কারা এই হুথি: প্রতিশোধের অঙ্গীকার কেন? 

হুথি বিদ্রোহীরা

কারা এই হুথি: প্রতিশোধের অঙ্গীকার কেন? 

সাজ্জাদ এইচ. সাব্বির

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরই আবার আলোচনায় হুথিরা। হামাসের ওপর চালানো ইসরায়েলি আক্রমণের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই হুূথিরা। চালাচ্ছে আক্রমণও। গত অক্টোবরে গাজা যুদ্ধ শুরু হলে হামাসের প্রতি সমর্থন জানায় হুথি বিদ্রোহীরা।

তাদের সমর্থনের অংশ হিসেবে নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে ইসরায়েলগামী ও ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জাহাজে হামলা করে আসছে তারা।

হুথিদের দাবি, গাজায় নির্বিচার হামলার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা। এছাড়া হুঁশিয়ারি দেয়, ইসরায়েল গাজায় হামলা বন্ধ না করলে লোহিত সাগর হয়ে ইসরায়েল অভিমুখী যেকোনো জাহাজে হামলা চালাবে তারা। গত নভেম্বরেই এই ঘোষণা দেয় গোষ্ঠীটি।

তারপর থেকে বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে গোষ্ঠীটি।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে এই হুথিরা কারা? কেনই বা গাজার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে নেমেছে তারা? তাদের অভিসারই বা কী? 

হুথি কারা 
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, ইয়েমেনে গত এক দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের একটি পক্ষ হুথি, যারা পরিচিত আনসারুল্লাহ নামেও। মূলত ১৯৯০ এর দশকে তাদের উত্থান। তাদের নেতা হুসেইন আল-হুথি শিয়া ইসলামের জাইদি ধারার অনুসরণে ধর্মীয় পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলন শুরু করেন।

জাইদিরা কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়েমেন শাসন করলেও ১৯৬২ সালে গৃহযুদ্ধের পর সুন্নিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সুন্নি মৌলবাদ মোকাবিলা, বিশেষ করে সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ওয়াহাবি মতবাদ মোকাবিলায় আল-হুথি এই আন্দোলন গড়ে তোলেন।

জায়দি ধর্মীয় নেতা হুসাইন আল-হুথির নেতৃত্বে হুথিরা ইয়েমেনের রাষ্ট্রপতি আলী আবদুল্লাহ সালেহর বিরোধী আন্দোলন হিসেবে প্রথম আবির্ভূত হয়, যার বিরুদ্ধে হুথিরা দুর্নীতি এবং সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মদদপুষ্ট হওয়ার অভিযোগ এনেছিল। ২০০৩ সালে লেবাননের শিয়া রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন হিজবুল্লাহ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, হুথিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাদের সাংগঠনিক স্লোগান গ্রহণ করে। এরপর সালেহ কর্তৃক আল-হুথিকে গ্রেপ্তারের আদেশ জারি করার কারণে ইয়েমেনে শুরু হয় হুথি বিদ্রোহ।

হুসাইন আল-হুথি 

২০০৪ সালে সাদায় ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর হাতে কয়েকজন দেহরক্ষীসহ নিহত হন আল-হুথি। তারপর থেকে আন্দোলনটি বেশিরভাগ সময়েই তার ভাই আব্দুল মালিক আল-হুথির নেতৃত্বে সক্রিয় রয়েছে।

অস্ত্র কোথা থেকে পায়? 
জানা গেছে, হুথিরা বেশিরভাগ অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে সৌদি আরবের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংঘাতের সময়। মার্কিনিদের দাবি, হুথি বাহিনী ইরানের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক জাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পেয়েছে। এছাড়া ইয়েমেনের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তারা বেশ কিছু ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে সেগুলো নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। এছাড়া তাদের কাছে আরও উন্নত অস্ত্র আছে। রাশিয়া ও চীনের ডিজাইন করা অস্ত্রও তাদের কাছে আছে।

কীভাবে আক্রমণ চালায়? 
হেলিকপ্টার ছাড়াও হুথিরা তাদের সাম্প্রতিক হামলাগুলোতে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে বাণিজ্যিক জাহাজে মনুষ্যবিহীন উড়ন্ত যান বা কথিত ‘কামিকাজে ড্রোন’ ব্যবহার করে হামলা করেছে তারা। এর আগে তারা কাসেফ ড্রোন ব্যবহার করতো। এছাড়া ভি-আকৃতির এয়ারক্রাফটের সাথে দূরপাল্লার সামাদ।

হুথিরা কতটা শক্তিশালী
হুথিদের তৈরি মিসাইলের পরিসর, লক্ষ্যভেদী নিশানা ও মারণঘাতী সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা পেতে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে মার্কিন কর্মকর্তারা। মার্কিন গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা সিএনএনকে আগে জানিয়েছিলেন, প্রথমদিকে ইরান থেকে আলাদা আলাদা সরঞ্জাম চোরাপথে ইয়েমেনে এনে স্থানীয়ভাবে অস্ত্র তৈরি করতো হুথিরা।

তিনি জানান, হুথিরা বেশ কার্যকর মডিফিকেশন ঘটিয়েছে, যার ফলে তাদের যুদ্ধাস্ত্রের বেশ উন্নতি ঘটেছে। এর ফলে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তারা দক্ষিণ ইসরায়েলের এইলাতে মধ্যম পরিসরের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে, যা পরে ভূপাতিতের কথা জানায় ইসরায়েল। ইসরায়েলের জন্য হুথিরা এখনো তেমন বড় কোনো হুমকি না হলেও তাদের প্রযুক্তি লোহিত সাগরে বিপর্যয় ঘটাতে সক্ষম।

হুথির হামলায় অর্থনীতিতে ধস

গত ৯ ডিসেম্বর থেকে প্রায় প্রতিদিনই লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ টার্গেট করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে হুথিরা। এতে নতুন করে বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে ঘনঘটা তৈরি হয়েছে। হুথিদের হামলার এরইমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচটি শিপিং ফার্মের মধ্যে চারটি মায়েরস্ক, হাপাগ-লয়েড, সিএমএ সিজিএম গ্রুপ ও এভারগ্রিন লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে। যার প্রভাবে বিশ্ব বাজারে বেড়েছে তেলের দাম। গ্যাসের মূল্যও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বলে রাখা ভালো, হুথিদের হামলা এড়াতে চাইলে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা হয়ে অধিকতর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। এতে খরচ বাড়বে বহুগুণে। বিমা খরচও বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে পণ্য পরিবহনের খরচও যদি বাড়ে তবে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেবে। এতে করোনা মহামারি পরবর্তী মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সরকারকে আরেকটি নতুন ধাক্কা সামলাতে হবে।

তেলের দাম বেড়েছে ৪ শতাংশ

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনী ইয়েমেনের সরকার বিরোধী হুথি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এই হামলার পরেই গত শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) সকালের তেলের দাম ৪ শতাংশ বেড়েছে। ওই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যার মধ্যে ওই অঞ্চল থেকে তেলের সরবরাহকে হুমকিতে ফেলতে পারে। হুথিদের হামলা সীমাবদ্ধ ছিল লোহিত সাগরে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এই উত্তেজনা যদি হরমুজ প্রণালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তেলের সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। হরমুজ প্রণালী ব্যবহার করে প্রতিদিন দুই কোটি ব্যারেল তেল পরিবহন হয়ে থাকে, যা বৈশ্বিক তেল চাহিদার বিশ শতাংশ।

ফলে শেষ পর্যন্ত এই উত্তেজনা যদি হরমুজ প্রণালী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে, তবে বলাই বাহুল্য, বিশ্ববাজারে আরও বাড়তে চলেছে তেলের দাম।  

ইসরায়েলের অর্থনীতিতে ক্ষতি করেছে?
ইসরায়েলের বেশিরভাগ বাণিজ্য হয় ভূমধ্যসাগরের মাধ্যমে, তবে হুথিদের হামলার প্রভাব এখনো সেভাবে পড়েনি। তবুও, ইসরায়েলের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি বাড়ছে বলেই জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা একমত হয়েছেন যে, ইসরায়েলের অর্থনীতিতে হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণের প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত হয়েছে, যত বেশি সময় ধরে ব্যাঘাত চলতে থাকবে, তার প্রতিক্রিয়া তত বেশি হতে পারে।

হুথিরা বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে কয়েক ডজন হামলা চালিয়েছে যেগুলো তারা ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করে। হুথিরা বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে আক্রমণে পর থেকেই লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচল ৪০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে যা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইন ব্যাহত করছে। বিশ্বের কিছু বড় শিপিং অপারেটর আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের কেপ অফ গুড হোপের চারপাশে তাদের জাহাজগুলোকে পুনঃনির্দেশিত করেছে, ডেলিভারির সময়ও বিলম্বিত করেছে এবং তাদের নিয়মিত রুটে আরও ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার নটিক্যাল মাইল বা ৬ হাজার কিলোমিটার যোগ করেছে করেছে। যার প্রভাব বিশ্ব বাণিজ্য পড়তে পারে বলেই মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বের ব্যস্ততম সামুদ্রিক রুটে কী ঘটছে?
নভেম্বরে ইসরায়েলি-সংযুক্ত গ্যালাক্সি লিডার জাহাজটি দখল করার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২৬টি জাহাজ হুথিরা আক্রমণ করেছে। লোহিত সাগরে সুয়েজ খালের মাধ্যমে এশিয়াকে ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ শিপিং লোহিত সাগর দিয়ে যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ, ৩ বিলিয়ন থেকে ৯বিলিয়ন মূল্যের পণ্য বহন করে। যা বছরে শেষে দাঁড়ায় এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।

সমস্ত শিপিং জাহাজ প্রভাবিত হয়?
এই পর্যন্ত হুথিদের আক্রমণে কন্টেইনার শিপিংজাহাজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যাইহোক, এই সপ্তাহের শুরুতে রয়টার্সে প্রকাশিত তথ্য দেখায় যে তেলের ট্যাঙ্কারগুলোর উত্তরণ খুব কমই প্রভাবিত হয়েছিল। মারিট্রাকের ডেটা দেখায় যে, ডিসেম্বর মাসে, গড়ে ৭৬টি তেল ও মালবাহী লোহিত সাগরে ছিল, যা আগের মাসের গড় থেকে মাত্র দুই কম, অন্যান্য ট্র্যাকাররা একই সময়ের মধ্যে একটি প্রান্তিক বৃদ্ধির রিপোর্ট করেছে। জানুয়ারির শুরুতে, হুথি বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছিল যে, এই অঞ্চলটি ট্রানজিট করতে ইচ্ছুক একটি জাহাজ জলসীমায় প্রবেশের আগে তার মালিকানা এবং গন্তব্য ঘোষণা করলে, তার উপর গুলি চালানো হবে না।

অন্যত্র কীভাবে প্রভাব পড়ছে?
ক্লার্কসন রিসার্চ সার্ভিসেস লিমিটেডের মতে, লোহিত সাগরের মাধ্যমে ট্র্যাফিক বর্তমানে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে রেকর্ড করা ৪৪ শতাংশ কম, কারণ ক্রমবর্ধমান সংখ্যক জাহাজ কেপ অফ গুড হোপের চারপাশে বন্দরে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ পথ নেয়। সেইসঙ্গে বর্ধিত জ্বালানী এবং জনশক্তির সুস্পষ্ট খরচ, এটি বীমা খরচ বৃদ্ধি করে এবং বিলম্বের কারণ হতে পারে, কারণ বন্দরে যানজট তার টোল নেয়।

ড্রুরি ওয়ার্ল্ড কন্টেইনার ইনডেক্স অনুসারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে আটটি প্রধান রুট বরাবর শিপিং ট্র্যাক করে, চীন থেকে ইউরোপে একটি ৪০-ফুট (১২-মিটার) কন্টেইনার পরিবহনের খরচ নভেম্বরে ১১৪৮ ডলার থেকে ২৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ড্রুরির কন্টেইনার গবেষণার একজন সিনিয়র ম্যানেজার সাইমন হেনি আল জাজিরাকে বলেছেন যে সামগ্রিক ব্যয় ৩ থেকে ২১ শতাংশের মধ্যে যেকোনো জায়গায় বাড়তে পারে।

সফল হতে পারবে হুথিরা? 
অস্ত্র ব্যবহার করে ইরানের প্রক্সি হিসেবে কাজ করতে পারে হুথিরা। হরমুজ প্রণালিতে ইরান যা করার হুমকি দিয়েছে, বাব আল-মান্দাব প্রণালিতে তারা ঠিক তা-ই করার সক্ষমতা রাখে। এই প্রণালি ইয়েমেনের একদম কোল ঘেঁষে চলে গেছে। এই প্রণালি আটকে দিলে লোহিত সাগরের মুখে ফাঁদ তৈরি করা সম্ভব। সেখান থেকে ইসরায়েলে হামলা করে তেমন একটা ফায়দা হবে না, তবে লোহিত সাগরে চলাচলরত জাহাজের ওপর হামলা করার জন্য এ অবস্থান যথাযথ।