উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আধিপত্য ধরে রাখছে ইরান

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আধিপত্য ধরে রাখছে ইরান

অনলাইন ডেস্ক

ইরানের বিরুদ্ধে বুধবার সকালে গুরুতর অভিযোগ এনেছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ‘বিধিবহির্ভূতভাবে’ বিমান হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে দুই শিশু নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ সামনে আনার পর প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ পাকিস্তানের ভূখণ্ডে কেন হামলা চালাল ইরান? মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি আগে থেকেই উত্তপ্ত।

এর মধ্য কী এমন ঘটল যে তেহরান প্রতিবেশী দেশের ওপর হামলা চালিয়ে বসল?

কয়েক দিন ধরে ইরাক ও সিরিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে ইরান। তেহরানের দাবি, ‘ইরানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর’ বিরুদ্ধে এসব হামলা চালানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরাক ও সিরিয়ার পর একই কারণে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ইরানের এই হামলা চালাল।

যদিও ‘বিনা উসকানিতে আকাশসীমা লঙ্ঘনের’ ঘটনায় ক্ষোভ জানাতে ইসলামাবাদে নিযুক্ত ইরানের শীর্ষ কূটনীতিককে তলব করেছে পাকিস্তান সরকার।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের এসব কর্মকাণ্ডের পেছনের কারণ জানতে হলে বুঝতে হবে ইরানের বিগত বছরের রাজনৈতিক কলাকৗশল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে ওপেন কানাডায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিষয়টি উঠে আসে।

কী করছে ইরান?
গেল বছরের শুরুতে সৌদি আরব-ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চুক্তির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করে তেহরান। এটি আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ ছিল। যেখানে বিবাদমান সরকারগুলো বছরের পর বছর নিজেদের মধ্যকার তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সাংঘর্ষিক সম্পর্ক দূরে সরিয়ে দিয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ইরান এবং এর সহযোগীরা এই নতুন অবস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুফে নিচ্ছে।  

প্রকৃতপক্ষে, অনেক আরব সরকার এখন ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করতে চাইছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তেহরানের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, আরব সরকারগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করে নিতে অর্থপূর্ণ কোনো ছাড়ই দেয়নি তেহরান। কিন্তু তবুও যুদ্ধপ্রবণ এই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে তেহরানের সাথেই সম্পর্ক উন্নয়নের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে।  

সামরিক শক্তি
গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার বা জিএফপির র‌্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বে সামরিক শক্তির তালিকায় ইরানের অবস্থান বর্তমানে ১৪-তে।  প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিতে পারে সেরকম জনসংখ্যা আছে ইরানের ৪ কোটি। ইরানের সেনাবাহিনীর অ্যাক্টিভ মেম্বার রয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার। ইরানের আছে ৩ লাখ ৫০ হাজার রিজার্ভ সেনার বিশাল বহর।  

এয়ার পাওয়ারেও ইরানের ফাইটার এয়ারক্রাফট আছে ১৯৬টি অন্যদিকে হেলিকপ্টার রয়েছে ১২৬টি। ইরানের হাতে আছে ৪ হাজার ৭১টি ট্যাংক।  মোবাইল রকেট প্রজেক্টর আছে ইরানের ১ হাজার । নৌ-শক্তিতেও এগিয়ে ইরান। তেহরানের কাছে রয়েছে ১৯ থেকে ২৪টি সাবমেরিন। ইরানের আছে ৫টি ফ্রিগেটও। আর তেহরানের ১টি মাইন ওয়ারফেয়ারও আছে।  

ছবি: নিউ ইয়র্ক টাইমস

নিজস্ব দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে ইরান। সেই সঙ্গে ইরাক, সিরিয়া, লেবানন এবং ইয়েমেনে তার প্রক্সি বাহিনীর নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই অঞ্চলে তার প্রভাব বলয়কে আরও গভীরতর করে যাচ্ছে। এসব সহযোগী ও মদদপুষ্ট গোষ্ঠীগুলো হরহামেশাই এই দেশগুলোকে অস্থিতিশীল রাখতে নেপথ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে বিষয়ক পশ্চিমা বিভিন্ন বিশ্লেষক জেনারেল কাশেম সোলাইমানির মৃত্যুর পর বলছিলেন, সোলাইমানি যুগের পরে ইরান আর সেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অনন্য দেশে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা তাদের বিশ্লেষন ভুল প্রমাণ করছে।  

জেনারেল কাশেম সোলাইমানি

পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন হচ্ছে?
পরিস্থিতি যাই হোক, সৌদি আরবসহ বাহরাইন, জর্ডান এবং মিশর এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বলয় স্বল্পমাত্রায় মেনে নিয়েছে। গত বছর (২০২৩ সালে) ইরান কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক সফলতা অর্জন করে। এদের একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল বন্দী বিনিময়  এবং অন্যটি ইউক্রেন যুদ্ধের আড়ালে রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা গভীর করেছে ইরান।

সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানানো ব্রিকস জোটের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পায় ইরান। এসব বিবেচনায় ২০২৩ সালকে ধরা হচ্ছে বৈশ্বিক পর্যায়ে তেহরানের কূটনৈতিক সফলতার বছর। তেহরানের এসব অর্জনগুলোকে বৈদেশিক নীতির সাফল্য হিসেবে ধরা হলেও এসব অর্জনই তার প্রতিবেশী এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতাকে পরোক্ষভাবে উসকে দিচ্ছে।  

ইরানের ভবিষ্যত পদক্ষেপ কী হতে পারে সেগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করতে চাইলে প্রথমতই জানা থাকা উচিত দেশটির বৈদেশিক বা কূটনীতির ভিত যেসব মূল নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৭৯ সাল থেকে ইরানের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে দেশের ভেতর এবং বাইরে থেকে সব ধরনের হুমকির বিরুদ্ধে শাসনগোষ্ঠীকে সুদৃঢ়ভাবে অবস্থান টিকিয়ে রাখতে হবে।  

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

বছরের পর বছর ধরে, তেহরানের শাসকদল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে এবং হচ্ছে। সেখানে তারা মুখোমুখি সংঘাত এড়িয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তা ভিন্ন কৌশলে মোকাবিলা করে।

ইরানের এই কূটকৌশলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি করা যা ইরানের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে থাকে। এই ভারসাম্য তত্ত্বকে কূটনীতির ভাষায় বলা হয় ব্যালেন্স অফ পাওয়ার। এই ব্যবস্থায় সরাসরি যুদ্ধে না জড়িয়ে প্রতিপক্ষকে এমন স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয় যে তার মূলভূখণ্ড আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণ হবে সর্বাত্মক যুদ্ধ যেখানে ব্যবহার হবে পারমাণবিক বোমা।  তেহরানের কূটকৌশলের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারটি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে উত্সাহিত করা এবং স্থানীয় সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে লালন করা যারা সংকটকালে ইরানের স্বার্থে লড়বে।  

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংয়ের উপস্থিতিতে চুক্তি সই করছেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ ও
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান।

এইভাবে, ইরানের শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রভাব বিস্তার করতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পরিচিতি স্পষ্ট করতে ২০০৩ সালে আরব-ইসরায়েল সংঘর্ষ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের মতো ঘটনাগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়।   ২০১১ সাল পর্যন্ত ইরান একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার ধাপগুলো একে একে মাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এসময় শুধুমাত্র আরব বসন্ত তাদের সেই ধারাবাহিক আধিপত্যে খানিকটা আঘাত হানে।  

news24bd.tv/aa