আমার বিজ্ঞাপন

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৬

আমার বিজ্ঞাপন

অনলাইন ডেস্ক

একটি রটনামুখর খণ্ডকালীন প্রেম-ঘটনায় বন্দি হলাম গৃহে। সঙ্গী হলো গান এবং মাকে রান্নার কাজে হেল্প করার জন্য খুব অপছন্দের কিছু সময়। যে সময়গুলো আমার দিকে তার রাক্ষসী দাঁত বের করে কেলানো মার্কা হাসি হাসতো। কোথায় আমি প্রজাপতি ধরে বেড়াবো, সবুজ মাঠ আর ধূসর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবো, গোলাপ বাগান আর বেগুনি কচুরিপানা দেখে বেড়াবো, তা না করে ঘর থেকে দৈত্যের মতো শিল-পাটা বের করে নিয়ে ঘরের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা কাঁচা হেঁসেলের মধ্যে কাঠের পিঁড়ি পেতে রান্নারত মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে হতো।

আবার রান্না শেষে সেই শিল-পাটা আর মসলার ঝুড়িকে ঘরে রেখে আসা লাগতো সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতকের মতো প্রবল যত্নের সাথে। ঘরের কাজে আমি ছিলাম ভাইয়ার চেয়ে অকর্মণ্য আর অমনোযোগী। সেজন্য মায়ের বকাও কম জোটেনি বরাতে।

আরও পড়ুন:‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

আব্বুর বন্ধু হেমায়েত কাকু আব্বুকে বলতেন, 'শাহাদৎ, তোর মেয়েটা ছেলে হলে আর ছেলেটা মেয়ে হলে ভালো হতো।

' এরকম কমপ্লিমেন্ট আর অনিচ্ছার পুরি সেবন করা সত্ত্বেও আমি ঘরের কাজ নিয়মিতভাবে করতাম। বাড়িতে কাজের লোক থাকতো বরাবরই। তারা থাকতো বৃহত্তর কাজের সঙ্গে যুক্ত। যেমন, গরুর খাবার দেয়া, গরুর খাবার দেয়া এবং গরুর খাবার দেয়া।  
ভাবছেন ভুলে একই বাক্য তিনবার বলছি?
না, মোটেও তা না। অনেক সময় গুরুত্ব বোঝাতেও তিনবার বলতে হয়। ইসলামেও তো ৩ সংখ্যাটির গুরুত্ব অনেক।

আমাদের বাড়িতে তখন গরুর খেদমত করাই ছিল বাড়ির সব থেকে বড়ো কাজ। আর গৃহস্থালি কাজ হচ্ছে ছোটো-খাটো কাজ। এই নিয়ম আব্বুর বানানো। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাপড় কাচা, ধোয়া, নাড়া, গোছানো, বিছানা গোছানো, আসবাবপত্র মোছা, ঘর থেকে একটু দূরে একা একা দাঁড়িয়ে থাকা লাল রঙের টিউবঅয়েল থেকে স্বচ্ছ ও মিষ্টি খাবার পানি জগে ভরা, অতিথি আসলে তার সেবার জন্য আঠার মতো লেগে থাকার দায়িত্ব ছিলো আমার আর ভাইয়ার। আর বাসায় তখন মেহমানেরও অভাব পড়তো না। কী ধরনের মেহমান আসতো তার একটা নমুনা দেই। আমার একমাত্র ফুফু ও তার পরিবার, ফুফুর শাশুড়ি-দেবর, দেবরের শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলি ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু এরকম না, অনেক অনেক কাছের ও দূর-সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনও আসতো আমাদের বাড়িতে। আসল ঘটনা হলো, আমাদের বাড়িটা তখন মোটামুটি সেন্টারে ছিলো। গ্রাম থেকে আসা সবার সব ধরনের পৌর-কাজ এখানেই হতো। আবার শহর থেকে যাওয়া শহুরেদের জমিজমা বা অন্যান্য কাজের সেন্টার ছিলো আমাদের বোয়ালমারী। এটা তখন না পুরোপুরি গ্রাম না পুরোপুরি শহর। সাপ্লাইয়ের পানিও পাওয়া যেত, আবার কলের পানিও মিলতো। বাড়িতে বাড়িতে ঢেঁকিও ছিলো, আবার কাছাকাছি ম্যাশিনও পাওয়া যেত। এখন অবশ্য সব বদলেছে। পুরো পৌর শহর এখন রাজধানীর আদলে (ঢাকার শহরের সঙ্গে অদৃশ্য পাল্লা চলে যেন!) চলছে। চারিদিকে শুধু উন্নয়নের ধুলোবালি; আকাশে চোখ পাতলে চাঁদ দেখা যায় না, ছাদে ছাদে সয়লাব সব পাড়া, মহল্লা। ঢেঁকিঘর বিলুপ্ত হয়েছে। টিউবঅয়েল অবশ্য অতোটা হয়নি। তবে শোবার ঘরের সঙ্গেই সব ওয়াশরুম জুড়ে গেছে। ঘর থেকে রাতের অন্ধকারে দূরের 'ল্যাট্রিনে' এখন আর কেউ যায় না। পুকুরের প্রায় সমস্ত গোসল এখন গৃহের প্রক্ষালন কক্ষেই চলে।  

