আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা

অলংকরণ:কামরুল

আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা

কিস্তি-৭

অনলাইন ডেস্ক

আব্বু যে কন্যাশিশুর জন্মে খুশি হননি, এটা আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে কখনো টের পাইনি। বাবাদের কাছে মেয়েদের আদর থাকার ব্যাপারটা চিরন্তন। কালচারালিই বলি আর ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে মাথায় রেখেই বলি, অধিকাংশ মেয়ের জীবনে বাবারা হচ্ছেন তাদের মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তির একমাত্র স্রষ্টা। নারীরা সারাজীবন জন্মদাগের মতো বাবার আদরের স্মৃতি বয়ে নিয়ে তাদের বৈবাহিক জীবনের অর্ধেক ঝগড়ার উৎস হিসেবে যত্ন করে রেখে দেয়।

আমার পরিচিত বেশিরভাগ নারীর কাছে তাদের বাবার আদরের অতুলনীয় স্মৃতিচারণ আমি বাদামের নেশার মতো করে চিবিয়ে জেনেছি।

আরও পড়ুন :আমার বিজ্ঞাপন

আমার বাবা আমাকেও আদর করেছেন। আব্বুর আদর ছিলো আমার কাছে একেবারে দানা-পড়া খেজুরের ঝোলাগুড়ের মতো, চিনির বিস্বাদমুক্ত। আবার প্রয়োজনে কঠিন শাসনও করেছেন।

আমি অবশ্য বরাবরই প্রতিবাদী। আব্বু তেড়ে এলে আমিও ক্ষিপ্ত মহিষের মতো উলটো তেড়ে যেতাম এবং আদর আদায় করে ছাড়তাম। মা বলেন, আব্বুর হাতের মাইর ভাইয়া যে পরিমাণ খেয়েছে আমি তার চার ভাগের আধা ভাগ খেয়েছি। বাবা-মা শাসন করবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোর মধ্যে বসবাস করে মেয়েকে অনেক দূর পর্যন্ত প্রশ্রয় দেয়ার ঘটনা আমাদের সমাজে একটু ব্যতিক্রমই।

প্রশ্রয় বলতে মেয়ের জন্য ছোট ছোট জিলাপি-পুরি কিনে দেয়া, সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাওয়ার (‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটি আব্বু আমাকে হলে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন) মতো আবদার থেকে জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার যে বিয়ে, সেই আবদার পর্যন্ত তিনি মন শক্ত করে পূরণ করেছিলেন।
 

আমার পছন্দের বিয়েতে তিনি একবাক্যে মত দিয়েছিলেন এ জন্য না যে তাঁর জামাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এজন্য যে তাঁর জামাই তাঁর মতোই প্রচণ্ড স্ট্রাগল করা এবং তাঁর মেয়ের নিজ দায়িত্বে পছন্দ করা। মেয়ের মনকে তিনি যাচাই করে প্রশ্রয় দিয়েছেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও তখনো তিনি আজকের মতো মোহাম্মদ আজম হয়ে ওঠেননি। তখন তাঁকে মেধাবী ছাত্র হিসেবেই চিনতো সবাই। এখন চেনে মেধাবী শিক্ষক হিসেবে। আর ছাত্র কেমন সেটা স্বচক্ষে না দেখলেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, কেননা তিনি নিজেও তো জাত-শিক্ষকই ছিলেন। জাত-শিক্ষকরা ভালো ছাত্র দেখলেই চেনেন।

আব্বুর কাছে ছেলের পরিবার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, ছিলো তাঁর কঠিন জীবন-সংগ্রাম। কেননা, আব্বুও প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে পড়াশোনা করে উঠে এসেছেন। আব্বু বলতেন, তাঁর বাবা-মা তাঁকে গরু রাখার জন্য নানা রঙের সবুজ সবুজ ক্ষেতের আইল ধরে মাঠে পাঠাতেন, আর আব্বু গরুকে মাঠে বেঁধে দিয়ে গাছের নিচে বসে বসে আপন মনে অংক করতেন। একদিক থেকে গরু চরানোর ক্ষেত্রে আব্বু একটু ফাঁকিবাজিই করতেন। দাদার হাতে এই জন্য মাইরও খেয়েছেন। এটাও ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক। পুরোদস্তুর কৃষিনির্ভর পরিবার হিসেবে দাদু-দাদির কাছে পড়াশোনার ব্যাপারটা এতো গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা না। শুধু শুধু সময় নষ্ট আর তামাশা মনে হতো তখন। তাই দাদা-দাদি আব্বুকে  খেত-খামারি করার জন্যই বেশি চাপাচাপি করতেন। কৃষকের ছেলে কৃষিকাজ শিখবে, করিৎকর্মা কৃষক হবে। সংসারের হাল ধরবে। তা না করে কী সব 'ন্যাদাপদা' শেখে, 'সাহেব' হতে চায়!

আরও পড়ুন:‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

পরে অবশ্য আব্বু তাঁর এক চাচা আর এক মামার সহযোগিতায় (অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক) পড়াশোনা করেছেন। আব্বুর একজন কৃষকের ছেলে থেকে শিক্ষিত হয়ে ওঠার গল্প এই বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে অধিকাংশেরই গল্প। ধীরে ধীরে যখন আব্বু এই পড়াশোনা দিয়ে নিজের ভাগ্যের চাকা উলটো দিকে ফেরাতে শুরু করেছেন, তখন দাদু-দাদি আব্বুর ওপর আস্থা রাখা শুরু করেছিলেন। কৃষকের ছেলে সত্যি সত্যিই একদিন গ্রামের মধ্যে 'সাহেব' হয়ে ওঠেন। আব্বুর গ্রামের নাম চতুল। নামটা সুন্দর না? এটা একটা অসাধারণ গ্রাম। এই গ্রামে একটা ফসলি মাঠ আছে, যার নাম 'চক'। গ্রামের লোকেরা সেই চকে কেউ গেছে কিনা এই কথাটি লোকাল ভাষায় জিজ্ঞেস করতো এভাবে, 'অমুক চহে গেছে নাহিরে?' ছোটবেলায় এই চকে ঘুরতে যেতাম আমরা দলবল মিলে। চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোন হাসবু, খোসবু, পিজু, সীমা, সজল, রোকসানা, বন্যা, সোনিয়ারা বিভিন্ন সময়ে চকে এবং চকে যাবার রাস্তায় বসে বসে খেলতাম, আড্ডা দিতাম।

আমার দেখে চতুল গ্রামটি ছিলো স্বপ্নের মতো। মেরুন রঙের রেল লাইনের দুই পাশে বড়ো বড়ো সবুজ  ঘাস। ঘাসের পাশ দিয়ে গ্রামের ভেতরে চলে যাওয়া মেটে রাস্তা আর তার দুই পাশে কখনো কখনো ছনের কুড়েঘর আর এক-দুইটা টিনের ঘর। তাও বেশ ফাঁকা ফাঁকা। সেই মেটে রাস্তার দুইপাশে পাল্লা দিয়ে খেজুর গাছ আর তাল গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো। ফাঁকে ফাঁকে আম, রেইনট্রি, কাঁঠাল গাছগুলো তাল আর খেজুর গাছের ঊর্ধ্বগামী উন্নাসিক প্রতিযোগিতা উপভোগ করতো। আর রোদের কাছে তাদের নানা বর্ণের পাতার চুল মেলে ধরতে ধরতে হাসতো। শীতকালে খেজুর গাছগুলো তালগাছগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তাদের প্রত্যেকের গলায় রসের হাড়ি পরে বসে থাকতো। ঠিক একই কাজ করতো তালগাছগুলো গরমে। ভাগ্যের এমন পালাবদল শুধু মানুষের না, গাছেদের বেলাতেও ঘটে। আবার ধান বা গমের সবুজ সবুজ ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখতাম সেজোচাচিসহ অনেক চাচি-ফুফু মিলে চকের মাঠ থেকে 'ভাইতে’ (ভইত্যা/বথুয়া) শাক, কাঁটানটি শাক, সেঁচি শাক, হেলেঞ্চা শাক, ঘৃতকাঞ্চনসহ অনেক অনাবাদি অতি সুস্বাদু সব শাক বাঁশের চালনে করে সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। আর সেই শাক বেশি করে রসুন আর পেঁয়াজ দিয়ে যখন ফোঁড়ন দিতেন তখন মনে হতো যেন এক্ষুনি খেতে বসে যাই। যেহেতু তখন রান্নার চুলা থাকতো উঠোনের এক কোণে, সেহেতু সেই ফোঁড়ন দেয়া শাকের ঘ্রাণ উদোম উঠোন পেরিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়েও ঢু মারতো। আহা, কী সব দিন!

