স্ত্রী-কন্যাসহ বিকাশ সরকারকে হত্যা করে আপন ভাগনে রাজিব

গ্রেপ্তার রাজিব

স্ত্রী-কন্যাসহ বিকাশ সরকারকে হত্যা করে আপন ভাগনে রাজিব

আব্দুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ 

সিরাজগঞ্জের তাড়াশে বাবা-মা ও মেয়েকে গলাকেটে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিকাশ সরকারের বড় বোনের ছেলে অর্থাৎ আপন ভাগনে রাজিব ভৌমিককে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রাজিব কুমার ভৌমিক হতাশাগ্রস্ত থেকে তার মামা-মামি ও মামাতো বোনকে হত্যা করেছে।  

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল এসব তথ্য জানিয়েছেন।

 

আটক রাজিব ভৌমিক উল্লাপাড়া উপজেলার তেলিপাড়া গ্রামের মৃত বিশ্বনাথের ছেলে। অন্যদিকে, নিহতের স্বজন ও স্থানীয়রা হত্যাকারী যেই হোক না কেন, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল জানান, সিরাজগঞ্জের তাড়াশের বারোয়ারী বটতলা নিজ বাড়ির তিন তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে মঙ্গলবার সকালে বিকাশ সরকার, তার স্ত্রী স্বর্ণা সরকার ও একমাত্র মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার তুষির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। এ হত্যার রহস্য উদঘাটন ও আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামিউল আলমের নেতৃত্বে পুলিশ ও ডিবির ২০ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়।

নিরলস পরিশ্রমের কারণে হত্যার ১২ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে এবং আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  

তিনি জানান, প্রথমে হত্যাকাণ্ডের শিকার বিকাশ সরকারের একটি মোবাইল রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডের একপ্রান্তে বিকাশ সরকার এবং অন্যপ্রান্তে ভাগ্নে রাজিব ভৌমিকের কিছু কথোপকথন শোনা যায়। এর সূত্র ধরেই রাজিব কুমার ভৌমিককে বিকেলে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর রাজীব কুমার ভৌমিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করে এবং হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন।

আসামি রাজিবের দেওয়া স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, রাজিব ভৌমিকের বাবা ২০১৯ সালে মারা যান। এরপর থেকেই রাজিব পরিবারের হাল ধরেন। একইসঙ্গে তার মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গে খাদ্যশস্য মজুতের ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায় বিকাশ সরকার ভাগ্নে রাজিবকে ২০ লাখ টাকা দেন। রাজিব পর্যায়ক্রমে মামাকে ২৬ লাখ টাকা ফেরত দিলেও বিকাশ সরকার আরও ৩৬ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করেন। আর টাকার জন্য বোন এবং ভাগিনা রাজিবকে বারবার তাগাদা দেন। সর্বশেষ গত বুধবার ভাগ্নে রাজিব ও তার মাকে বকাঝকা করেন। এছাড়াও এনজিও থেকে মায়ের নামে সুদে টাকা তোলায় হতাশায় ভুগছিল রাজিব কুমার ভৌমিক। এসব কারণেই ক্ষুদ্ধ ও হতাশায় পড়ে রাজিব ভৌমিক তার মামাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মাফিক রাজিব শনিবার বিকেলে প্রথমে মামাকে ফোন করে বলেন, টাকা ফেরত দেবো আমি আপনার বাসায় যাচ্ছি আপনি বাসায় আসেন। ওই সময় বিকাশ তাকে বাড়িতে গিয়ে বসতে বলেন। তখন রাজিব বাড়ি থেকে ব্যাগের মধ্যে একটি হাঁসুয়া ও স্থানীয় প্রতাপ বাজারের একটি দোকান থেকে তিন কেজি ওজনের একটি রড কিনে নিয়ে মোটরসাইকেলে তাড়াশে মামার বাড়ি যান। বাড়েতে ঢোকার পর মামি স্বর্ণা রানী তাকে বসতে বলেন এবং ভাগ্নেকে কফি খাওয়ানোর জন্য তিনতলা থেকে নিচে নেমে দোকানে যান। এ সময় রাজিবের মামাতো বোন পারমিতা সরকার তুষি টাকার লেনদেনের বিষয়টি তুলে বলে ভাইয়া আপনি টাকা দিচ্ছেন না কেন? এ নিয়ে মাঝে-মধ্যেই মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হয়। টাকাগুলো দিয়ে দেন। এতে রাজিব ক্ষুদ্ধ হয়ে পারমিতা সরকার তুষির মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করেন। এরপর মামি কফি নিয়ে ঘরে ঢুকে পারমিতা সরকার তুষির রুমে দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও রড দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করেন। এর ১০ মিনিট পর মামা বিকাশ সরকার দরজায় নক করেন। এ সময় রাজিব দরজা খুলে দেবার পর বিকাশ সরকার ঘরে ঢোকামাত্রই তাকে রড দিয়ে আঘাত করেন। এর পর রাজিব ব্যাগ থেকে হাঁসুয়া বের করে একে একে তিনজনকে গলাকেটে হত্যা করেন এবং  তালা লাগিয়ে বাসা থেকে বের হন। পরে মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ার পথে চালমাগুড়া এলাকায় উৎপল সরকারের পুকুরে রড ফেলে দেয় এবং হাঁসুয়াটি ব্যাগে ভরে বাড়িতে নিয়ে যান।  

তিনি আরও জানান, এরপর দুদিনেও যখন স্বজনরা বিকাশ, তার স্ত্রী স্বর্ণা ও মেয়ে তুষির খোঁজ পায় না এবং মোবাইলও রিসিভ হয় না, তখন বিকাশ সরকারের আরেক ভাগনে লিপু বগুড়ার শেরপুর থেকে তাড়াশে আসেন এবং হত্যাকারী রাজিবকে সঙ্গে নিয়ে তার মামার বাগিতে যান। ঘর তালাবাদ্ধ দেখে পুনরায় কল করে দেখে ঘরে ফোনের আওয়াজ শোনা যায়। এতে তাদের সন্দেহ হলে পুলিশকে সংবাদ দেয়। তিনি জানান, তালাবদ্ধ দেখে অন্যান্য স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে রাজিবও তাড়াশ থানায় যান এবং পুলিশকে সঙ্গে এনে দরজা ভাঙেন। রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত আসামি রাজিব স্বজনদের সাথেই ছিলেন।

পুলিশ সুপার বলেন, অডিও শোনার পরই বিকেলে রাজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক পুকুর থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত রড এবং তার নিজ বাড়ি থেকে রক্তমাখা হাঁসুয়া উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের  ঘটনায় বিকাশ সরকারের স্ত্রীর ভাই শ্রী সুকোমল চন্দ্র সাহা বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হবে।  

এদিকে নিহত বিকাশ সরকারের মা শান্তি বেলা ও ভাগ্নে লিপুন বলেন, হত্যাকারী যেই হোক কেন, তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে পারে বলে তারা মন্তব্য করেন।

জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি সন্তোষ কুমার বলেন, জাতি-গোষ্ঠী ভেদাভেদ না করে হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক