়ার করতো। কীসের কী, পুরাই আউলানো ছেলে।

জীবনের একমাত্র লক্ষ্য শুধু মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ানো। শুনেছি, আমার আগেও নাকি তার প্রেম ছিল। তার কাছেও ওর অনেক প্রেমপত্র ছিলো। মেয়েটা আকুল হয়ে দেখিয়েছিলো আমাকে। প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে মেয়েটাও এলোমেলো আচরণ করেছিলো। খুব ভালোবাসতো ছেলেটাকে। মেয়েটা আমার সিনিয়র ছিলো। তার প্রতি কেন জানি না ভালো লাগা কাজ করতো। কারণ অবশ্য মেয়েটার চেহারা ছিলো নায়িকা মৌসুমীর মতো। আর নায়িকা মৌসুমী ছিলেন তখন আমাদের ক্রেজ।
তো আমি ছেলেটাকে ওই আপুর হয়েও সুপারিশ করতাম। আগেই বলেছি, অন্যের  মনের গুরুত্ব দিতে গিয়ে নিজেরটার খবর অনেক ক্ষেত্রে নিতে পারতাম না। ফলে, আমার পক্ষে এই কাজ সম্ভব হয়েছিলো। অর্থাৎ আমি নিজের উড-বি বয়ফ্রেন্ডের কাছে তার এক্স-গার্লফ্রেন্ডের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। ছেলেটা মানেনি। মেয়েটা অনেক কেঁদেছিলো আমার কাছে। খারাপ লেগেছিলো ভীষণ। কিন্তু এটাও ঠিক, এতো সুন্দর একটা মেয়েকেও যে ছেলে পাত্তা দিচ্ছে না, সেই ছেলে আমাকে পছন্দ করছে, এটা ভেবে বেশ অরাজনৈতিক সুখ যে অনুভূত হয়েছিল, সেটা অস্বীকার করা রীতিমতো গুনাহের কাজ হবে। ফলে, আমি ছেলেটার প্রেমের উৎকর্ষ উপভোগ করতে লাগলাম।

তার কাছ থেকে পাওয়া বহু-কাঙ্ক্ষিত সেই প্রেমপত্রগুলো পড়ার সাথে সাথে ছিঁড়ে পুকুরে ফেলে দিতাম ভয়ে। রেখে দিলে হয়তো নাজি-বাহিনীর চিহ্ন ধরে রাখার মতো বিপত্তি ভাগ্যে জুটবে। এখন এই যান্ত্রিক যুগে এসে মনে হয়, চিঠিগুলো রেখে দেয়া উচিত ছিলো। প্রেম-বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তো জগতে থামবার মামলা নয়। মানুষের কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া ভালোবাসার দলিল রেখে দেওয়াই তো উচিত। এগুলোর স্বাদ জীবন-বইয়ের পাতায় চায়ের দাগ-লাগা পৃষ্ঠার মতো মিষ্টি। কিন্তু আমি বাবা-মায়ের সামরিক অগ্নি-চক্ষুর ভয়ে কিছুই রাখিনি। হয়তো এটাই তখনকার দিনে স্বাভাবিক ছিলো।

এই যে ভয়, ভয়ের মধ্য দিয়ে একজনের মনের খবর পাওয়া, তার আবেগের পুরোটাকে জানা – এই জিনিসের অনুভূতি অন্যরকম। ছেলেটা আমাকে সূর্য ডাকতো। একদিন স্কুলের একটা দেয়ালে দেখি ইটের টুকরো দিয়ে লেখা:
‘সূর্য, তুমি চেয়েছো মন
আমি দেব জীবন। ’

ছেলেটা যে আমাকে 'সূর্য' ডাকতো এটা কেউ জানতো কিনা জানি না। কিন্তু ওইদিন নিজের ছদ্মনানটা বড়ো ক্যানভাসে দেখে যে কী খুশি লেগেছিলো, তা বলতে নিজেকে এখন আর নির্লজ্জ মনে হচ্ছে না। মনের কথা যখন দেয়ালে উঠে আসে, তখন সেটা আনন্দেরই তো হবার কথা। এটা সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর মনে হলেও মানুষের গভীর হৃদয়ে জাল ফেললে ঠিকই সবার মন-সুখ ধরা পড়বে। এখনকার দেয়ালে দেয়ালে তো ওসব আর তেমন দেখা যায় না। বড়োজোর 'কায়দা করে বেঁচে থাকো', 'কোটি কোটি অর্থ ব্যয় হয় তোমার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য'র মতো বিরাট বিরাট জীবনঘন বাক্যের চিকা লেখা থাকে। কোমল, সরল প্রেমময় বাক্যগুলো সব মানুষের মাথা ও মন থেকে উবে গেছে। এখন সবাই সমাজ ও ইগো-সচেতন। কাউকে ভালো লাগলে, ভালোবাসলে সহজে বলা যাবে না। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বেশি সক্রিয় এখন ইউরোপীয় ইগোর আধিপত্য।

ছেলেটা আমার ব্যাপারে ভালোই উন্মাদনা দেখাতো। তার সেই কী প্রেম! কিন্তু আমি তাকে চিঠি দিতাম খুবই কম। আব্বু-আম্মুর তথাকথিত মাইরের ভয়ের ঠেলায় প্রেমটা ঠিক মতো জমে উঠতে পারেনি তখন।


মা-বাবা, ভাইয়া, দাদা-দাদি, নানা-নানি, প্রতিবেশী সবার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে এই ভালোবাসা ভিন্ন রকমের। একদিন ঢাকাইয়াদের পুকুর পাড়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রথমবারের মতো ছেলেটা আমাকে সবার অলক্ষে একটা চুমু খেয়ে দৌড় দিলো! তখন মনে হয়েছিলো, আমি মনে হয় দুনিয়ার সবচাইতে খারাপ কাজটির অংশ হয়ে গেছি। মনের ভালো-লাগার চারাগাছটিতে তখন সামাজিক পাপবোধের আদি-মাটি চাপা দিতে শুরু করলাম। ইশ, আমি কত্তো খারাপ মেয়ে, যে কোনো ছেলে এসে চুমু খেতে পাবার সাহস পায়!  ছিঃ ছিঃ!

ছেলেটা তার পুরোটাই মনে হয় সঁপে দিয়েছিলো। কিন্তু আমি পারিনি। পারিনি কারণ, একে তো বয়স কম, বুঝি কম; তার উপর আমি একটি আরোপিত সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে সব থেকে ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম। আর পরিবারের বেঁধে দেয়া নিয়মের কথা তো বাদই দিলাম। অতো অল্প বয়সে প্রেম কী জিনিস ঠিকমতো না বুঝলেও ভাইয়া ছাড়া আর কোনো বাইরের ছেলের সঙ্গে কোনোপ্রকার সখ্য করতে নেই, এটা খুব ভালোভাবে বুঝেছিলাম। তাই প্রেমকে ছি-কুতকুত ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি তখন। প্রথম প্রেমের এই ব্যাপারটা মনে হয় এরকমই, ক্লাসিক উপন্যাসের মতো।

কিন্তু, ক্লাসিক হলেও আমার ক্ষেত্রে এর অথেন্টিসিটি প্রায় জিরো। কারণ, আবারও বলছি, এটা যতোটা না প্রেম ছিলো, রটনা তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলো! সত্যিকারের প্রেমের জন্য রিস্ক নেয় মানুষ। প্রেম এয়ারটাইট না হলে চেষ্টাগুলো কিন্তু সব লুজ হয়ে যায়।

আমি এই বিষয়টা নিয়ে আজও মোটামুটি বিরক্ত হই। ‘যা রটে তা কিছুটা হলেও ঘটে’ – কথাটা নিঃসন্দেহে সত্য, কিন্তু আরও বেশি সম্ভাবনাময় সত্য হলো, যা রটে, তার ১০ ভাগ সত্য আর ৯০ ভাগ রটনায়ও ঘটে! সব থেকে বানোয়াট গল্পটাই যে সত্য – এটা বুঝতে শেখার মতো অক্ষর ও কাণ্ডজ্ঞান আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষেরই থাকে।
 
প্রিয় পাঠক,
ধরুন আপনি এতোটা লিপ্ত নন, এমন একটা ভালো লাগার বিষয় যদি কোনো কারণে লিক হয়ে গিয়ে একেবারে পাঁচজনের সংসারের মধ্যে চলে যায়, তখন আপনার কেমন লাগবে? 
ইচ্ছে করবে আর আরোপিত সম্পর্কের দায় নিতে? যা হয়নি, তাকে হইয়ে দিয়ে, হওয়ার সম্ভাবনাকে গুড়িয়ে দিয়ে বরং না হওয়ার সম্ভাবনাকে মজবুত করার একটা ব্যাপার অনেক সময় কাজ করে। এমন পরিস্থিতির চাপে কার হৃদয় কবে কাঁপেনি বলুন তো? একদম 'হাছা' কথা বলুন।  
অবশ্য 'হাছা' কথা না বলার সম্পূর্ণ এখতিয়ার আপনার আছে বা থাকাই উচিত। কেননা, পরিস্থিতিও অনেক সময় অনেক কথা বলে, যা মানুষের 'ভাষা'র শক্তিকে ম্লান করে দিতে পারে।

অধিকাংশ মানুষই হয়তো তাদের প্রথম প্রেমের ব্যাপারে নানারকম আরোপণমূলক গল্প বানিয়ে একটি মহৎ শিল্পকর্ম প্রতিষ্ঠার ব্রত নেন। আসলে বর্ণনা মাত্রই আরোপণ, গল্পমাত্রই বানোয়াট। যুক্তি দিয়ে না গোছালে সামাজিক ভাষায় তা ঢালা যায় না। আর সামাজিক ভাষার ছাঁচে তা ঢালতে না পারলে কালের স্রোতে ভেসে যেতে হয়। হুবহু কিছুই কেউ বলতে পারে না। কেউ কেউ কাছাকাছি যায়। আমি মোটামুটি কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করেছি। অনুভূতির ক্ষেত্রে আমার ভালো লাগা ছিলো, এটা অস্বীকার করবার জো নেই; কিন্তু গভীর কিছু ছিলো না। আবার এটাও ঠিক, নাব্যতা ছাড়াও তো জগতে নদী বেঁচে থাকে, নামে ও স্মৃতিতে। থাকে না?

শেষ পর্যন্ত আব্বু-আম্মু-ভাইয়ার শাসনে আমার আধা-খেচড়া সম্পর্কটা গাছে ঝুলে থাকা ঝুনা নারকেল শাখার মতো ঝুলে গেল! ক্লাস এইটে বা নাইনে রুচিরও বদল ঘটলো। এর মধ্যে আমার পাড়া-বেড়ানো বা বন্ধু-যোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো। আমি খাঁচাবন্দি পাখির মতো একধরনের একলা বড়ো হতে থাকলাম। সবার আদরে কিছুদিনের ইন্টারভেল হলো।

যেখানে যাই, রাজা পঞ্চম হেনরির মতো আব্বু-আম্মু-ভাইয়ার প্রহরার কণ্টকাকীর্ণ প্রহার আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতো। একদম ভাল্লাগতো না বিষয়টা।

তখন সমবয়সী একটা মেয়ে কাজিন ছিলো। এসব দিকে তার হেব্বি আগ্রহ ছিলো। সে বিশ্বাস করতো, যে মেয়েকে যতো বেশি ছেলে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, মেয়ে হিসেবে সে ততো দামি। ফলে কে কয়টা প্রোপোজাল পেলো, কোন ছেলেকে ভালো লাগলো, সেসব নিয়ে প্রাণ খুলে আলাপ করতাম ওর সাথে। ও নিজেও ওর সবকিছু শেয়ার করতো আমার সঙ্গে। কতো রাত কতো দিন কেটেছে এসব আলাপ করে করে! কিন্তু ও সেই প্রাইমারি থেকেই আমার সব কথা ওর মায়ের সঙ্গে শেয়ার করতো, যেটা আমি কখনো করতাম না। ফলে, আমাদের বৃহত্তর পরিবার জানতো, আমি ছোটবেলাতেই নষ্ট হয়ে গেছি। আর ওদিকে আমার ওই কাজিন ছিলো মহামহোপাধ্যায় পুত-পবিত্র। অথচ ওর সব কাহিনিই কিন্তু আমি জানতাম, আজ ফাঁসও করে দিতে পারতাম। কিন্তু না, ঠিক হবে না। সমাজে সবারই তাদের নিজ নিজ দুই নাম্বারি নিয়ে বেঁচে থাকবার অধিকার আছে।  
কথা, দম আর স্বাস্থ্যের ভ্যারিয়েশন নিয়ে যে যেভাবে পারে বাঁচুক না।  