আরও পড়ুন:প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

আমার সেজো চাচির হাতের রান্না ছিলো অমৃত। শীতে চাচি চিতোই পিঠা বানাতেন। সঙ্গে গরুর মাংস। চাচির হাতের গরুর মাংসের একটা গ্রাম্য র টেস্ট ছিলো। যেটা আমি আর কারো গরুর মাংসে পাইনি। গরু অনেকেই ভালো রাঁধেন। আমার নানি, মা, খালারা, ফুফু, ভাবি এমনকি আমি নিজেও। কিন্তু সেজো চাচির হাতের ওই গরুর মাংসের স্বাদ একেবারেই র, অনবদ্য এবং সুস্বাদু।  
চতুল গ্রামে আমি ছোটবেলায় আব্বুর সঙ্গে তাঁর সাইকেলের সামনে চড়ে চড়ে যেতাম। কোনো এক সন্ধ্যায় চতুল গ্রামের রেললাইনের পাশে দিয়ে একটি সাইকেলের প্যাডেলে মোটা দুটো পা আর সামনে চিকন চিকন দুটো পা ঝুলতে ঝুলতে সেজো চাচির ওই অদ্ভুত রান্না খেতে চলে যেতো। রাতে ফেরার সময় চাঁদ আর জোনাকি দলের সঙ্গে পাল্লা লেগে যেতো – কার আলোতে আমাদের বাসায় পৌঁছে দেয়া যায় তাই নিয়ে। এই সুন্দর গ্রামে শুধু চক না, দাদুরের (প্রমিত নাম দাদুরিয়া) বিলও ছিলো। সেখানে বহু জাতের মাছ তাদের রঙঢঙসমেত ধরা পড়তো। পুঁটি, কৈ, বাইম, গুইতে বাইম, শিং, আরও কী কী সব দেশি মাছ ছিল খুবই বিখ্যাত।

এরকম অদ্ভুত সুন্দর একটি গ্রামে আব্বু বড়ো হয়েছেন প্রকৃতি আর পড়াশোনাকে পাশাপাশি রেখে।

প্রথমে টিউশনি করে করে পরে স্কুল-কলেজে চাকরি নিয়ে আব্বু নিজে পড়েছেন, নিজের পরিবারের ভাই-বোনগুলোকেও পড়িয়েছেন; এমনকি নিজের স্ত্রীকেও সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছেন পড়াশোনার ব্যাপারে। অনেক চেষ্টা করার পরেও আব্বুর যেই ভাইটা পড়াশোনা করেনি, তার সচ্ছলতার জন্য আব্বু সারাজীবন এফোর্ট দিয়েছেন। তার দুই সন্তানকে পড়াশোনা করানোর চেষ্টা করেছেন। সে ব্যাপারে ব্যর্থ মনোরথে চড়তে হয়েছিলো আব্বুকে। ছেলে দুটোই আমার ওই চাচার মতো পড়াশোনা শেষ করেনি। তাদের স্ট্যাবলিশমেন্টের জন্যও আব্বু কম চেষ্টা করেননি। নিজের পরিবারের কার কিসে ভালো হবে সারাজীবন তাই ভেবেছেন। এটা অবশ্য আমাদের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। যাদের ভালো করতে চেয়েছেন, তাদের আকাঙ্ক্ষার দিকে তাকালে আমার এই কথা হয়তো কচুপাতার পানির মতো গড়িয়ে পড়বে। নাও পড়তে পারে।

আব্বুকে দেখেছি শুধু নিজের নয়, অন্যের জন্যও ভালো করার চেষ্টা করেছেন। সবসময় যে তাতে ভালো হয়েছে তা বলা যাবে না।

আরও পড়ুন:ভাইয়ার 'মনাভাই'

বলে রাখি, পড়াশোনা বলতে একটি কৃষক পরিবারের সন্তান অ্যাকাডেমিক পড়াশোনাকেই যে আগে বুঝবে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। শুধু কৃষক পরিবার কেন, এটা এখন সব পরিবারেরই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে যাবার কথা। ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে হবে আগে, তারপরে তো বুদ্ধিবৃত্তি! বাংলাদেশে আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েরা অনার্সের শুরু থেকেই যে বিসিএসের জন্য হন্যে হয়ে পড়ে এর একটা বড়ো কারণ, তাদের বুদ্ধির চর্চা চালিয়ে নেয়ার জন্য রাষ্ট্র তাদের পেট চালানোর ন্যূনতম দায়িত্ব নেয় না। সে কী করবে আর বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়া ছাড়া? ফলে পেটকে সামনে রেখে মাথাকে পরে যতোটুকু এগিয়ে নেয়া যায়, তাই করে এদেশের তরুণ প্রজন্ম। আর এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

আব্বুর  দারিদ্রমুখর জীবন, ভাই-বোনদের স্ট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে মোহাম্মদ আজমের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। ফলে, মেয়ের পছন্দের সাথে সাথে এটাও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। আব্বু যতো সহজে মত দিয়েছিলেন ততো সহজে মা মত দেননি। কবি মানুষ তো, বিবেচনা বেশি। তবে, বিয়েতে আব্বুর সহজে মত-দানের ব্যাপারটাকে মোহাম্মদ আজমের কিছু সহকর্মী ভালোভাবে নেননি, পরিবার তো নয়ই। একজন সহকর্মী তো আমাকে সরাসরি খোঁটা দিয়ে বলেছিলেন 'কী, জামাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনেই তোমার বাবা রাজি হয়ে গেলেন?'

এ ধরনের খোঁটা শোনার মতো কোনো মানুষ আমার বাবা ছিলেন না। কিন্তু এ ধরনের খোঁটা দেবার মতো মানুষ যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়ও শিক্ষকতা করতে পারেন বা করেন, সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিলো আমার। রবীন্দ্রনাথের 'হৈমন্তী', 'অপরিচিতা' পড়া এবং পড়ানো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের এটা না বোঝার কী ছিলো বুঝতে পারিনি সেদিন। এখন কিছুটা বুঝি।  

আসলে বিনয় আর সহজলভ্যতাকে মানুষ বরাবরই ভুল বুঝে থাকে। এই জন্য দেখেন না আজকাল নিত্যপণ্যের দাম বিনা কারণে বেড়ে থাকে? সামান্য পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা! খুব সামান্য হয়েও শুধু কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করতে পারলেই দাম বাড়ানো সম্ভব। এটা পেঁয়াজের মতো অনেক মানুষও বোঝে।

আব্বু যদি তখন আম্মুর মতো বেঁকে বসতেন, তাহলে নিশ্চয়ই মোহাম্মদ আজমের ওই সহকর্মীর মতো মানুষের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারতেন।

কিন্তু শুধু শুধু অপ্রয়োজনে দাম বাড়িয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় হয়তো আমার আব্বুর হাতে ছিলো না। তাই সবকিছু তাড়াহুড়া করে শেষ করে তিনি ওপারে পাড়ি জমালেন।

আমার বাবা একজন কলেজ শিক্ষক ছিলেন। অংক পড়াতেন ছেলে-মেয়েদের।
শিক্ষক হিসেবে যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন, তা আমরা দুই ভাইবোন হাড়ে-মজ্জায় টের পেয়েছি। আব্বুর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে একবারে কোথাও হেঁটে যাওয়া যেত না। শুধু সালাম আর নানা কিসিমের আলাপ জুড়ে দিতো লোকজন। আব্বুর বিখ্যাত ছাত্র-ছাত্রী সারা বাংলাদেশেই ছিলো। একবার জ্বরের কারণে আব্বুকে বারডেমে ভর্তি করানো হলো। বারডেমে তাঁর ছাত্রী ডা. শাহিদাকে দেখলাম তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করছেন।
ডা. শাহিদা ছিলেন একজন শিশু বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন সময়ে আমি তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি। দেখেছি, আব্বুর প্রতি তাঁর জেনুইন ভক্তি-শ্রদ্ধা। শুধু ভালো-পড়ানো শিক্ষক নন, শিক্ষকতাকে ওন করতেন আব্বু। বাসায় অংক পড়াতেন ছাত্র-ছাত্রীদের। আর আমার কাজ ছিল সবার কাছ থেকে কলম নেয়া। কলম সংগ্রহ করা ছিল আমার অবসেশনাল শখের মতো। স্থান-কাল-পাত্র না দেখেই সবার কলম চেয়ে নিয়ে সংগ্রহ করতাম। আমি তখন খুবই ছোট, স্কুলে যাই না, এই সময়ে আব্বুর কলেজের বা বাসায় আসা ছাত্র-ছাত্রীদের পকেট ও হাত থেকে এবং আম্মুর স্কুলের ছাত্রীদের হাত থেকে কলম গুছিয়ে নিয়ে নিতাম। ছেলেমেয়েগুলো কিছু বলতেও পারতো না, তাদের প্রিয় স্যার আর আপার মেয়ে বলে!

আরও পড়ুন:‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

একবার আম্মু ক্লাসে কী যেন লিখতে দিয়েছেন, কিছুক্ষণ অতিবাহিত হবার পরে দেখেন কেউ কিছু লিখছে না। ঘটনা অনুসন্ধানে উঠে এলো, 'আপা, সেঁজুতি আমাদের সবার কলম নিয়ে নিয়েছে। ' আম্মু পরে আমাকে বকা দিয়ে সবার কলম ফিরিয়ে দেন। এই কাজ আমি বাসায় কাজ করতে আসা রাজমিস্ত্রি চুন্নু ভাইয়ের সঙ্গেও করেছি। চুন্নু ভাই যখনই আসতেন লাল-সবুজ-হলুদ রঙের ইকোনো কলম নিয়ে আসতেন। আর আমার টার্গেট থাকতো স্বপ্নের ওই কলমের দিকে। চুন্নু ভাইকে বলতাম, 'মনা ভালো, মনা ভালো, কলমডা এট্টু নেই?'

এটা বলে চুন্নু ভাই আমাকে অনেকদিন ক্ষেপিয়েছেন। আসলে কোনো ব্যাপারে মানুষ যখন ফোকাসড থাকে তখন সাধারণ সামাজিক জীবনের কথা তার মাথায় থাকে না। এ জন্য অনেকের ক্ষেপাক্ষেপির পাল্লায় পড়তে হয়। চুন্নু ভাইরা ক্ষেপালেও আব্বু-আম্মুর ছাত্র-ছাত্রীরা কখনোই ক্ষেপায়নি আমাকে। তার কারণ তাঁরা দুইজনেই ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সিনসিয়ার।

আমি আব্বুকে দুটো জিনিস খুব মনোযোগ আর চ্যালেঞ্জের সঙ্গে করতে দেখতাম।
এক. গরিব ও অমনোযোগী ছেলেপেলেদের মোটিভেটশন দিয়ে বিনা বেতনে পড়িয়ে তাদেরকে সেটেল করানো। দুই. এলাকার রবিবারের হাট থেকে শুকনা ও খুব দুর্বল গরু কিনে তাদেরকে নিজ হাতে ব্যাপক যত্ন-আত্তি করে স্বাস্থ্যবান করে তোলা।

আমার বাবার ছিলো গরুর প্রতি ব্যাপক মহব্বত। হতেই হবে। গরু ছিলো আব্বুর আশৈশব সঙ্গী। আমাদের টিনের ঘর থাকতে ভাইয়া যেই রুমে থাকতো সেটার ফ্লোর ছিলো মাটির। কিন্তু গোয়াল ঘরের ফ্লোর ছিল পাকা। একদিন আমার ভাইয়া খুব আফসোস করে বলেছিল, 'শালার, আমার আব্বার পালে ছেলেটা না হয়ে একটা গরুও যদি হতাম, তালি পাকা ঘরে থাকতি পারতাম। '

ভাইয়া আসফোস করুক আর যাই করুক, বাস্তবতা ভিন্ন। গরুর ঘরের ফ্লোর পাকা হওয়ার সঙ্গে নিজেদের পাকা ঘরের অনেক পার্থক্য আছে। অর্থনৈতিক অবস্থা এমন ছিলো না যে ফুটফাট করে রাতারাতি পাকা ঘর তৈরি হয়ে যাবে। পরে অবশ্য ভাইয়ার ফ্লোরও পাকা করা হয়েছিলো। কিন্তু ভাইয়ার ক্ষোভেরও পূর্বঘটিত কিছু কারণ ছিলো। অর্থাৎ ভাইয়া শুধু পাকা ফ্লোরের আফসোসের জন্যই কথাটা বলেনি। গরুর প্রতি আব্বুর আসলেই অস্বাভাবিক টান ছিলো, যেটা দুর্লভ।

আসলে মানুষ অনেক ঘটনার রিপিটেশনের পরে একটা তুচ্ছ বিষয়ে রিয়্যাক্ট করে ফেলে। কেননা, মানুষের ব্রেইন অভ্যাস পছন্দ করলেও, ঠিক যেই মুহূর্তে সে টের পায় এটা নিজের অস্তিত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং রিপিটেটিভলিই হচ্ছে, তখন হয়ত তার ব্রেইনের রিয়্যাকশন-সেল খুলে যায়।

আব্বুর গরু বিষয়ক কয়েকটা স্মৃতি এ জীবনে ভুলবার নয়। একবার পশু হাসপাতালের কম্পাউন্ডার লতিফ কাজী কাকু আম্মুকে এসে হাসতে হাসতে বলছিলেন, আব্বু নাকি নার্সারি আর প্রাইমারি স্কুলের পাশের যে জলাটা আছে (যেখানে আমি জীবনে প্রথমবারের মতো কচ্ছপ দেখেছিলাম) সেখানে যে-ই গরু ঝাঁপিয়ে (গোসল করিয়ে) উঠেছেন, অমনি গরু নাকি দৌড় লাগিয়েছে। আব্বুর একহাতে গরুর দড়ি, অন্যহাতে লুঙ্গির গিরা। লতিফ কাকুর ভাষ্য অনুযায়ী: 'ভাবি, ভাইজান লুঙ্গি ছাইড়ে দেয় তো গরুর দড়ি ছাড়ে না। '

পয়স্বিনী ছিল আব্বুর অস্তিত্বের অংশ। আক্ষরিক অর্থেই। আমাদের বাড়িতে গরুই ছিল সবসময়। ষাঁড় মাত্র একটা ছিল। গরু বিয়ানোর সময় আব্বুর যে উৎকণ্ঠা দেখেছি তা আমার নিজের জন্মের সময়ও দেখিনি (মানে শুনিনি)।

গরুর যত্নের জন্য বারোমাস লোক থাকতো। আমার ছোটবেলা থেকেই দেখেছি সেটা। হুমায়ূন চাচা, কুলসুম ফুফু, বাকা ভাই, আবু চাচা, আরব চাচা, কওসার চাচা, রাহেন চাচা, সর্বশেষ হাওয়ার মা। দীর্ঘ বছর ধরে একেকজন থেকেছেন। এরা প্রত্যেকেই গরুর যত্ন করেছেন আব্বুর সাথে সাথে।  

আমাদের খুব প্রিয় একটা লাল গরু ছিলো। যেটা প্রতি বছরই বকন বাছুরের জন্ম দিত। এটা অবিশ্বাস্য। প্রতিবেশীদের অনেকেই এটা মার্ক করেছিলো। কৃষি মেলায় বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের খামারের গরু প্রথম পুরস্কার জিততো। বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদ থেকে শিক্ষা সপ্তাহ আর কৃষিমেলায় আমি এবং আমাদের গরু কয়েকবছর ধরে প্রথম স্থানের সার্টিফিকেট পেয়েছিলাম। এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেকেই মজা করতো। তার মধ্যে বেশি মজা করতেন বোয়ালমারী সরকারি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর সুভাষচন্দ্র ঘোষ। তিনি আব্বুর সরাসরি শিক্ষকও ছিলেন রাজেন্দ্র কলেজে। সুভাষ স্যার ছিলেন একজন মজার মানুষ। গ্রামে কিছু মানুষ থাকে না যারা ছোট বাচ্চাদের ক্ষেপাতে পছন্দ করে এবং শিশুরাও চমৎকারভাবে ক্ষেপে যায়!
সুভাষ স্যার ছিলেন ক্ষেপানোর ওস্তাদ। এতো সুন্দর করে ক্ষেপাতে আমি এ জীবনে কাউকে দেখিনি। স্যারের বাড়ি বোয়ালমারীর বাইরে ছিল বিধায় আমাদের বাড়িতে থাকতেন। স্যার আব্বুকে খুবই স্নেহ করতেন। বলতেন 'আমি এতো ছাত্র পাইছি, শাহাদতের মতো এতো ভার্সেটাইল প্রতিভার অধিকারী ছাত্র আর পাইনি। একদিকে ক্ষেত-খামারি অন্যদিকে শিক্ষকতা। ' স্যারের এই পয়েন্টটা এর আগে কখনো খেয়াল করা হয়নি। কিন্তু সুভাষ স্যার আব্বুকেও ক্ষেপাতেন, আমাকেও ক্ষেপাতেন। আব্বুকে ক্ষেপাতেন এই বলে:  'শাহাদাৎ তোমার গরুর প্যাট ভরছে তো?' ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে আমাকে 'ও সেঁজুতি, ছানা খাবি না?' বলে বেশি ক্ষেপাতেন। এটা এক মজার ঘটনাই বটে।

আব্বুর যেই লক্ষ্মী গরুটি প্রতি বছর বাচ্চা দিত, সেই গরু বিয়ানোর মুহূর্তে মা থাকতেন বেশিরভাগ সময় তাঁর স্কুলে। আমি গরুর নতুন দুধের ছানা খুব পছন্দ করতাম। আব্বুর মতো ওই সময় অতি আবেগ আমার মধ্যেও কাজ করতো।
দৃশ্যটা একবার ভাবুন – গোয়াল ঘরে গরু বাচ্চা প্রসবের জন্য ছটফট করছে, আমি ঢাকাইয়াদের পুকুরপাড়ের (ক্লাস থ্রি/ফোরের কথা) খেজুরের সারির নিচ দিয়ে ছুটছি। খেজুর গাছগুলো আমার এই ছোটা দেখে হয়তো দাঁত কেলিয়ে হাসতো। ইদ্রিস খাঁর পাকা বাড়ির ভেতর দিয়ে পুরনো টেলিফোন এক্সচেঞ্জের লোকেদের বিরক্ত-বিরক্ত কণ্ঠের (আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার কাস্টমার কেয়ারের মতো সুললিত কণ্ঠ না)  'হ্যাঁলা হ্যাঁলা' শুনতে শুনতে পাশ দিয়ে বের হয়ে গো-হাঁটার গরুগুলোকে পার হয়ে চলে যেতাম আম্মুর স্কুলে। পোশাক কী পরা থাকতো খেয়াল থাকতো না। আম্মু কি ক্লাসে, না কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আছেন কিছুই দেখতাম না। মনের মধ্যে থাকতো শুধু সোনালি মেঘের মতো ছানা । অর্থাৎ গরু গোয়ালে বিয়োচ্ছে, আর আমি মাকে আনতে গেছি সেই গরুর নতুন দুধ দিয়ে ছানা বানিয়ে দেবার জন্য। খেজুর গাছের মতো সুভাষ স্যারও আমার এই হাস্যকর কর্মকাণ্ডের রাজসাক্ষী হয়ে ছিলেন বহুদিন।
আমাকে দেখামাত্রই ক্ষেপাতেন 'ও সেঁজুতি, ছানা খাবি না?'

আরও পড়ুন:‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

আব্বু শুধু গরুর খামার না, অনেক হাঁস-মুরগি পুষতেন বড়ো বড়ো খোপে করে। বাড়ির সাথেই ছিলো পুকুর, যেখানে একসময় বড়ো বড়ো চিংড়ির চাষ হতো।
সিলভার কার্প, কাতল, টাটকিনি, সরপুঁটি, রুই ইত্যাদি তো ছিলই। যেদিন জেলেরা মাছ ধরতে আসতো, সেদিন সকালের পড়া ফাঁকি দিয়ে বালতি নিয়ে আমি আর ভাইয়া জেলেদের লেজে লেজে ঘুরতাম। আমরা দুইজন অবশ্য বাড়ির সামনের মাঠে জলাবদ্ধ জায়গায়ও কারেন্ট জাল ফেলে মাছ ধরেছি। বর্ষার দিনে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া পুকুরগুলো থেকে মাছ ছড়িয়ে পড়ত। আব্বু আর ভাইয়াকে ঘুনি পাততেও দেখেছি। এসব জায়গায় প্রচুর তিতপুঁটি, মলা, চাপিলা, চিংড়ি পাওয়া যেত তখন। আম্মু আর কাজের বুয়ারা মিলে মাছ কুটতো। খুব ছোটবেলায় দাদিকেও দেখতাম কুটতে। আম্মুকে দেখেছি কারেন্ট জালে আটকে পড়া ঢোঁড়াসাপ অত্যন্ত কৌশলের সাথে ছাড়াতে। ঢোঁড়াসাপগুলো খুব অদ্ভুতভাবে আটকে থাকতো। মাথা থেকে একটু দূরে পেটের আগে জালগুলো আটকে যেত। সাদা সাদা কারেন্ট জাল হয়তো বেচারাদের চোখে পড়তো না। আহা, বেচারারা! আমার এখন প্রায়ই নিজেকে বিভিন্ন সময়ে কারেন্ট জালে আটকে পড়া ঢোঁড়াসাপের মতো লাগে। পরিস্থিতি টের পাই ধরা খাবার পরে। এটা মনে হয় সবার ক্ষেত্রেই সত্য।

আব্বু বাড়িতে প্রচুর গাছ লাগিয়েছিলেন। সবজি-শাকের আবাদ করতেন। শসা, ধুন্দল, পটল, লাউয়ের জাংলে, লালশাক, পালং শাক, ডাটা, ফুলকপি, বাঁধাকপি এসবও আবাদ করতেন আব্বু। একবার আমাদের পালে দুইজন নতুন অতিথি এলেন, বিশিষ্ট খরগোশ সাহেব-বিবিদ্বয়। এলাকায় এটা মোটামুটি একটা ঘটনা। তারা ঘুরে ঘুরে আব্বুর আবাদ করা বাঁধাকপি, মূলা, গাজর খেতেন। আর সাদা সাদা খরগোশদের পিছু পিছু আমি আর ভাইয়া ছুটে বেড়াতাম।

রীতিমতো ক্ষেত-খামারি ব্যাপার-স্যাপার।

আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন জমি থেকে আসা ধান সিদ্ধ হতেও দেখেছি আব্বুর বদৌলতে। তাফালের মধ্যে আগের দিনের ভিজিয়ে রাখা ধান সিদ্ধ হতো। ধানের ওপর পাটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। তখন বাড়ির পারমানেন্ট কাজের লোকের সঙ্গে যুক্ত হতো নতুন ভাড়া করা জোগালদার। সাথে সাথে আম্মুকেও দেখতাম ধান সিদ্ধ ঠিক মতো হয়েছে কিনা তা তদারকি করতে। পাটের বস্তার সঙ্গে সিদ্ধ হওয়া ধানের যে ঘ্রাণ তার তুলনা কেবল ঐশ্বরিয়ার নাচের সাথে করা সম্ভব। এতো সুন্দর ভাপ তোলা হলুদ হলুদ ধানের ঘ্রাণ পেয়ে নিজেকে আর দমন করতে পারতাম না। সিদ্ধ ফেটে যাওয়া ধান চিগিয়ে ভেতরের সিদ্ধ চাল খেতাম।

সৌন্দর্যের চরম উৎকর্ষ লাভের জন্য মানুষের এই জিহবার ব্যবহার একেবারে শুরু থেকেই ছিলো মনে হয়। যা ভালো লাগবে তাকে দখলে এনে ভোগ করতে হবে – এটাই মানবের চিরন্তন প্রবৃত্তি।

আমাদের জীবনকাণ্ডে প্রকৃতি ও জীবনের এমন বহুমাত্রিক ঘটনার চাষবাস সম্ভব হয়েছে কেবল আব্বুর জন্যই।

আব্বুর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক ছিলো, যার তুলনা আমি কারো সঙ্গেই করতে পারি না। টুকটাক ক্ষেত্রে আমার বরকে সেই আসন আমি দিয়ে থাকি। হতে পারে কোথাও কোথাও তিনি আমার বাবাকে ছাড়িয়ে গেছেন, কিন্তু কিছুতেই অধিকার করতে পারেননি। এটা আশা করাও তাঁর প্রতি আমার অন্যায় হবে।  

আমার আব্বু খেতে খুব পছন্দ করতেন, তাই আমাদের বাড়িতে খাদ্যের বৈচিত্র্য ছিলো। ফলের একটা ছড়া আছে: 'জাম, জামরুল, কদবেল/ আতা, কাঁঠাল, নারকেল/ তাল, তরমুজ, আমড়া/ কামরাঙ্গা, বেল, পেয়ারা/ পেঁপে, ডালিম, জলপাই/ বরই দিলাম আর কী চাই। ' এই ছড়ার শুধু জলপাই, তরমুজ, কদবেল আর তাল ছাড়া সবগুলো ফলের গাছই আব্বু আবাদ করতেন। সঙ্গে খেজুর আর কলাও ছিলো।  আব্বু অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তাই আমাদের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা হতো খুব বেশি। গরু পছন্দ করতেন তাই খামার দিয়েছিলেন। গরুর গোবর থেকে গ্যাসপ্ল্যান্টও সংযোজন করেছিলেন।  
দস্তয়েভস্কি নাকি তাঁর বাবার মৃত্যুর পরেও বাবাকে চিঠি লিখতেন, পোস্ট করতেন বাবার এড্রেসে। দুই হাজার আঠারো সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত একটা মুভি 'হামিদ'-এ নিখোঁজ বাবার সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশে আট বছরের বাচ্চা হামিদ আল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ঘটনাচক্রে একটা নাম্বার যোগাড় করে।

২০১২ সালের অক্টোবরের ২৬ তারিখে আমার আব্বুও দৈবাৎ পরলোকগমন করেন। দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার। পরদিন ছিলো কোরবানির ঈদ। আমি আমার আব্বুকে কোরবানি করেছি এই ঈদে। আমার আব্বুর জানাজায় ঈদের জামাতের সমস্ত মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এটা খুবই বিরল ঘটনা।  সেই দিনের পর থেকে আজ অবধি আমি অনেক চিঠি লিখেছি আব্বুর কাছে। কোনো কোনোটা আকাশের ঠিকানায়, কোনো কোনোটা ফেসবুকে, কোনো কোনোটা একাবারেই আমার মনের অতলে। আব্বু মারা যাবার পর কতোবার যে মনের ভুলে আব্বুর নাম্বারে ফোন দিয়ে আব্বুর শান্ত গলায় 'মারে, দেখনা মন সইয়ে, কী যায় হইয়ে'র মতো মোটিভেশনাল কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছে করেছে, তার হিসাব নাই।

আফসোস, আজ পর্যন্ত একটিবারের জন্যও কোনো রেসপন্স পাইনি কোনোদিন।
আব্বুর স্মৃতি মনে আসলেই শুধু চোখটা ব্লার হয়ে যায়। মাঝে মাঝে গোরস্থানে গোরস্থানে ঘুরে বেড়াই। একা একা। আব্বু কেমন আছেন তার ফিল নিতে চেষ্টা করি। পাইও মাঝে মাঝে। আব্বুর জন্য জায়নামাজ পাড়লে শুধু চোখের সামনে ভাসে: একজন স্থূল ভুড়িওয়ালা মানুষ তাঁর সুশৃংখল দাঁতগুলো দিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ির বাগান দিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছ, মাছ, গরু, হাঁস-মুরগি দেখে বেড়াচ্ছেন।

আমার আব্বুর রুহের ঠিকানাটা কি কারো জানা আছে?
দোয়াগুলো কি ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছে সেখানে?

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি