পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে আট চ্যালেঞ্জ

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ-ফাইল ছবি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে আট চ্যালেঞ্জ

নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সামনে ৮টি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই আটটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে সফল হবেন বলে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হাসান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ অনেকেই  বিভিন্ন সময়ে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্যে কি কি চ্যালেঞ্জের হতে পারে  বলেছেন। এসবের আলোকে মূলত আটটি চ্যালেঞ্জকে মনে হয়েছে অন্যতম।

রোহিঙ্গা সমস্যা
দেশে রয়েছে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য কথাবার্তাও হয়েছিল মিয়ানমারের সঙ্গে; কিন্তু তাদের ফেরত না নিয়ে আরও সাত লাখকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয় মিয়ানমার।

যে হারে রোহিঙ্গারা তাদের জনসংখ্যা বাড়াচ্ছে, তাতে অচিরেই বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ লাখে।

তাদের জন্য ৩৪টি আশ্রয় শিবির তৈরি করে দেওয়া হয়।

কিন্তু আশ্রয় শিবিরগুলো হয়ে গেছে মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা মাদকের গুদাম। হানাহানি চলছে শুরু থেকেই। প্রথম দিকে হানাহানি ব্যাপক ছিল না। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এটা বাড়ছে, প্রাণহানিও হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বই এসব হানাহানির কারণ। আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) ছয়টি সন্ত্রাসী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে।

বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ‘আরসাপ্রধান’ আতাউল্লাহর ভাই শাহ আলিকে উখিয়ার একটি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের এনআইডিসহ গ্রেফতার করা হয় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে।

চলতি বছরের শনিবার (১৯ জানুয়ারি ) সকালে ১৯তম ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন,রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে দ্বিগুণ প্রচেষ্টার আহ্বান জানান এবং শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে গঠনমূলক এবং শান্তিপূর্ণ সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক
নির্বাচনের আগে এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে জানিয়ে আসছে। একধরণের সম্পর্কের অবনতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে দুইদেশের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিতে পারে যে কোনো সময়। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা।  ড. হাছান মাহমুদ শপথ গ্রহণের পরই সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন দেশের নানা পারসেপশন, ন্যারেটিভ থাকে। কিন্তু দিন শেষে সবাই এক সঙ্গে কাজ করবো এটাই হচ্ছে মূল বিষয়। সবাই আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। তবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের কনসার্নগুলোকে আমরা মূল্য দেবো।

ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য
বর্তমান সরকারের পক্ষে দুটো দেশ রয়েছে। চীন ও ভারত। কিন্তু এই দুটো দেশই পরস্পরের শক্র। এই দুটো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য যতো বেশি বজায় রাখতে পারবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ততো দেশের লাভ হবে। কোনো পক্ষেরই বিরাগভাজন হওয়া যাবে না।  

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীনের পক্ষে বিশাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও ভোগ্যপণ্য—উভয় সামগ্রীর প্রধান উৎস চীন। বাংলাদেশের কিছু বড় প্রকল্পে বাণিজ্যিক সুদে ঋণ দিয়েছে চীন। চীনা অনেক কোম্পানি বড় প্রকল্পে ঠিকাদারিও পেয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে।

ইউরোপের সঙ্গে সমঝোতা
ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরদিন দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে রাষ্ট্রদূত টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে ইইউর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রদূত ইবিএর (অস্ত্র ছাড়া সবকিছু) আওতায় বাংলাদেশকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার এবং জিএসপি প্লাস সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

নির্বাচন নিয়ে ইইউর আগের অবস্থান বা উচ্চপদস্থ প্রতিনিধির বিবৃতির তুলনায় রাষ্ট্রদূতের কথোপকথন অনেকটাই নমনীয় এবং সরকারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে হয়। তবে যে দুটি সুবিধার কথা তিনি বলেছেন, তার মধ্যে ইবিএ–সুবিধা শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য। গ্র্যাজুয়েশনের পর আর এ সুবিধা পাওয়া যাবে না। জিএসপি প্লাস পাওয়ার শর্তের মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং সুশাসন।

মানবাধিকার ইস্যু
নির্বাচনের পরদিন যুক্তরাজ্যের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এই নির্বাচনে মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং যথাযথ প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রে পালিত হয়নি। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনেরও নিন্দা জানায় যুক্তরাজ্য।
পোশাকশিল্প নিয়েও তারা বৈষম্যমূলক আচরণ না করার আহ্বান জানিয়েছে। গুম , হত্যা এসবের ব্যাপারেও  সমালোচনা করেছে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশাল।  ফলে মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারের আন্তরিকতা তুলে ধরতে হবে।

প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
সাকে পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হাসান এ ব্যাপারে তার অভিমত জানান,যেকোনো বিচারেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশেরই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বারবার বলেছেন, এই সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে এবং তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রোল মডেল। পশ্চিমের দেশগুলো যখন ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছিল, ভারত তখন ছিল অনেকটাই নীরব।

বন্ধুত্ব যতই ঘনিষ্ঠ হোক, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যায়, বিশেষত দেশ দুটি যখন পরস্পরের প্রতিবেশী। বাংলাদেশের কাছে ভারতের যা চাওয়া ছিল, এর প্রায় সবটাই বাংলাদেশ দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। বিপরীতে বাংলাদেশের কিছু চাওয়া পূরণে ভারতের অনীহা বা দীর্ঘসূত্রতা পীড়াদায়ক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এখনো সীমান্তে বিএসএফের হাতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। আবার এর পক্ষে ভারতীয় নেতৃত্বের সাফাই গাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দোহাই দিয়ে ভারত তিস্তার পানির হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে।

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে; কিন্তু শিলিগুড়ি করিডর পেরিয়ে নেপালে যাওয়ার অনুমতি এখনো জোটেনি। বাণিজ্যে অশুল্ক বাধা তো আছেই। এসব বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার করেই যেতে হবে।

পোশাক রপ্তানি
ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সময়সীমা বৃদ্ধি আর জিএসপি প্লাস পেতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশের তরফে। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখা এ আয়ের সিংহভাগ লম্বা সময় ধরে আসছে ইউরোপের দেশগুলো থেকে।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। একই সময়ে ইইউ বাজারে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৮১ শতাংশ বেড়েছে। যার আর্থিক মূল্য ৩ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাতের রপ্তানি নিশ্চিত করাটাও চ্যালেঞ্জের। দেশের পোশাক খাতের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে নানা ধরনের চাপ আসছে বলে জানিয়েছেন পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান।  সংকট উত্তরণে এ খাতের সব অংশীদারদের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

বিদেশি বিনিয়োগ
২০২২ সালে দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে ৫৯ কোটি মার্কিন ডলার। শতকরা হিসাবে যা ২০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে দেশে এফডিআই এসেছে ৩৪৮ কোটি ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে যা ছিল ২৮৯ কোটি ডলার। তবে নতুন বিনিয়োগ বাড়লেও বিনিয়োগের স্টক কমেছে। সামগ্রিকভাবে বিশ্বে বিনিয়োগ কমেছে। আর একক দেশ হিসাবে বিনিয়োগে এগিয়ে রয়েছে চীন ও কম্বোডিয়া। এ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ায় বেড়েছে ২০ শতাংশ। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটির ওয়েব সাইটে বুধবার এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।

দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের খারাপ অবস্থা। এর মূল কারণ অবকাঠামোগত সমস্যা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অন্যতম। বর্তমান অবস্থায়, বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। কারণ বিদেশিরা অনেক কিছু দেখে বিনিয়োগ করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস (সহজে ব্যবসা করা সংক্রান্ত) রিপোর্ট। রিপোর্টে বাংলাদেশকে আরও ভালো করতে হবে।

news24bd.tv/ডিডি