সে বাঁচুক, কিন্তু একটা ঠিকঠাক মতো প্রেম না করেও অপবাদের ভাঙা কলস আমার গলায় চড়ে নাচতে থাকলো দীর্ঘদিন – এটা কিন্তু মোটেও ভালো কাজ হয়নি। পৃথিবীতে কিছুই যে চিরস্থায়ী নয়, মৃত্যুই মনে হয় প্রথম সে প্রমাণ রেখেছে। ফুটফুটে কন্যাশিশু, কিউট বাচ্চা, বা ভাগ্যবতী বাচ্চার ভাগ্যেও অনাদর অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য জুটতে পারে একেবারে ভিত্তি-ছাড়া বিশ্বাস আর সিদ্ধান্তের কারণে।

গায়ের রঙ, সৌভাগ্যের আদরের রঙ বদলে যাওয়ার এই নিয়তি অনেক মেয়েকেই বহন করতে হয় জগতে। আমিও করেছি। দাদি আমার আরেক দফা বিয়ের কথা পাড়তে লাগলেন। এমনকি পাত্রও জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। যেসব মেয়ে একা একা চলা-ফেরা করতো তাদের দেখে প্রায়ই মন খারাপ হতো। ভাবতাম, আমি কি এতোই খারাপ মেয়ে যে একা একা চলতে পারবো না? প্রেম-ভালোবাসার বোধ কার মধ্যে জাগে না এই বয়সে? না জাগাটাই তো অস্বাভাবিক। জাগাটা স্বাভাবিক। আর অস্বাভাবিক সম্পর্ক হলে খুব সুন্দরভাবে চারপাশের মানুষের বোঝানো উচিত। আমার মতো গৃহবন্দি পশুতে পরিণত করা উচিত না। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় গানের শিক্ষক রূপকুমার স্যার একদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি নাকি আজকাল দুষ্টামি করছো?’ স্যার কেন জানিনা ‘প্রেম করছো’ কথাটা বলতে পারেননি সেদিন।
প্রেম সবসময়ের জন্য একটা পাপ ও অসামাজিক কাজ – হয়তো সে কারণেই!  কিন্তু আমি ভাবলাম, কীরে আমি কী এমন করেছি যে রটনা এই পর্যন্ত এসে পড়েছে! ঠিকঠাক একটা ডেটও তো করতে পারিনি! অথচ, যারা প্রেম করত তখন, তাদেরকে কতো দেখতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে বসে গল্প করছে। আমি তো আক্ষরিক অর্থেই এসব করিনি। শুধু চিঠি বিনিময় আর রাস্তায় আসা-যাওয়ার পথে এক দুইটা কথা। এতেই এতোদূর!
 
নানা আমার এসবকিছু ঘটার আগেই তাঁর মৃত্যু-শয্যায় এই কথা বলে গিয়েছিলেন, ‘বু, লোকে যেন তোমাকে মন্দ না বলে!’
 
হায়, লোকে তো মানুষের মন্দ ছাড়া কখনো ভালো বলার প্রাক্টিস করে নাই! এটা আমার সহজ-সরল ভালোমানুষ নানাভাইকে তখন কে বোঝাবে! ১৯৯৪ সালে আমার নানা মারা যান। জীবনে প্রথমবারের মতো পরিবারের কারো মৃত্যু এতো কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হলো। এর আগেও লাশ দেখেছি, কিন্তু সেটা পাড়া-বেড়ানি সূত্রে, দূরের মানুষের।

মৃত্যু হলো আমার প্রথম ভালো লাগারও।
‘মোর প্রথম মনের মুকুল, ঝরে গেল হায়!’

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি