মা

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৮

মা

অনলাইন ডেস্ক

পরাণপাড়া গ্রামের সবুজ সবুজ আর হলুদ হলুদ ফসল-ভরা মাঠটিকে জ্যামিতিক মানচিত্রের মতো লাগে। এর মাঝখান দিয়ে ধূলা-ওড়া মাটির রাস্তা ধরে ছোটো ছোটো দুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একটি কন্যাশিশু। তার পেছন পেছন আরেকটি পুত্রশিশু। দ্রুত হাঁটার জন্য সে মৃদু ধাক্কা দিচ্ছে বোনটিকে।

মাঝে মাঝে দ্রুত হাঁটার পাল্লাতে সে বোনকে হারিয়েও দিচ্ছে। দুই ভাই-বোনের নানাবিধ খুনসুটি ৩ মাইলের মেটে রাস্তার দূরত্বকে স্রিঙ্ক করে বেশ দ্রুতই স্কুলে পৌঁছে দেয় দুজনকে।

বিলাসী' গল্পের কথক ন্যাড়ার ক্রোশপথ হেঁটে স্কুলে যাবার ছোটবেলা আমার মা এবং বড়োমামাদের থাকলেও তাদের মতো ফেইলের ইতিহাস মায়েদের জীবনে ছিলো না।  তখনকার দিনে ছেলেদের এতো দূরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার রেওয়াজ ছিলো।

কিন্তু ১৯৬৪/৬৫ সালের দিকে একটি কন্যাশিশুর জন্য এটা চন্দ্রবিজয়ের সামিল। এখন তো আধা মাইলের দূরত্বও ছেলেরা হেঁটে যেতে চায় না। মেয়েদের ক্ষেত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। মায়েদের ওই সময়ে এখনকার মতো মেয়েদের এতো দূরের রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার মধ্যে সম্ভ্রমহানি বা মলেস্ট হবার কোনো সম্ভাবনা থাকতো না। স্কুল ইউনিফর্মে ছিলো ফ্রক এবং থ্রিপিস আর মাথায় কাপড় দেয়া ছিলো মাস্ট।

এখন ছেলেমেয়েদের অনেক বড়ো বয়সেও একা ছেড়ে দিতে আস্থা পায় না বাবা-মায়েরা।

আরও পড়ুন: আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা

কী সেই কারণ? কেন এখন এতো বিচিত্র অবিশ্বাস আকাশের মাটিতে ঘুঘুর মতো ঘুরঘুর করতে থাকে? এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ আর সমাধানের জন্য তো যুগে যুগে ভুরিভুরি অক্ষর একত্র করা হয়েছে। ফায়দা কতোটুকু মিলেছে? 

পাড়ার মধ্যে ছেলে এবং মেয়েরা একসঙ্গে খেলার সেইসব দিন কীভাবে যেন খুন হয়ে গেছে। এখন তো শিশুশ্রেণি থেকেই বাচ্চারা জেনে যায় কারা মেয়ে আর কারা ছেলে। ফলে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে এবং মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সাধারণ মেলামেশাও করে না। করলেই খারাপ হয়ে যাবে। ফলে পারস্পরিক ভাব বা কথা বিনিময় হবে না। একসঙ্গে ছেলে এবং মেয়ের উপস্থিতি মানেই লক্ষ লক্ষ বছরের পুরাতন প্রবৃত্তির বিকাশ। এর বাইরে কোথাও কিছু নাই, কোথাও কিছু থাকতে পারে না – এমন ভাবনার পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

পড়ার আগ্রহের ব্যাপারে মাকে আমার কাছে মীনা কার্টুনের মীনার মতো লাগে।
নানা ছিলেন আলফাডাঙ্গা কাঞ্চন একাডেমির প্রধান শিক্ষক। ১৯৫৪ সালের বিএ পাশ; খুবই সৎ এবং জনপ্রিয় শিক্ষক। তাঁর কন্যাশিশুটির পড়াশোনার ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ। তাই নানির নিমরাজি মনোভাব সত্ত্বেও (ওইসময় এটা স্বাভাবিক ছিলো) নানা আর মায়ের দাদির অনুপ্রেরণায় মা স্কুলে যেতেন। মায়ের দাদির চোখে ছরেজান মাস্টারের সুশিক্ষিত কন্যাদের রেফারেন্স ছিলো, আর মায়ের চোখে ছিলো অক্ষরের ভুবনে বিচরণের সুতীব্র আগ্রহ।

এমনিতে মায়েরা আট ভাইবোন মিলে বড়ো হলেও পিঠাপিঠি দুই ভাইবোনের মিল ছিলো চোখে পড়ার মতো। পিঠাপিঠি ভাইবোন থাকলে যা হয়। একটা সময় পর্যন্ত যা করতেন দুই ভাইবোন একসঙ্গে করতেন। স্কুলে যাওয়া, নানির সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত পিঠা বানানো ইত্যাদি ইত্যাদি। নানি হয়তো চাইতেন না তাঁর ছেলে রান্নাবান্নার কাজ শিখুক, বড়োমামার অসীম আগ্রহের ঠ্যালায় আর নানিরও কাজের জোগাল হচ্ছে বিধায় কাজ করতে দিতেন। বড়োমামা একটা পর্যায় পর্যন্ত দূরের কোনো একটা মিলে বস্তা বস্তা ধান ভাঙিয়ে আনতেন। মা নানির সঙ্গে গৃহস্থালি কাজে হাত লাগাতেন। মায়ের মনে থাকতো কখন কাজ শেষ করে টেক্সটের অদ্ভুত জগতে ডুবতে পারবেন। ধূলা-ওড়া রাস্তার কষ্ট ছাপিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ দেখে মায়ের এক শিক্ষক মাকে সবিস্ময়ে বলেছিলেন: 'ওরে মণি, তোর পড়ালেখার এতো আগ্রহ!' ছোট ভাইটিকে নিয়ে স্কুলে যাবার,  ছরেজান মাস্টারের মেয়েদের মতো শিক্ষিত হবার তাগিদ মাকে মাস্টার্স পাস করিয়ে স্কুলের শিক্ষকতার ভাগ্য জুটিয়ে দিয়েছিলো। নিতান্ত অজপাড়া গ্রাম আর পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক পরিমণ্ডলের কারণে মা শিক্ষকতা করেছিলেন। না হয়, মায়ের যে মেধা আর আগ্রহ ছিলো, তাতে তিনি হয়তো ক্যারিয়ারের দিক থেকে আরও উন্নতি করতে পারতেন।

আরও পড়ুন:আমার বিজ্ঞাপন

গায়ের মধ্যে গাঁয়ের গাঢ় ধূলা আর মাথার মধ্যে পড়াশোনা চাপিয়ে দুই ভাইবোন বড়ো হওয়ার দিকে ছুটতে লাগলেন। দুইজনেরই ব্রেইন শার্প। মামা সায়েন্সে পড়লেন, মা 'মাইয়ে ঝি-পুত' হবার সুবাদে আর্টসে পড়লেন। দুইজনের রেজাল্টই খুব ভালো হলো। মামার ভালো হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ওই সময়। কারণ, ছেলেরা পড়াশোনা করবে আর মেয়েরা ঘরের কাজ শিখবে, শ্বশুরবাড়ি করবে – এটাই ছিলো তখনকার চল। ক্লাসে দুই থেকে তিনজন ছাত্রীর মধ্যে মায়ের ফার্স্ট ডিভিশনে এসএসসি পাশের পর গ্রামের মানুষ মাকে দেখতে এসেছিল। ‘এট্টা শিক্ষিত ছেমড়ি দেখতি কেমন দেখা যায়!’

খাঁচায় পুরে রাখা ভিনদেশি পাখির মতো দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ পেলেন আমার মা। সারাজীবন তাঁকে দেখেই গেছে লোকজন। আমার মায়ের রুচি, শুভবুদ্ধি আর দুর্লভ ভালোমানুষির কিনারা না-পাওয়া মানুষজন তাঁকে যুগের প্রেক্ষিতে আজব মানুষ হিসেবেই দেখে গেছে।

আম্মুর এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশনের সঙ্গে স্কলারশিপ (তখন এটা ছিলো সর্বোচ্চ ভালো রেজাল্ট) পাওয়ার খবরটি নানা সবাইকে চকলেট বণ্টন করতে করতে দেন। নানার সে খুশি দেখে কে? মা ছরেজান মাস্টারের মেয়েদের থেকেও ভালো রেজাল্ট করলেন।

ক্যারিয়ারের দিক থেকে বড়োমামা হলেন আর্মির ডাক্তার, মা হলেন স্কুল শিক্ষক। দুই ভাইবোনের রাস্তা ভিন্ন হলেও দারুণ মিল-মহব্বত এখনও জারি আছে। আমরা এটা প্রায়ই অনুভব করি। বড়োমামা আর মা ভীষণ রাশভারি ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও মনের দিক দিয়ে দুইজনই প্রচণ্ড মানবিক আর সফট হার্টেড মানুষ।
আমার এই বড়োমামা মায়ের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বড়ো সন্তানের মতো করেই। যেটা আমার মায়ের উচিত ছিলো, সেটা কেবল মেয়ে হবার জন্য পারেননি তিনি। তবে আমার নানির প্রায় প্রতি বছর মা হবার রুটিনে আমার মা দারুণভাবে সহায়তা করেছেন। আব্বু যেভাবে গরু চরাতে চরাতে অংক করতেন, মা অনেকটা সেরকমই পায়ের ওপর ছোট ভাই বা বোনকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বই পড়তেন। অর্থাৎ ঘরের কাজ ছিলো মেইন সাবজেক্ট, পড়াশোনা দুইজনের ক্ষেত্রেই অপশোনাল। অথচ পরিবারের এমন ফান্ডামেন্টাল কাজের দায়িত্ব সামলিয়ে দুইজনেরই রেজাল্ট ছিলো অসম্ভব ভালো। এখনকার বাচ্চা-কাচ্চাদের কাছে এগুলো রূপকথার মতো লাগবে।

এখনকার দিনের নারীরা একটু ভাবুন তো, মায়ের মতো মাইলকে মাইল ধূলার পথ পায়ে হেঁটে  স্কুলে যেতে পারতেন কিনা? বা পারলেও ভালো ফল করতে পারতেন কিনা? নির্ধারিত বয়স পর্যন্ত কেবল পড়াশোনা ছাড়া ঘরের বা বাড়ির আর কী কী গুরুদায়িত্ব তাদেরকে সামলাতে হয়?
 আরও পড়ুন:‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’
আমি তো আমার সঙ্গের প্রায় সকল মেয়ে-বন্ধুকে দেখেছি, ভালো বিয়ের বাইরে তাদের জীবনের আর কোনো লক্ষ্য ছিলো না। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেতে দেখেছি অনেকের। মনে আছে, ক্লাস সেভেনে বিয়ে হয়ে গেল বান্ধবী স্নিগ্ধার। এইট বা নাইনে মারিয়ার বিয়ে হলো। ইন্টারে লিমা এবং মুনমুনের। সুমা আর হীরার বিয়ে অবশ্য বেশ পরে হয়। আমার বিয়ে হয় অনার্স ফোর্থ ইয়ারে। মায়ের বিয়ে হয়েছিলো ইন্টারে। আব্বু তখন বোয়ালমারী কলেজের শিক্ষক। আম্মু তখন ইন্টার পরীক্ষা দিচ্ছেন। আব্বুর সঙ্গে আম্মুর বিয়ের কথা আগেই হয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের ঘটক ছিলেন আব্বুর বন্ধু সিরাজ আংকেল। এই সিরাজ আংকেলকে আমাদের বাসায় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আপ্যায়িত হতে দেখেছি আমি। এটার কারণ হয়তো আম্মু-আব্বুর বিয়ের ঘটকালির মতো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা!

পাত্র হিসেবে আব্বুর ডিমান্ড তখন তুঙ্গে। পাত্রী হিসেবে আম্মুর ডিমান্ডও ম্যালা।
এই দুই সংশপ্তক এবং স্কলারকে এক করার ঘটনা মোটেও তুচ্ছ ঘটনা নয়।
আমি স্বয়ম্ভূ হলেও আমার মা তা ছিলেন না। নানার পছন্দই মায়ের পছন্দ। এমনকি আব্বু যখন ইন্টার পরীক্ষার সময় রুম ডিউটির এক ফাঁকে আব্বুর বন্ধু সিরাজের উত্থাপিত প্রস্তাবানুসারে পাত্রী দেখার গোপন কাজটি সেরে ফেলেছিলেন, সেটাও আম্মুর বহু অজানা ঘটনার একটি ছিলো।

অবশেষে আম্মু-আব্বুর বিয়ে হয় ১৯৭৩ সালে। যে বছর আমার নানি তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা মিসেস সোহানা শারমিনকে ধরাধামের মুখ দেখালেন, কিন্তু নিজের মুখটি আব্বুকে দেখাতেন না। শরমে। আগেকার দিনের শাশুড়ি মায়েদের বাচ্চাকাচ্চারা অনেক সময় নিজের বাচ্চার সমান বা ছোটও হতো। এটা তখন শাশুড়ি মায়েদের কাছে ভীষণ শরমের মনে হতো। এরকম ঘটনা আমি আরও অনেক জায়গায়ই দেখেছি। দাদিবাড়ি, নানিবাড়িতে এরকম ঘটনা ভুরিভুরি। আমার মা আর আমার মায়ের আপন ছোট মামার জন্ম সাল একই। কী শরম কী শরম (নানির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে)! আমার শাশুড়ি-মায়ের কোনো কোনো বাচ্চার চেয়ে তাঁর মায়ের কিছু বাচ্চাকাচ্চা বয়সে ছোট।

আরও পড়ুন:প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

মাকে নিয়ে ইতোমধ্যে আমি অনেক শব্দই লিখেছি। কিন্তু কখনো বলা হয়নি আমার মায়ের একটা অসহনীয় সহ্য ক্ষমতা রয়েছে। ২০১২ এবং ২০১৭ সালে তিনি তাঁর স্বামী এবং একমাত্র পুত্র-সন্তানকে হারিয়ে জীবনীশক্তির অর্ধেকের বেশি খুইয়ে ফেলেছেন।

এখন যে মাকে দেখি, সেই মাকে আমি আগে কোনোদিন দেখিনি, চিনিও না।
আমার মায়ের মন ছিলো শাবলের মতো স্ট্রং, র‌্যাশনাল ও লজিক্যাল। একটা ঘটনা বলি। ২০০০ সালের কথা হবে। আব্বু ঢাকায় এসেছিলেন কলেজের কাজে। মিনিস্ট্রিতে সারাদিন কাটিয়ে বিকালে ফেরার কথা; কিন্তু তিনি ফেরেননি। তখন ছিলো ল্যান্ড ফোনের যুগ। ফলে আব্বুর অবস্থান নির্ণয় করা মুসিবতই ছিলো।
সারাদিন কেউ আর খোঁজ নেয় নাই। বিশেষ করে আম্মু। আম্মু জানতেন, আব্বু যেখানেই যান না কেন সারাদিন পরে তিনি ঘরে ফিরবেনই। আমি খুব কম সময়ের জন্য দুজনকে আলাদা থাকতে দেখেছি। কাজের খাতিরে কেউ যদি বাসায় অনুপস্থিত থাকেন, সেই অনুপস্থিতির সময়সীমা বড়োজোর একদিন। এর বেশি কিছুতেই নয়। দীর্ঘ ঊনচল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে আম্মু আর আব্বুকে একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে ঝগড়ার মাত্রা জমির আইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ঝগড়া ছিলো তাঁদের সম্পর্কের গভীরতা পরিমাপের মাপকাঠি। একটু বড়ো হবার পরে আম্মু-আব্বুর মধ্যে বিবাদ হলেই দেখতাম দুজনই নিজেদের বিরুদ্ধের বিভিন্ন অভিযোগ সংসারের অনুকূল ডায়াসে দাঁড়িয়ে পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করে যেতেন। অডিয়েন্স হিসেবে  থাকতাম আমি আর ভাইয়া। আব্বু আম্মুর চেয়ে অধিক সময় বাসায় থাকতে পারতেন তাঁর চাকরির সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে। সেজন্য আমাকে বা ভাইয়াকে একা পেয়ে প্রায়ই বলতেন, 'মারে তোর মা যে... ইত্যাদি ইত্যাদি। ’

আমার খুব হাসি পেতো। মায়ের অনুপস্থিতিতেও মা কতোটা উপস্থিত সেটা ভেবে।
আম্মুর অভিযোগ করবার মতো সময়ই থাকতো না হাতে। আমার মা শুধু ছুটতেন আর ছুটতেন। তবে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে কিছু কিছু অভিযোগও করতেন। আমি সেগুলোকে রুটিন ওয়ার্কই মনে করতাম। হি হি হি

যাহোক, সেই সন্ধ্যায় আব্বু ফিরলেন না।

কিন্তু আমরা এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম যেটা কেবল কাজী আনোয়ার হোসেনের বিখ্যাত 'মাসুদ রানা' সিরিজের দুই-একটা বইয়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। মাসুদ রানার মিথ্যা মৃত্যুর খবর যেভাবে চাওর হয়েছিলো, আব্বুর মিথ্যা মৃত্যুর খবরও সেদিন বিকালের মধ্যে চাওর হয়ে গিয়েছিলো। পার্থক্য শুধু এই, আব্বুর এই খবর সম্পর্কে তিনি নিজে কিছুই জানতেন না। মাসুদ রানা তাঁর বড়ো বড়ো প্রজেক্টের অংশ হিসেবে নিজেই নিজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

একটা মিথ্যা যে কখনো কখনো সহীহ প্রমাণ ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে, এবং গুজবের শক্তি যে কী প্রচণ্ড, সেটা আমি ওইদিন টের পাই।  
ঘটনা নিয়ে নব্য কুয়াশা-কাণ্ড আর না করি। খুলেই বলি।  

আরও পড়ুন:ভাইয়ার 'মনাভাই'

আব্বু কলেজের কাজে আগেরদিন ঢাকা গেছেন। পরদিন বিকালের মধ্যে ফেরার কথা। কিন্তু তিনি সন্ধ্যায়ও ফিরলেন না। বলে রাখা ভালো, আব্বু বোয়ালমারী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের চার্জে ছিলেন তখন। আম্মু ছিলেন বোয়ালমারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের চার্জে।
 
অর্থাৎ একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং তার স্ত্রী গার্লস স্কুলের শিক্ষক। মধুখালি বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান বোয়ালমারীর একটি গার্লস কলেজের ম্যাডাম সোমাতুকানের স্বামী, যিনি কামারখালি বা মধুখালির কোনো একটা কলেজের শিক্ষক ছিলেন, যাঁর নাম শাহদ্বীন বা এমন কিছু একটা। এই খবর বাস মারফত মাঝকান্দি হয়ে বোয়ালমারীতে এসে পৌঁছেছে। ফলে শাহদ্বীন হয়ে গেছে শাহাদাৎ। গার্লস কলেজ হয়ে গেছে গার্লস স্কুল। এভাবেই সত্য বা যেকোনো বর্ণনা টুইস্ট হয়ে কালো থেকে কাকে রূপান্তরিত হয় চিরকাল।

মনে আছে মুহূর্তের মধ্যে পিঁপড়ার জটলার মতো মানুষের ভিড়ে বাড়িতে দাঁড়াবার জায়গা ছিলো না।

কেউ কেউ আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, 'মা-বাপ কারো চিরকাল থাকে না। ' কেউ এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সবার কান্না আর উদ্বেগ দেখে আমিও মড়া-কান্না কেঁদেছি। হঠাৎ মনে হলো আব্বু এতো দ্রুত চলে যেতে পারেন না। আম্মুর মনেও খটকা – আব্বু তো মধুখালি যাবেন না। এটা অন্য কেউও হতে পারে। কিছুতেই কনফার্ম হওয়া যাচ্ছে না। কেননা আব্বু কারো বাসায়ই নাই।

আম্মুকে তখন খুবই ঠান্ডা মাথায় দীপ্ত পদক্ষেপে খোঁজ-খবর নিতে দেখলাম। আমরা সবাই কাঁদছি, অথচ আম্মু না কেঁদে সমানে খোঁজ খবর নিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই ব্যাপারটা তখন সমবেত জনতাও মেনে নিতে পারেনি। পরবর্তীতে আব্বু জানার পরেও সারা জীবন শুধু খোঁটা দিয়ে গেছেন।

অথচ, কেউ এটা ভাবলো না, একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে কি হয়নি সেটাই নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, অথচ মড়া-কান্না কেন কাঁদছেন না, সেটা নিয়ে সবার মাথা ব্যথা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'হলুদ পোড়া' গল্পের কথা মনে পড়ছে। দশচক্রে ভগবানকে ভূত বানিয়ে ফেলা হয়। মায়ের তৎপরতায় এটা নিশ্চিত হওয়া গেল, যিনি মারা গেছেন তিনি গার্লস কলেজের সোমাতুকান ম্যাডামের স্বামী। খবরটি শুনে জমায়েত ভেঙে গেলো ধীরে ধীরে।

রাতে আব্বু ঢাকায় মামার বাসায় পৌঁছানো মাত্রই আমাদের বাড়ির টিএন্ডটি ফোনে কল এলো। আম্মু সঙ্গে সঙ্গে ধরে আব্বুর কণ্ঠ শুনে নিশ্চিত হলেন আমার বাবা মাসুদ রানার মতো গুজবের শিকার হয়েছেন।

সেই বজ্রকঠিন মা আমার কী অসহায় শিশুর মতো চলেন এখন! স্বামী এবং সন্তানকে হারিয়ে জীবনের সমস্ত অর্জিত ও চর্চিত শক্তি খুইয়ে এখন খোসার মতো বেঁচে আছেন।  

একদিনে ঢাকায় এসে অফিসের কাজ সেরে বাড়ি চলে যাওয়ার মতো আমার স্মার্ট মা এখন দুই কদম ফেলতে দশবার মেপে নেন রাস্তা। বয়স আর শোকাবহ মন মাকে একদম খোসা বানিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন:‘ভাগ্যলক্ষ্মীর মহড়া পর্ব’

তার উপর আমি মায়ের সঙ্গে গিয়ে থাকতেও পারি না চাকরি আর সংসারের দায়িত্বের কারণে। মা আমার কাছেও এসে থাকতে চান না, বাড়িতে তাঁর সমস্ত ভালোবাসাময় স্মৃতি ঘরে, গাছের বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মা এখনও নিজে হাতে জমি কুপিয়ে শাক-সবজির চাষ করেন। আমার কাছে মনে হয় এর ভেতরে আম্মু আব্বুকে খোঁজেন। শান্তি পান। আব্বুর সারাজীবনের স্মৃতি এই মাটিতেই জড়িয়ে আছে।  

আমার মা এখন আর কোনো কবিতা লেখেন না। গান লিখে সুরও করেন না। শুধু মাটি কোপান আর আব্বু-ভাইয়াকে স্মরণ করে সময় যাপন করেন।
এ যেন চিরবিরহী আত্মার শোক উদযাপন ক্রিয়া।

আমার মায়ের নাম সখিনা খাতুন। সখিনা নামটা আমার বড়ো অপছন্দের। এই নামের নারীরা চির-দুঃখী। আমার মাও দুঃখী। অথচ, এটা তিনি বুঝতে দেন না।
সবসময়ই খুব সপ্রতিভ এবং ভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী আমার মা। বুঝতে দেন না নিজেকে। রাশভারী গোত্রের নারী।

আমার মায়ের চেহারায় কেমন একটা কঠিন ভাব সমসময় পরিলক্ষিত হয়েছে। ঝুনা নারকেলের মতো শক্ত। দেখে মনে হবে প্রচণ্ড রাগী। কিন্তু ভেতরে মিষ্টি পানির মতো ইনোসেন্ট একজন মানুষ। একবার এক প্রোগ্রামের রিহার্সেলে হৃদি নামের এক ইউএনওর মেয়ে আমার মাকে প্রথমবার দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, 'সেঁজুতি আপু, তোমার মা কি তোমাকে মারবে?' হৃদির ওই কথাটা এখনও কানে বাজে।

আরও পড়ুন:‘সেঁজুতি-সম্ভব পর্ব’

আমার মা আমাকে আব্বুর মতো কোনোদিন মারেননি। কিন্তু বকেছেন বিস্তর। আমার কোনো কাজে বা আচরণে কোনো উলটা-পালটা দেখলে বকা দেন। মায়ের কাছে সন্তান সবসময় শিশু, হোক সে শিশুর জনক বা জননী।

এখনও অসুখ হলে একমাত্র যাকে মনে পড়ে তিনি হলেন আমার মা। মায়ের ডানা ধরে মায়ের স্কুলে যেতে যেতে যে রাস্তাগুলো অতিক্রম করতাম, সেগুলো এখনও সাক্ষ্য দেয় মায়ের সঙ্গে আমি কীভাবে লেপ্টে থাকতাম। ঢাকায় কোনো কাজ নিয়ে এলে মায়ের শাড়ি কোলবালিশে পেঁচিয়ে রেখে শুকতাম আর অশ্রু ঝরাতাম।  

আমার মা যখন হাসতেন, তখন মনে হতো যেন মিশরির দানাগুলো একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বরফের নৃত্য দেখছে। মায়ের শাড়ি পরা, তাঁর ধী-শক্তি, শিক্ষকতাগুণ, র‌্যাশনালিটি, কবিসত্তা, রান্নার হাত – কোনো গুণই ঠিকমতো পাইনি আমি।

সন্তান হিসেবে আমি অধমের অধম।
তবু আমি আমার মাকে এক জনমের কৃতজ্ঞতা জানাই।

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ডিডি