আরও পড়ুন:প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

বোয়ালমারী জর্জ একাডেমির পুকুরে আমি, আব্বু, ভাইয়া রেগুলার গোসলে যেতাম। আমাদের মতো অনেকেই যেতেন। এলাকার একজন খুব পরিচিত মানুষও যেতেন, যিনি কখনোই নিজে সাবান নিতেন না এবং অন্যের সাবান দিয়ে গোসল সারতেন। এমনকি লুঙ্গির ভেতরেও আপন মনে সাদাসাদা ফেনা গজানোর জন্য ডলা দিতেন। উদ্দেশ্য আসলে পরিষ্কার করা নাকি ফেনা তোলা, নাকি অন্যের সাবানের ফাউ ব্যবহার, তা বোঝা মুশকিল। ফলে ওই ভদ্রলোক যদি ঘাটে থাকতেন, পারতপক্ষে আমি বা ভাইয়া সেদিন পুকুরে গোসল করতাম না। দূর থেকে যদি দেখতাম উনি আছেন, আমরা আর ত্রিসীমানায় ঘেঁষতাম না। একবার ঘটলো কী, ভদ্রলোককে দেখে কেউ আর ঘাটে নামে না। সবাই আমাদের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে ভদ্রলোক কী করেন। ওমা, দেখি যে তিনি পুকুরের পাড় থেকে একটুখানি মাটি টুকিয়ে এনে তাই দিয়ে মাথা আর গা ডলছেন। লুঙ্গির ভেতরের পার্টটাকে বাদ দিয়েই। ভদ্রলোক কিন্তু বেশ ধনী ছিলেন, এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন সশস্ত্র যোদ্ধা ছিলেন। পরবর্তীকালে পারিবারিক কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপির কর্মী হয়ে ওঠেন।
আহা, সেই ভদ্রলোকও হয়তো এখন গৃহের প্রক্ষালন কক্ষে আপন সাবানের সদ্ব্যবহার করে থাকেন!

এখন ঘর থেকে বের হলে পুরনো সেই মানুষজন দেখি না বললেই চলে। নতুন নতুন মানুষ আর নতুন নতুন বাড়িঘর। যেমনটা হয় আর কি! বিশ্বায়ন, শিল্পায়নের ধারাবাহিকতায় নগরায়ণও হরেদরে ঘটে।

তো, আমাদের ওই সময়টাতে অতিথির আগমন-প্রস্থানে ভাইয়া আর আমার আতিথেয়তা চলতো মেইন সাবজেক্টের মতো। আর পড়াশোনা ছিলো ফোর্থ সাবজেক্ট। আব্বু-আম্মু যেহেতু কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেছেন, সেহেতু তাঁরা ধরেই নিয়েছিলেন, আমাদের এইসব আতিথেয়তা কোনো ব্যাপারই না। ভাইয়া ছিলো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এসব কাজবাজের পরেও সুন্দর পড়াশোনা করতে পারত। আমি পারতাম না, পারিও না। পড়াশোনার জন্য আমার চাই নিরিবিলি গুহাবাস। এর বাইরেও পড়ি, কিন্তু সে পড়া মনে ধরে লেখকের গুণে, পাঠকের গুণে নয়।

আরও পড়ুন:ভাইয়ার 'মনাভাই'

এসবের সঙ্গে সঙ্গে আমার জবরদস্ত সংগীত-চর্চা শুরু হলো ক্লাস সেভেন-এইটের দিকে। প্রথম প্রথম মা অবশ্য একটু জবরদস্তিই করেছেন। তারপর নিজেই ফিরেছিলাম। এর ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক গল্পের বই পড়াও চলতো। বইয়ের জোগানদার আমার ভাই, আমার মায়ের মামাতো ভাই পরাগ মামা, আর আব্বুর সেই বন্ধু হেমায়েত চাচা। চাচাই প্রথমে আমাকে 'এপিটাফ' বইটি গিফট করেন ১৯৯৫ সালে।  

জীবনের প্রথম পড়া উপন্যাসটা একটানা পড়ে শেষ করি। উপন্যাসে ক্যান্সার-আক্রান্ত নাতাশার বিষণ্ণ চেহারা আমার ভেতরে কেমন যেন চিরদিনের বিষণ্ণতার বীজ বুনে দিয়েছিলো। বা যদি এভাবে বলি, আমাকে প্রভাবিত করতে পারা বিষয়গুলোর মধ্যে ‘এপিটাফে’র নাতাশা ছিল প্রথম।
একটু কষ্ট পেলেই আমি মেয়েটার কথা মনে করে কাঁদতাম। তুচ্ছ কান্নার বিষয়ে আমি 'এপিটাফ'কে স্মরণ করতাম সবসময়। আর ডিকশনারি থেকে 'এপিটাফ' শব্দের অর্থ খোঁজার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আমাকে ইংরেজি ভোকাবুলারির ওয়ার্ল্ডে কীভাবে যেন পাঠিয়ে দিলো। মনে আছে 'এপিটাফ' শব্দের অর্থ খোঁজার জন্য জীবনে প্রথমবারের মতো ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারিতে শব্দের অর্থ খোঁজার পদ্ধতি শিখি। এরপর থেকে ইংরেজি কার্টুন আর ইংরেজি গানের লিরিক্স দেখে দেখে গান শোনার অভ্যাস হয়। ভাইয়া অবশ্য জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইংরেজি কার্টুন আর ইংরেজি মুভি দেখতেন, ইংরেজি গান কম শুনতেন। আমি শুনতাম, এবং সেটা রাতদিন মাদকের মতো তাড়িত করতো আমাকে।

আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো তখন 'ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ'। 'ভেঙ্গা বয়েজ', 'ওয়েস্ট লাইফ', 'এনসিং', 'ব্লু', 'ব্রিটনি স্পিয়ার্স', 'এনরিক এগলিসিস', 'জেনিফার লোপেজ', 'জর্জ মাইকেল', 'একোয়া', 'রিকি মার্টিন', ভাইয়ার কাছে থাকা 'ম্যাডোনা', 'মাইকেল জ্যাকসন', 'মর্ডান টকিং' 'বনি এম' ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে ২০০১ সালে আমার মন কেড়ে নিল শাকিরা তার 'হোয়েনেভার হয়ারেভার' গানটি দিয়ে। আমার ইংরেজি শেখার ব্যাপারে আম্মু-আব্বুর খুব একটা চাপাচাপি করা লাগেনি এ জন্য। ভাল্লাগতো ইংরেজি। অথচ, বাংলা পড়তে গিয়ে এই ভালো লাগাকে ছুঁড়ে ফেলেছি। পুরো পাঁচ বছরে অনেক কিছুই ভুলে গেছি, আর এখন তো একটা বাক্য বলতে গেলে তিনবার ভাবতে হয়। অথচ স্কুলে থাকতে ইংরেজিতে কবিতাও লিখতাম আমি। অবহেলায় কী হয়, সেটার ব্যাপারে আমার এই ইংরেজি ভোলার বিষয়টা একটা ভালো উদাহরণ হিসাবে গণ্য হতে পারে।  

আরও পড়ুন:‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

আমরা টিনের ঘর থেকে বিল্ডিঙে উঠি ১৯৯৯ সালে। তখন বাড়িতে ডিসের লাইনও এসে যায়। আব্বু-আম্মু রঞ্জিত মল্লিকের কী যেন একটা সিরিয়াল দেখতেন মনে নেই। আমি দেখতাম ইটিসি আর এমটিভি, মিউজিক চ্যানেল। শাকিরাকে আমি প্রথম এমটিভিতে দেখি। সেই থেকে আজ অবধি শাকিরার কণ্ঠ আর কোমরের মহাভক্ত আমি। চুল আর মুখেরও। ভদ্রমহিলার স্বতঃস্ফূর্ত কণ্ঠ-ভাঙানো আর কোমর-দোলানো আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলো এবং এখনও পারে। 'এপিটাফ'-এর মতো ঘোর বিষণ্ণতা কাটাতে আমাকে দুর্দান্ত সাহায্য করে শাকিরার কণ্ঠ আর কোমর।

শৃঙ্গার ভঙ্গিমার বেলে নাচকে তিনি নান্দনিক উৎকর্ষের চূড়ান্ত লেভেলে পৌঁছে দিয়েছেন। কারো প্রতি এমন প্রাচীন মুগ্ধতা এখনও ধরে রাখতে পেরেছি কেবল শাকিরা বলেই। ম্যাডোনা ও জেনিফার লোপেজও ভাল্লাগতো, কিন্তু এমন মুগ্ধতা কন্টিনিউ করেনি। আমার এই ভালো লাগা সমানে ডিগবাজি খেতে শুরু করে যখন জানলাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজও শাকিরার কোমর ও কণ্ঠের ভক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মার্কেজের একটা সাক্ষাৎকার পড়ে জেনেছিলাম এটা। এছাড়া আমার বর মোহাম্মদ আজমেরও নাকি শাকিরা খুব প্রিয়। এসব জানার পর মনে হয়েছিলো – নাহ, আমি ঠিক রাস্তাতেই আছি! শিল্পজগতের বিচিত্র রাস্তার মধ্যে কোনো প্রকার গোঁড়ামি আমাকে তেমন স্পর্শ করতে পারেনি কোনোদিন!

শাকিরার প্রতি প্রেমবশত আমি তার 'হোয়েনেভার হয়ারেভার' গানটা আছে এমন একটা ক্যাসেট কিনলাম বাজার থেকে। ও, বলে নেয়া ভালো, আমার গান শোনার শুরুর আমলটা ছিল ক্যাসেট প্লেয়ারের। দুটো সাউন্ডবক্সসমেত ধূসর একটি শিশুতোষ ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে আনা হলো আমার স্কুলে না-যাবার বয়সে। সারা দিন-রাত শুধু অন্তরা চৌধুরীর 'মাছি' গান শুনতাম। একদিন গভীর রাতে ক্যাসেটের গান শেষ, আম্মুকে নাকি ডেকে তুলে বলেছিলাম 'মা মা, মাছি গান ভেজে দাও। '
এ গল্পটা প্রায়ই শুনি মায়ের কাছে।  

সুরের প্রতি আমার আজন্ম আকর্ষণ। গানের ব্যাপারে প্রথমে সুর আমাকে নক করে, পরে কথার সঙ্গে সম্পর্ক হয়। তারপরে গানটি আমার স্মৃতি-কোষে দিব্য-আনন্দে সুর চষে বেড়ায়।

ফিরে যাই শাকিরার কাছে। শাকিরার একটা অ্যালবাম কিনে এনেই আগে 'হোয়েনেভার হয়ারেভার' গানের লিরিক্স দেখে দেখে গান শুনতে লেগে গেলাম। এক জায়গায় এরকম আছে – 'Lucky that my breasts are small and humble'. আমি ভেবেই পেলাম না, স্মল ব্রেস্ট আবার হাম্বল হয় কী করে! এই বাক্য দিয়ে ভালো কিছু বোঝাচ্ছে, নাকি খারাপ! 
আসলে বয়সটাই ছিলো এসব নিয়ে ভাবনার! আর সেকারণেই ইংরেজি শেখার আগ্রহও তীব্র হয়েছিল।

ওই বয়সে ইংরেজি ভোকাবুলারিতে আমার আগ্রহ আর সিদ্ধি তুলনামূলক খারাপ ছিলো না। তারপরও আব্বু গ্রামারের বেসিক শেখানোর জন্য সুধীরকুমার পাঠক স্যারকে ঠিক করে দেন।
পাঠক স্যার ছিলেন কড়া ব্রাহ্মণ, আর ছাত্রী হিসেবে আমি ছিলাম মিছকা শয়তান। আমার জীবনের বেস্ট শিক্ষকদের তালিকায় আমি পাঠক স্যারকে প্রথমে রাখবো। কারণ, তিনি আমাকে শুধু ইংরেজি শেখাননি, শিখিয়েছেন আরও অনেক আদব। যেমন, শিক্ষকের সামনে পা তুলে বসা যায় না, গুরুজনের সঙ্গে কীভাবে আদবের সঙ্গে কথা বলতে হয় ইত্যাদি। স্যার একই সঙ্গে কড়া ব্রাহ্মণ এবং কড়া শিক্ষক ছিলেন। হোমওয়ার্ক না করলে দুই আঙুলের মাঝখানে কলম দিয়ে চেপে রেখে মাইর দিতেন। মার দেয়া আর একজন শিক্ষকের কাছে ব্যাচে গিয়ে পড়েছি কিছুদিন। তিনি হলেন বোয়ালমারী জর্জ একাডেমির শিক্ষক মুরারীমোহন পোদ্দার স্যার। তিনি আব্বুর খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাতে কী? মাইরের ব্যাপারে কোনো খাতির নাই। মুরারী স্যারের মাইর খায়নি এমন শিক্ষার্থী বোয়ালমারীতে একজন ছিলো কিনা সন্দেহ। তবু সবার একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, মুরারী স্যারের কাছে পড়লে অংকে ৯০/১০০ পাওয়া যায়। স্যার অদ্ভুত কিছু মাইর দিতেন। অংক ভুল হওয়া মাত্রই কপালে আঙুল দিয়ে এমন জোরে টাক দিতেন যে মাথা ঝাঁঝাঁ করতো। মুরারী স্যারের কাছে আমি নিজের অংক না পারার জন্য মাইর তো খেতামই, সঙ্গে বণিকবাড়ির রত্নাদির জন্যও খেতাম। স্যার অধিকাংশ সময় আমাকে রত্নাদি মনে করে কথা বলতেন, মাইর দিতেন। অথচ, দিদি পড়তেন আমার উপরে আর ভিন্ন ব্যাচে। দুজনের চেহারা প্রায় কাছাকাছি ছিলো। তাই আমার অংক হলেও তিনি রত্নাদি ভেবে এবং অংক হয়নি ভেবে, অংক না দেখেই কপালে টাক দিতেন। বেশ কয়েকবার ঘটেছে এটা।

আরও পড়ুন:‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

আমার ভাইয়াও পড়তো মুরারী স্যারের কাছে। অনেকসময় ভাইয়াকে দেখতাম মাইরের ভয়ে ফাঁকি দিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তো এবং ঘুমিয়ে থাকতো। পরে জানাজানি হলে আব্বুর হাতে চ্যালাকাঠের মাইরও খেতো।  
ভাইয়া নিজেই যেতো না আর আমাকে আমার সেই বিখ্যাত রটনামুখর প্রেমের কারণে মুরারী স্যারের কাছে পড়া বাদ দিয়ে দেয়া হলো। শুরু হলো পাঠক স্যারের কাছে ইংরেজি আর অংক শেখা। অংক আব্বুও করাতেন। কিন্তু রেগুলার বসতে পারতেন না নানা ব্যস্ততার জন্য।  
পাঠক স্যার আমার প্রিয় শিক্ষকদের তালিকায় থাকার অন্যতম কারণ, স্যার আমাকে অনেক সহ্য করতেন।
স্যারের সঙ্গে আমি বহুত মজা করতাম।
দুই-একটা উদাহরণ দিলে বুঝবেন।

স্যারের খুব বাজে অভ্যাস ছিল টেবিলের পাদানিতে পা রেখে নাড়ানো। আমার লিখতে অসুবিধা হতো। একদিন স্যার আসার আগে টেবিলের ওই পায়ায় আমি চুইঙ্গামের আঠা লাগিয়ে রাখি। স্যার যথারীতি পা রেখে নাড়াতে শুরু করেন। পায়ের পাশ ফেরাতে গিয়ে দেখেন পা আটকে আছে। স্যার তো রেগেমেগে অস্থির হয়ে মাকে ডেকে নালিশ করে বললেন, 'না আপা, আপনার মেয়েকে আমার পক্ষে আর পড়ানো সম্ভব না। ' এরকম বহুবার বহু দুষ্টামির পরে স্যার কতোবার যে ছেড়ে গেছেন তার হিসাব নাই। আবার ফিরে আসতেন। স্যার আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। দুষ্টু স্টুডেন্টদেরকে শিক্ষকেরা তুলনামূলক বেশি স্নেহ করে থাকেন। আরেকবার হলো কী, স্যার তো পেঁয়াজ না খাওয়া কড়া ব্রাহ্মণ। আমাদের বাড়িতে একবার বেরেস্তা ভাজা হচ্ছে,  সেই বেরেস্তার গন্ধে স্যার রেগেমেগে চলে যান আর পড়াবেন না বলে। এরপর যেদিন এলেন সেদিন স্যারকে নাস্তার সঙ্গে যে গ্লাসে পানি দিলাম, সেই গ্লাসের চারপাশে কাঁচা পেঁয়াজের রস ডলে দিলাম। স্যার কিছু টের না পেয়ে পানি খেয়ে ফেললেন!!
আমি ভয় আর মজার চোখ দিয়ে স্যারকে দেখলাম। স্যার মারলেন না, কিছু বললেনও না, টেরই পেলেন না মনে হলো।
ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত লাগলো! সম্ভবত স্যারের ঠান্ডা লেগেছিলো। পেঁয়াজের ব্যাপারে স্যারের বাড়াবাড়ি রকমের শুচিবায়ু ছিলো। স্যারের পরিবারের সবাই পেঁয়াজ খেতেন, কিন্তু স্যার খেতেন না। শুধু খেতেনই না, কাঁটা চামচ দিয়ে কোনো কাটা ফল খেতে দিলে তিনি ওই কাঁটাচামচও ফেলে দিতেন এটা বলে যে আমরা এই কাঁটাচামচ দিয়ে পেঁয়াজের তরকারি খাই। পাঠক স্যারের সঙ্গে কতো কতো স্মৃতি যে আছে! স্যার আমার জন্য পুজোতে নাড়ু-মুড়কি, গাছের আম-কাঁঠাল নিয়ে আসতেন।  
স্যারের বিদেহী আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

শিক্ষকদের সঙ্গে এরকম মিষ্টি দুষ্টামি আমি আরও করেছি ছোটবেলায়। একবার হাইস্কুলের সন্তোষ স্যারের সঙ্গে বাদাম নিয়ে এক মজার ঘটনা ঘটালাম।
সন্তোষ ব্যানার্জি স্যার। ব্রাহ্মণ কিন্তু অমায়িক। তাঁর মুখে ও পকেটে সবসময় বাদাম থাকতো। একবার ক্লাসে একটু দেরি করে ঢুকেছিলাম। আগেই স্যারকে ক্লাসে দেখেছিলাম। তো দেরির জন্য আমি আর আমার সহপাঠী সুমা সাহা, দুজনে মিলে বুদ্ধি করলাম স্যারের সঙ্গে মজা করার। দোকান থেকে বাদাম কিনে এনে সেই বাদামের এক তৃতীয়াংশ বের করে নিচে ইটের সুড়কি ভরে উপরে কিছু বাদাম দিয়ে দিলাম। স্যারকে বাদাম দেওয়ায় স্যার ক্লাসের দেরির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে এক প্যাকেট বাদাম পেয়ে বিরাট খুশি হলেন। তারপর ক্লাসে নির্ধারিত টেবিলে সেই বাদাম পুরোটা ঢেলে নিলেন। পুরো ক্লাস তখন একযোগে হো হো করে হেসে উঠলো। আর স্যার তাঁর জিহ্বায় কামড় দিয়ে পুরো ক্লাসের সঙ্গে হাসতে লাগলেন। একটি গণ-পরিস্থিতির প্রতিকূলে আসলে কারোরই কিছু করার থাকে না। স্যার আমাদের কোনো শাস্তি না দিয়ে বরং শিশুতোষ মজা উপভোগ করলেন।

বাদাম নিয়ে নানামাত্রিক দুষ্টামি আমি এখনও করি। গত বছরেই একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকের সঙ্গে আমরা জুনিয়র দুই শিক্ষক এরকম মজার দুষ্টামি করেছিলাম। আহা, এইসব মজাকে অনেকে প্রশ্রয় দেন, অনেকে রস না বুঝেই ক্ষেপে যান। আসলে মানুষ বড়ো হয় ঠিকই, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের শিশুটিকে অনেকসময় ভুলতে চায় না। আমার মতো অনেক মানুষই আছেন শিশুর মতো কোমল দুষ্টামি যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলে বিভ্রান্তির প্রকোষ্ঠে বেশিরভাগ মানুষই হোঁচট খায়।  
অন্তরটা শিশুর মতো কোমল করতে পারলে মানুষের প্রতি আবেগটা জারি থাকতে পারে৷ আবির্ভাব মাত্রই পূর্ণতা-নির্ভর মানুষ তো মূলত ম্যাশিন! আর ম্যাশিনের কোনো কালেই আগ্রহ এবং আবেগ কাজ করে না। অভ্যাসই তার যাপনের একমাত্র বাহন। কোনো বিষয়ে আগ্রহ, বিস্ময়, মুগ্ধতা, আবেগ ছাড়াই একটা জীবন কাটিয়ে দেয় কেউ কেউ।  

মজা তার সঙ্গেই করা যায় যে একটু বোকা বনে যায়, অসতর্ক থাকে। সতর্ক লোকজনের সঙ্গে মজা করা যায় না। এর প্রমাণ আমার বর। তাঁকে বোকা বানানো যায় না। বিয়ের প্রথম দিকের কথা। তিনি বেধড়ক সিগারেট খেতেন। তো, আমি একবার এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনে এক-দুইটা শলাকার ভেতর থেকে তামাক বের করে সেখানে ম্যাচের কাঠির বারুদ ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার তামাক পুরে দিলাম। দিয়ে পুরো সিগারেটের প্যাকেট তাঁকে গিফট করলাম। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিস্ময় লুকিয়ে সেটা গ্রহণ করলেন। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন তাঁর গোঁফ জ্বলে উঠবে আর চিরতরে সিগারেট খাওয়া বন্ধ হবে। এই বুদ্ধিটা অবশ্য আমার নিজস্ব নয়। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের 'বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর' বইটা ছোটবেলা পড়া ছিলো। সেখানে শিউলি নামের একটা ছোট্ট মেয়ে কফিলউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এমনটা করেছিলেন। তো শিউলির মতো আমিও অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু ও মা, একি!  আমার অতি বুদ্ধিমান এবং জেমসবন্ড পড়া স্বামী ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তুলনামূলক নড়বড়ে সিগারেটগুলো ধরালেন না। আমি সিগারেট গিফট করছি সেটাতেই নাকি তিনি সন্দেহ করেছিলেন। তার উপর যে শলাকাগুলো আমার ডিজাইন-করা ছিল, সেগুলোকে একটু আলাদা দেখাচ্ছিলো! ফলে তিনি সেগুলো জ্বালালেন না। আহা, এই রকম উৎকৃষ্ট রূপে নাকে ঝামা-ঘষা খাওয়ার পর আমি আর কোনোদিন তাঁর সিগারেট ছাড়ানোর ব্যাপারে কিছু করিনি। তিনি নিজেই অবশ্য মাঝে মাঝে উদ্যোগ নেন এবং অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হন।

যা হোক, আমার ইংরেজি শেখার আগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের 'এপিটাফ'  আর শাকিরাকে  স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করার ব্যাপারে শ্রীকান্ত আচার্য্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজ সালেকীনকে স্মরণ করি। রবীন্দ্র সংগীত আগেও শুনেছি মায়ের বদৌলতে পঙ্কজ মল্লিকদের সুবাদে, কিন্তু মন লেগেছে শ্রীকান্ত শোনার পরে। সেটা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। আর রবীন্দ্র রচনাবলির কয়েক খণ্ড বাসায় থাকা সত্ত্বেও এবং সারাজীবন রবীন্দ্র সংগীত শিখে-গেয়েও একবিন্দু আগ্রহ তৈরি হয়নি ওই বুড়ো সম্পর্কে। দ্বিতীয় বর্ষের 'গল্পগুচ্ছ' পড়াতে পড়াতে সিরাজ স্যার আমার মধ্যে এই বুড়ো সম্পর্কে প্রেমের বীজ বুনে দিতে পেরেছিলেন। স্যার যখন 'শাস্তি' গল্পের 'ছিদাম' চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতেন, তখন  মনে হতো রবীন্দ্রনাথ গল্পকার হিসেবে শ্রেষ্ঠ আর তাঁর ব্যাখ্যাকার হিসেবে সিরাজ স্যার শ্রেষ্ঠ। সঙ্গে ছিলেন বিভাগের আরেক নমস্য শিক্ষক বেগম আকতার কামাল। তিনি পড়াতেন রবীন্দ্র-কবিতা। পড়াতেন না যেন বুড়োর প্রেমে টগবগ করে নাচতেন, আমরাও আপ্লুত হতাম আপার সঙ্গে সঙ্গে। আর শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস, বই পড়ার আগ্রহের জন্য আমি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমকে স্মরণ করি। এই ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার পর শুধু আমার না, বাংলা বিভাগের এবং অনেক বিভাগের ছেলেমেয়েকে বইমুখী করতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। রান্নাঘরে অধিক সময় না দিয়ে বই-পুস্তক আর লেখালিখির দিকে মনোযোগ দেবার জন্য তিনি সবসময়ই উৎসাহ জুগিয়ে যান। কিন্তু বাস্তবতার খপ্পরে পড়ে আমি এই সুযোগও ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারি না। এই আফসোস মরলেও যাবে না।

আর একজনের জন্য আমি লালনকে ভালোবাসতে শিখি। তিনি হলেন, আনুশেহ আনাদিল। এইচএসসির সময় আনুশেহর গানের সঙ্গে সখ্য হয়েছিলো। এর আগেও লালন শুনেছি বাসায় মায়ের বদৌলতে, কিন্তু মন টানেনি। আনুশেহ আমাকে লালনের জগতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি।

হুমায়ূন আহমেদের সূত্র ধরে বইয়ের জগত, শ্রীকান্তের সূত্রে পুরো রবীন্দ্রনাথ ও পুরনো আধুনিক বাংলা গান ও সংস্কৃতির জগত, শাকিরার সূত্র ধরে ইংরেজি ভাষা আর সভ্যতার জগত, আনুশেহর সূত্র ধরে লালন এবং মাটির গানের জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এঁরা চারজনই আমার অনুভূতিশীল জগতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আর এসবকে আমার মধ্যে একসঙ্গে বাড়তে দিয়েছেন প্রথমে আমার মা এবং পরে আমার স্বামী। এঁরা দুজনই আমার শিল্পিত জগতের অবতার। কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা জানাই এই দুজনের প্রতি।

১৯৯৭ সালে আম্মুদের 'সরগম শিল্পীগোষ্ঠী' বেশ জোশের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন আম্মু। সংগঠক হিসেবে ছিলেন অলিয়ার কাকু, অশোক কাকু, মঞ্জু কাকু, মিনু ম্যাডাম, নিরাপদ কাকু, অসিত কাকু, রূপকুমার স্যার। এলাকায় অনেক অনুষ্ঠান হতো তখন। বিটিভিতেও কয়েকটা প্রোগ্রাম হয়েছে। আম্মুর লেখা ও সুর-করা গান এই সংগঠনের মাধ্যমে প্রচারিত হতো। আম্মুর লেখা জারি গান, বিয়ের গান, দেশাত্মবোধক গান, স্বাগত সংগীত, শিক্ষা সংগীত, স্কাউট সংগীত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হতো। আমাদের সঙ্গে পারফর্মার হিসেবে ছিল নিরাপদ কাকুর মেয়ে মুনমুন কর্মকার, পাঠক স্যারের ছেলে মৃত্যুঞ্জয় পাঠকদা, অলিয়ার কাকুর মেয়ে দীপা, সীমা আপু, বিন্নী, ঝর্ণা ফুফু, শাবানা ফুফু, নীতি, লীমা, সুমা, নীতু, রোমিও সূত্রধর, স্বাক্ষর, দ্যুতিসহ আরও অনেকে।  

আমার জন্মের আগেও মা লিখতেন। মায়ের স্কুলের প্রধান শিক্ষক গাজী খোরশেদুজ্জামান ছিলেন মায়ের সৃষ্টিশীল জগতের অনুপ্রেরণাদানকারী। এই ভদ্রলোক ছিলেন একাধারে কবি, গুণীজনদের পিতা এবং স্বনামধন্য শিক্ষক। ফলে বোয়ালমারীতে শিল্প-সাহিত্যের একটা সূতিকাগার হিসেবে আমার মা, তাঁর শিক্ষক গাজী খোরশেদুজ্জামান স্যার, জর্জ একাডেমির শিবু স্যার, বোয়ালমারীর একমাত্র ফটো স্টুডিও 'স্মৃতিঘর'-এর মিজানুর রহমান, গাজী শহীদুজ্জামান লিটন মামা, গাজী খোকন মামা, কাজী ফিরোজ মামা, জীবনকৃষ্ণ পাল কাকু, ঝন্টু কাকু, আমার নিজের ছোটকাকু(রফিকাকু), রূপকুমার স্যার, নিরাপদ কর্মকার কাকু, বিরেন কাকু, অসিত কাকুসহ আরও অনেকের ভূমিকা রয়েছে।

শিক্ষাসপ্তাহে যখন রবীন্দ্র সংগীতে টানা প্রথম হতাম, তখন আম্মু-আব্বুর শিক্ষক শিবু স্যার আম্মুকে বলেছিলেন 'সখিনা, তোমার মেয়েটা রবীন্দ্র সংগীত এতো ভালো গায়, ওকে সুযোগ দিও শেখার। ' 
বলা বাহুল্য, মা তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন আমাকে শিল্পী বানানোর। আমি সফলতার সঙ্গে ব্যর্থ হয়েছি। পরে আমার বরও অনেকবার বলেছেন, কিন্তু আমি কন্টিনিউ করতে পারিনি। এখন শখ হলে মাঝে মাঝে নিজে নিজে গাই। অবহেলায় সুরও যে অভিমানী হয়ে ওঠে, আমি নিজেই তার প্রমাণ।

স্কুল জীবনে আমি অনবরত শুনছি ইংরেজি, হিন্দি গান আর গাইছি রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল, দেশাত্মবোধক আর আঞ্চলিক গান। ব্যাপারটা অদ্ভুত না? কিন্তু যখন হারমোনিয়াম নিয়ে স্বরের সঙ্গে সুর মেলাতাম তখন মনে হতো পৃথিবীর সব গানই স্বর্গীয়। সুরসাধনাও এক ধরনের প্রার্থনা । হাজিরা-দেয়া নামাজ পড়ে যেমন কোনো ফায়দা হয় না, তেমনি গান শুধু গেয়ে উঠলেই হয় না। স্বরে সুর মেলানো সারা জীবনের একটি সাধনা। মহান রবের সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ ঘটানোর মতো।

সুরের সঙ্গে আমার গভীর একটা যোগাযোগ আছে। আমি সবধরনের গান শুনি। ধর্ম, ভাষা এবং সুরের ব্যাপারে আমি একদম নির্মমভাবে নিরপেক্ষ। হয়তো নিরপেক্ষতার একটা পক্ষে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এখানে আমি একা এবং একলব্য।
আমি হয়তো মানুষ হিসেবে অতোটা ভালোও নই, কিন্তু শ্রোতা হিসেবে বিশুদ্ধ।

খারাপ মানুষদেরও তো পৃথিবীতে তাদের সাধারণ জীবন ও রুচি নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আছে! মানুষের তৈরি করা আইন-কানুন যখন তারা নিজেরাই আইন করে মানে না, তখন ঘটা করে আইনের বিয়ে দেয়ার দরকারটা কী? এই জীবিত পৃথিবীতে কে পুরোপুরি ভালো আর কে পুরোপুরি খারাপ? এবং কে না নিজের বিজ্ঞাপন করে করে পূর্ণপ্রতিযোগিতামূলক বাজারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে এখানে?

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি