বন্ধু ফয়সল

অলংকরণ: কামরুল

মুক্তগদ্য

বন্ধু ফয়সল

আনোয়ার শাহাদাত

নিচের ছবিটা আমার বাল্য বন্ধুর সঙ্গে [ ফয়সল চৌধুরী, ওর কেতাবি নাম রাজিউর... ] গত ২০২২ এর গ্রীষ্মে ওর ডি. ও. এইস. এর বাড়ীতে তোলা। ছবিটা ঠিক ভাবীর দেয়া ঈদত্তোওর ঐতিহ্যের খাবার শেষে এবং যখন আমি মধ্য প্রাচ্য নিয়মে "ঢেকুর" তুলবার ঠিক পরে। ফয়সলের মুখে আমি ভাবীর [ওর বউয়ের] অনেক গল্প শুনে থেকেছি যেহেতু ফয়সল হচ্ছে প্রকৃত অর্থে "গল্পকার"। ! যখন ওর সনে কথা হয়ে থাকে তখন অন্তত হয় নিরানব্বুই না হলে একশ-একটি গল্প বলবে, যার মধ্যে ভাবীর গল্পও থাকে।

যদিও ভাবীর সংগে এ আমার দ্বিতীয় দেখা । এর আগে আমাদের অপর বন্ধু শাহিনের বাড়ীতে [নিউ ইয়র্কে] অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল ক'বছর আগে যখন ওরা ওদের মেয়ের গ্রাজুয়েশনে এসেছিল।

ফয়সল যেমন ভাল গল্প বলে নিজে, আবার অন্যার্থে ও নিজেই এক আস্ত গল্পও বটে ! [যদিও সে আমার সব বাইল্য বন্ধুরা তো গল্প!] ও খুব অভিজাত পরিবারের শুনে থেকেছি, যদিও আমি তা জানিনা বা আমাদের বন্ধুত্বে সে সবের কোনও দরকার হয়নি। যেহেতু বন্ধু হিসাবে ওকে দেখলে কখনো তা মনে হবে না।

ফলে আমি অন্তত গ্রামের লোক হিসাবে তা জানিনা। ফয়সলও তা আসলে কোনোদিন জানাবার প্রয়োজন বোধ করেনি, আমার ধারণা। আমরা বন্ধুরা তা জানিও না।

ওহ ! ফয়সল কেমন করে নিজেই গল্প ? যেমন আমরা যখন বন্ধুরা যাবতীয় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হিমশিম খাচ্ছি ততদিনে শুনে থেকেছি যে ফয়সল সফলোত্তীর্ন কৃতকর্ম ব্যবসায়ী, "কোটিপতি"! আমার কাছে সে সব কাহিনী গল্পই থেকে গেছে সে এক দূরবাসী শ্রোতা হিসাবে; আমাদের অর্থাৎ বাল্য বন্ধুদের মস্তক তখন হতে ওর প্রতি শ্রদ্ধায় ও ভালবাসায় অবনত ও উদ্ধত হতে শিখেছে, এই মর্মে যে, "এই হলও গে আমাদের বন্ধু-বান্ধব, ইয়ার" এই বলে আমরা আমাদের মাথাকেও যথা সম্ভব খাড়া করে কিছু করতে চেয়েছি...।

একদিন আমি ঢাকার তখন ৬ নম্বর বাসের জন্য মাঝ রাতের আগে গুলশান এক অথবা দুই এর চত্বরে খাঁড়ায়ে আছিঃ তখন ৮৭ সাল উনিশ শতকের; আমি কেবল গ্রাম হতে বরিশাল শহরের যাবতীয় ঘৃণার ধুলা লয়ে ঢাকায় সাংবাদিকতার 'আগাছায় ভরা জংগল' চষতে নেমেছি- সে গ্রামীণ চাষাবাদ ফেলে রেখে যেন। আমি তখন বিচিন্তায় কাজ করি [রিপোর্টারের] দিলুরোডে নিবাস-নিশ্চিত-পেটে-ভাতের সাংবাদিক। জানি না কেমন করে, এরশাদ মন্ত্রী সভার সকল মন্ত্রীরা আমাকে সাক্ষাতকার দিতেন আর তারা সকলেই আমার কাছে বেশম 'ধরা খেয়ে' নাস্তানুবাদ হতেন। সে থেকে কথিত 'তুখোড়' বলে একটা দুন্নাম জুটেছিল, যা কিনা অন্য ভাষায় খ্যাতি বলা যায়। সেই সুবাদে আমাকে যে কেউই তখন সাক্ষাতকার দিতে চাইতেন। মিনার ভাই [বিচিন্তা সম্পাদক, মিনার মাহমুদ] এটা উপভোগ করতেন, ফলে আমি যখন যে সাক্ষাৎকার বা প্রতিবেদনের কথাই বলতাম, তিনি যেন আগাম অনুমোদন দিতেন। তখন মহা আমলা বলে খ্যাত মহিউদ্দিন খান আলমগীর বিরোধী দলে সমর্থন দিয়েছেন। যতদূর মনে পরে তিনি সিভিল সার্ভিস নেতা ছিলেন। আমি তার সাক্ষাৎকার চাইলাম, তিনি বললেন তুমি আমার বাসায় আসো। তার বাসা ছিল ওই কোনও এক গুলশান চত্বর হতে কাছে। । আমি তার সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেরার জন্য ৬ নম্বর বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। তখন দেখি অনেকটা ঢাকার সিনেমার মতন আমার পাশে একটা বিশাল গাড়ী এসে থেমেছে। ওরকম গাড়ী তখন আমি একটিই চিনি, দৈনিকে সংবাদ পত্রে দেখে, যা কিনা তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রীকে [বর্তমান প্রধানমন্ত্রী] উপহার দিয়েছেন বলে শুনে থেকেছি চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগ তখনকার নেতা আখতারুজ্জামান বাবু। ঠিক সেই রকম গাড়ী এসে আমার সামনে খাড়াইল। আমি যখন ওইমতন বিশাল গাড়ী হতে দূরে সরে যাচ্ছি তখন দেখি ওর ভেতর থেকে চালক বলছে "কিরে তুই এই রাইতে এহানে খাঁড়াইয়া রইছ ক্যান?" আমি বলি "৬ নম্বর বাসের জইন্য"। দেখি ও গাড়ী থেকে নামতে চাইছে, আমি বলি - তোর নামতে হইবে নানে, আমার বাস আইয়া পরবে এহুনি"। দেখি ও কানে হাত দিচ্ছে, আমি বলি কীরে তোর কানে কী হইছে, ফয়সল বলে - মনে হয় কানে পানি গেছে। আমি বলি, তো এই রাইতে কানে পানি? ও তখন জানাল যে ও আমেরিকান ক্লাবে গিয়েছিল সেখানে সাতার কেটেছে তখন পানি গেছে।

kkk
বামে ফয়সল ও তার স্ত্রী । ডানে সস্ত্রীক লেখক। ছবি -সংগৃহীত।

আমি কোথায় গিয়েছিলাম এখানে এইসব প্রশ্ন ও আলোচনা আমাদের হয়। ফয়সল যে খুব ধনবান মানুষ তা কোনোদিন মনে হয়না বা কেউ টের পায়। ওর সংগে দেখা বা কথা হলে পরে বোধা যাবে যে ওর বাল্য কাল ও বাল্য বন্ধুদের লয়ে গল্প হবে যার অধিকাংশ আবার জুরে থাকেবে আবার আমাদের অপর বাল্য বন্ধু রিয়াজকে লয়ে, কেনোনা রিয়াজের চাইতে আমাদের মধ্যে আর কেউ অমন সুন্দর করে যাবতীয় গল্প করতে পারে না ফলে; রিয়াজকে ছাড়া আমাদের বাল্য বন্ধুদের কোনও গল্প শেষ হতে পারে না।

আমি যখন বরিশালে যাই, তখন সাংবাদিক খন্দকার স্বপন ও কবি হেনরি স্বপনকে বলি- আমারে একটু তোমাগো এহন বরিশালের কফি খাওয়াও তো... ওরা একটা পাঁচ তারকা মর্যাদার ক্যাফেতে নিয়ে যায়। তো আমরা যখন কফি খাই তখন আমার ফোন আসে, আমি বলি "ফয়সাল তুমি কই?" ও হয়ত জার্মান বা লন্ডনে বা কেবল ঢাকায় এসেছে। ও আমারে জিগায় "দ্যাশে আইচ কবে, কোথায় এখন? [যেহেতু আমি হয়ত আগে ফোন করে মেসেজ রেখেছি], আমি কই বরিশালের অমুক জায়গায়। ফয়সাল বলে ও আচ্ছা। কেমন লাগতেছে বরিশাল। এই সব। কবি হেনরি কী সাংবাদিক স্বপন দেখি হাসে বলে কে? কার লগে কথা কইলেন? আমি বলি আমার বাইল্য বন্ধু ফয়সল। দেখি ওরা দু'জন হাসে। কারণ ওরা জানে যে আমি জানি না এই পাঁচ তারকার স্বত্বাধিকারী হলও নাকি আমার এই বন্ধু যার লগে কথা হয় না জেনেই যে। এই হলও গিয়ে আসলে ফয়সল। কখনো জানা যাবে না...। [এই গল্প দীর্ঘ হতে পারে, ও [আমার বাইল্য বন্ধু, একদা নু ইয়র্ক টাইমস প্রকশানার হেরার্ল্ড ট্রিবিউনের প্রকাশক (বাংলাদেশের) ]

আজ বাল্য বন্ধু মুনিম ও রিয়াজের সংগে কথা হচ্ছিল ওকে বললাম, আমি আর ফয়সল যহন কথা কই তহন তো তোরে লইয়া থাহি! রিয়াজ হাসে। ছবিট ফয়সাল বা ভাবীর অনুমতি ছারাই আপলোড করছি; অনেকটা বরিশালের নিয়মে অর্থাৎ মোরা বরিশাইল্যারা তোমাগই ওইসব "ওয়েস্টার্নাইজড" ফর্মালিটির ধার ধারিনা...।

আহ! জীবন। বারবন হুইস্কি [জ্যাক ড্যানিয়েল শেষ হলে স্কচই ১২ পুরনো লয়ে বরিশালের বরিশালের গান হুনা... সে এক অন্য রকম... চিয়ার্স!]

( বানানরীতি-- লেখকের নিজস্ব) 

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী । বাংলাদেশি-আমেরিকান। গল্পকার ও সাংবাদিক।   যুক্তরাষ্ট্রে  সিবিএস ও এইচবিও তে কাজ করেছেন। ফিল্ম নিয়ে কাজ আছে তার।  

news24bd.tv/ডিডি

সম্পর্কিত খবর