দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৯

দাঁড়িয়ে আছি মাধ্যাকর্ষণের টানে

অনলাইন ডেস্ক

আমার কাছে মানুষের জীবনকে একটা পূর্ণ-প্রতিযোগিতামূলক বাজার বলে মনে হয়। এখানে সবাই কেনা-বেচার ধান্দায় থাকে। এই কথা শোনামাত্র কারো কারো পিত্তি জ্বলে উঠবে। তারা বলবে, 'আমরা তো এই তালিকায় নেই!' আমাকে আক্রমণ করে বলে উঠবে, 'এসব ধান্দাবাজি তুমিই করে বেড়াও, আমরা ওসবের মধ্যে নেই।

' এমন শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে যাবার মধ্যেও যে মোটাদাগে সেই প্রতিযোগিতাই থাকে, তা তাদের কে বোঝাবে? সেই ক্ষমতা কার আছে?

আরও পড়ুন:মা

প্রবহমান কথকতা থেকে নিজের চরিত্রের সঙ্গে মিলে যাওয়া বাক্যকে যদি নেতিবাচক মনে হয়, তখন তাকে প্রাণপণ চেষ্টায় বিদ্ধ করে মনে মনে নিজেকে ঋদ্ধ করার প্রাক্টিসটাও প্রতিযোগিতামূলক।

নিজের দাম কীভাবে বাড়ানো যায় সেই প্রতিযোগিতা যিনি নিজেকে এই দলের মনে করেন না তিনিও চালিয়ে যান হরদম। কারণ যুগটা তো পুঁজিবাদের। পুঁজিবাদ মানেই তো কেবল প্রতিযোগিতা।

আর প্রতিযোগিতার মূলমন্ত্র 'সার্ভাইভাবল অফ দ্যা ফিটেস্ট'। এমনকি ধর্মকেও টিকে থাকার জন্য যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে – ধর্ম কেনা-বেচার প্রতিযোগিতামূলক জগতে।
আমাদের নিয়তি আর চিন্তাকে নানা ছুতায় পুঁজিবাদ অত্যন্ত নিপুণভাবে কব্জা করতে সফল হয়েছে। বলেন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ!

যদি বলি, সে স্রষ্টাকেও হাত করে নিয়েছে, তো দোষের কিছু হবে বলে মনে হয় না। মৃত লাশের সৎকারের জন্যও তো অর্থের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে এমন কোনো রাষ্ট্র আছে কিনা জানি না, যে রাষ্ট্র সকল মৃতের সৎকারের দায়িত্ব নেবে কোনো এক বৈষম্যহীন পন্থায়। আদতে দায়িত্বটি ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট কমিউনিটিকে নিতে হয়। ব্যক্তির লোভ থাকে ঈশ্বরের নামে  মৃত্যের সৎকারের মাধ্যমে কিছু পুণ্য কামানোর। এখানেও থাকে প্রতিযোগিতা: কে কতো সোয়াব বা পূণ্য রোজগার করলো তার। এবং অবশ্যই পুণ্যের সঙ্গে বিত্তের একটা অন্যরকম যোগাযোগ থাকবেই।
জন্মের মাধ্যমে মানুষ যেমন একটি ক্লাসকে রিপ্রেজেন্ট করে, মরার পরেও মৃতের দেহের সঙ্গে পড়ে থাকে তার ক্লাস। বাচ্চার কান্না যেমনই হোক, তার পরনে কি পুরনো নরম শাড়ির কাপড় থাকবে, নাকি নতুন মখমলি তোয়ালে থাকবে, সেটা নির্ধারণ করে তার শ্রেণি। জন্ম থেকে  মায়ের কোলে আসা পর্যন্ত তাকে একটি শ্রেণি-চিহ্নের পোশাক পরিয়ে দেয় পৃথিবীর মানুষ। হ্যাঁ, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মিলেই এটা করে। এই শ্রেণিকরণের দায় জো বাইডেন থেকে শুরু করে আপনার, তার, ওর এবং আমার।

সেটা কীভাবে? দাঁড়ান বলছি।

একবার আমাদের এলাকার এক দরিদ্র, যতোটা না দরিদ্র তার থেকে বেশি ঘৃণিত এক নারীর মৃতদেহ সারাদিন পড়ে ছিলো সৎকারের অভাবে। দুপুরে মারা যাওয়ার পর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল, একটা প্রাণী এলো না সৎকারের জন্য। এরকম দরিদ্র ও 'পতিত' পাপী নারীর সৎকার করে সারাজীবনের অর্জিত পুণ্যি যদি  নষ্ট হয়ে যায়! 'পতিতা' যদি বড়োলোক হয় তাহলে একটা কথা থাকে। এ যে গরিব!
অথচ, মৃতের জন্য বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণিগত কোনো বৈষম্য থাকবার কথা ছিলো না। অন্তত ধর্মগ্রন্থগুলো পড়লে এমনটাই মনে হবার কথা।

আরও পড়ুন:আমার একজন হাড়ে-মজ্জায় শিক্ষক এবং জিনেটিক্যালি খামারি পিতা

'ভদ্রপল্লি'র ঈশ্বর বোধ হয় এ জীবনে আর কোনোদিনই অভদ্রপল্লিতে তাঁর অতি মূল্যবান চোখ রাখবেন না! কারণ, এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তারাই তো এগিয়ে, যাদের মস্তিষ্ক আগে থেকেই আগানো ছিলো। 'ভদ্র' তো তারাই, যারা ম্যাসিভ ইউনিভার্সের মধ্যে আধিপত্য রক্ষার জন্য একটা অবৈজ্ঞানিক এবং কৃত্রিম ভাষা-বিধির আকর্ষণ-ক্ষমতার বলে পরস্পরকে আটকে রাখতে সক্ষম। যেকোনোভাবেই শোষণ যাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বিত্তের উচ্চ লেভেলে শোষণের একটা লেভেল থাকেই শেষ পর্যন্ত, তাকে অতিক্রম করা কঠিন। সিস্টেমই এমন। 'ইন আ ফ্রি স্টেট' উপন্যাসে ভি. এস. নাইপল কলোনিয়াল শাসন পর্যায়ে ভারতের নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বিত্তের চক্র বদলানোর চেষ্টা ও পরিণতি দেখালেন দায়ো ও তার দাদার চরিত্রের মাধ্যমে। দায়োর দাদার উত্তম পুরুষে বলা কথাগুলোর মধ্যে মোদ্দা কথাটা হলো, অর্থ মানুষের চরিত্র, সামাজিক অবস্থান আর মনস্তত্ত্বকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে, নিয়ন্ত্রণ তো করেই! অধিক অর্থবান সারা জীবন আগে তার অর্থনৈতিক পোক্ততার বিজ্ঞাপন করে, তারপর প্রতিযোগিতা করে বাকি সব গুণের বিজ্ঞাপন করে। তুলনামূলক কম অর্থবানও বিজ্ঞাপন করে নিজের গুণ আর কর্মদক্ষতার।  
প্রতিযোগিতা করে নিজের বিজ্ঞাপন ও বিক্রির এই প্রক্রিয়ায় কেউ বাদ পড়ে না।

তারাই তো 'ভদ্র', যারা ধনী। গরিবের ভদ্রতাকে আনস্মার্ট, আনকালচারড আর বোকামি ভাবা হয়। স্রষ্টা রাতে কার দিকে ফিরে শোন? যারা শত শত বছর ধরে পৃথিবীটাকে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের, নাকি আয়ুর পক্ষে স্বাভাবিক দমের জন্য যারা লড়াই করে মরে, তাদের?

নাকি পুঁজিবাদ পৃথিবীর সমস্ত পজিটিভিটিকে শুষে নিয়ে নিজের দোকানের কাঁচামাল করে ফেলেছে? জানি না। হয়তো সে কারণেই কোনোপ্রকার নেগেটিভের মধ্যে স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যদি স্রষ্টা থাকা মানেই পজেটিভিটি হয়, তাহলে সর্বত্রগামী স্রষ্টা পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে সকল নেতিবাচকতাকে কেন ঝেঁটিয়ে বিদায় করছেন না, তা বুঝতে পারি না। তবে ধর্মপ্রাণ বলে এক ধরনের বুঝবার ভান করে থাকি। এটাও বুঝি না যে, এই ম্যাসিভ জগতে সব থেকে বেশি ওজন যে জিনিসটার সেটা হলো না বুঝেও বুঝের ভান ধরে জীবিত থাকা।

আরও পড়ুন:আমার বিজ্ঞাপন

কম বোঝাই ভালো। জাবর কাটা জীবনেই স্বস্তির বীজ নিরাপদ। এরকম ভাবনার গায়ে ইতিবাচকতার তকমা লাগিয়েও বেঁচে থাকে মানুষ। অথচ, তাদের ব্যক্তিগত জীবনের পৃষ্ঠা উলটে-পালটে দেখা যায়, চারপাশের সবার চেয়ে তারা চার-পাঁচ পাতা বেশি বুঝে থাকে। যেকোনো পরিস্থিতিকে তাদের স্বভাবসিদ্ধ 'গ্যাসলাইটিং' পদ্ধতির মাধ্যমে আয়ত্তে আনবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। তাতে তাদের যোগ্যতা যাই থাক, চেষ্টা থাকে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের এই প্রতিযোগিতায় কেউ হার মানবার নয়। কেউই না।

'দেখ দেখ আমার ছেলেটা জিপিএ-৫ পেয়েছে। '
'আমার মেয়েটা অমুকের মতো না। '
'আমার বাবা-মা আমাকে এসব শেখাননি। ' – এসব কথাবার্তা মানেই আমরা আমাদের নিজেদের এবং আমাদের বাপ-মায়ের ভালো বীজের বিজ্ঞাপন করি।  

'জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশি। '
'ফুরিয়ে গেলে আর পাবেন না, স্টক সীমিত। ' 
'মাছটা নিয়ে যান স্যার, এই দামে এই মাছ কেউ দেবে না, এই বাজারে। '

ধরুন, মেয়েটা বহু ঘোরাঘুরির পর বিয়ে বা প্রেমে সায় দিয়েছে। ছেলেটা মনে মনে এই বুঝ নিল: 'জিনিস যেটা ভালো, দাম তার একটু বেশিই। '
এমনটা কোনো ছেলের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।

আবার ধরুন, পাত্রের বাবা পাত্রীর বাবাকে পটাচ্ছেন: 'আমার ছেলের জন্য জজ-ম্যাজিস্ট্রেট মেয়ের বাবা-মাও এসে বহু রিকোয়েস্ট করেছেন। ছেলের পছন্দ হয়নি, তাই বিয়েটা হয়নি। '
কী মনে হয়?

'ফুরিয়ে গেলে আর পাবেন না, স্টক সীমিত। '-এর মতো এক ধরনের তাড়ার মিল পাচ্ছেন না বাক্য দুটি থেকে?

ভালো কিতাব পড়নেওয়ালারা বা বুদ্ধিধরেরা ভালো পোশাক পরা মডেলদের মতোই নিজের বিজ্ঞাপন দেন। মানুষ প্রথমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম করতে গিয়ে গোটা সৃষ্টিজগতের মান নিজেদের চেয়ে কমানোর চেষ্টা করে গেছে। এবং তাতে ক্ষান্ত না হয়ে খোদ মনুষ্য জাতির মধ্যেই পৌরাণিক চরিত্র সুন্দ-উপসুন্দের মতো একে অপরের সঙ্গে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াইয়ের অবতারণা করেছে। ফলে, গোটা পৃথিবী পূর্ণ-প্রতিযোগিতামূলক বাজার হিসেবে টিকে আছে। এবং এরকম শত শত প্রতিযোগিতা-নির্ভর বিজ্ঞাপনের সমষ্টিতে মানবজীবন শেষ হয়।  

আরও পড়ুন:‘মোর প্রথম মনের মুকুল ঝরে গেল হায় মনে মিলনের ক্ষণে...’

এই বাজারে চাইতে বা না চাইতে রয়ে যায় কিছু মানুষ। অধিক সংখ্যক মানুষের ইউটিলিটি পাওয়ার, ইন্টেলিজেন্সকে মাথায় রেখে কাজ করা মানুষও দুনিয়াতে আছে।  অল্প-বিস্তর। তারা হয়তো নিজেদের বিজ্ঞাপন ওভাবে করে না।  
কিন্তু এই বাজারে তারাও বিক্রি হয়, অধিক বিজ্ঞাপন ব্যতীত ভালো ব্র্যা ন্ডের পণ্যের মতো।  

ভালো বিক্রির জন্য চাই যেকোনোভাবে ভালো মার্কেটিং।  
সেটা হয়েও যায়। যার বিক্রি কম হয় তার জীবন হতাশায় পরিপূর্ণ। স্রষ্টা তার জন্য কচুটা করেন। শুধু পজেটিভ, সফল মানুষ ছাড়া স্রষ্টা যেন কাউকে চেনেনই না। তাঁকে আত্মা, কলিজা, গুদ্যা দিয়ে ডেকে বেড়িয়েও কারো কারো বিক্রি একেবারে শূন্যের কোঠায়। তখন তারা নিজেকে বিক্রির জন্য পূর্বের পন্থা পরিত্যাগ করে নতুন রাস্তায় নামে।

ধরুন, আপনি ছাত্র/ছাত্রী ভালো। পড়াশোনাও করেন। আপনার আত্মবিশ্বাসও আছে। কোনো একটা কাজের জন্য আপনি খুবই ফিট। না, শুধু ফিট না, ফিটের উপরে ডাবল ফিট। কিন্তু আপনার মার্কেটিং যেকোনো কারণেই হোক সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে, তুলনামূলক কম ফিট কেউ আপনার জায়গায় বিক্রি হয়ে যাবে।

বলে রাখছি, জীবনে বেচা-বিক্রিই মূল। আর এই লক্ষ্যটি পুঁজিবাদ খুব নির্মমভাবে পূরণ করতে পেরেছে।
মানুষ বেচতে বেচতে যে কী বেচে দেয় কখন, তা বোঝাও মোটামুটি মুশকিল। মানুষের মনে-দিলে আসলে কী চায়? একটা গোটা জীবনে মানুষ কী কথাটা বলতে চায়? কী বলে রেখে যায়? কী বলার থেকে যায় আসলে?

আরও পড়ুন:প্রাইমারির প্রজাপতি-কাল

নিজেকে বিক্রির জন্য মানুষ কতো কী না করে? এই যে ধরুন, আগে খেজুরের ঝোলা গুড় কিছুদিন রেখে দিয়ে তাতে চিনি বা মিশরির মতো দানা পড়তো, সেই দানা-পড়া ঝোলা গুড়ও তো দোকানে বিক্রি হতো। এখন তো উলটো চিনি দিয়ে গুড় বানানো হয়। সহজলভ্যতার প্রয়োজনীয়তাকে পুঁজিবাদ খুব প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বাজারে টিকে থাকার জন্য এটা জরুরি। অতো সময় আছে সহি রাস্তায় সুস্বাদু গুড় বানানোর? খুব তাড়া আমাদের প্রাত্যহিকতার মধ্যে। মাথা, হাত আর পায়ের মধ্যে ডিনামাইট বসিয়ে দিয়েছে যেন কে? পৃথিবী নামের বাজারে কীভাবে বাঁচে তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে টিকে থাকা। যেকোনোভাবে টিকতে পারাই কৃতিত্ব। সেখানে ভালো প্রস্তুতি বা ভালো জীবন-যাপন কোনো বিষয় না। আবার প্রস্তুতিও নাই টেকার ভাগ্যও নাই, সেক্ষেত্রে অন্যের ভাগ্যের ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করে নিজের যোগ্যতাকে দিন দিন ভোঁতা করে দেবার দৃষ্টান্তও জগতে আছে।
বিক্রি হতে না পারার হতাশা ভয়াবহ মানবেতিহাসে।

এই যে আমরা প্রতিনিয়ত নিজেকে বিক্রির জন্য দাম হাঁকছি, নিজের পরিচর্যা করছি, এই ব্যাপারটা কিউট।

খোদা আমাদের এই প্রতিযোগিতাকে যথেষ্ট এনজয় করেন বলে মনে হয়।
জন্মসূত্রে আমি একজন মুসলিম। আমার বড়ো হয়ে ওঠার হ্যাবিটেশন ও প্রাক্টিসের মধ্যে ইসলামের নানাবিধ সংস্কৃতি আছে। আছে 'আকিদাহ', আছে 'আখলাকে হামিদাহ' ও 'আখলাকে যামিমাহ'-র প্রাথমিক কেতাবি জ্ঞান, আছে কালিমার গুণাগুণবোধ। গ্রিটিংসে 'আসসালামু আলাইকুম' বলতে হয়, খাবারের আগে 'বিসমিল্লাহ' বলতে হয়, কেউ মারা গেলে 'ইন্নালিল্লাহ' বলতে হয় – এগুলো একেবারে শিশু-বয়সেই শিখে নিয়েছি। এখনও এসব আমার দৈনন্দিন প্রাক্টিসের মধ্যে আছে। এগুলোকে এখন বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতির 'সামাজিক ভাষা' মনে করি। এসবের ভেতর দিয়ে আমরা বাঙালি মুসলমানেরা জাতি হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা করি। ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, সনাতন, জৈনরাও নিজেদের ধর্ম ও জাতির শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতাই করে যাচ্ছে।

আমিও করি।
কখনো জায়নামাজে, কখনো ভোরের সূর্যালোকে, কখনো বাতাসের মুখরতার মধ্যে, কখনো মানুষের প্রতি সহজাত প্রেমের মধ্যে, কখনো কামের মধ্যে, কখনো সন্তানের মাথায় তেল বুলানোর মধ্যে আমি খোদাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। কোথাও স্রষ্টাকে সরাসরি খুঁজে পাই না। শুধু কখনো কখনো খুব ভালো ফিল হয়। এই ফিলিঙ জারি রেখেই আমি জাতি হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রতিযোগিতায় শামিল হই।

 

প্রিয় পাঠক,
আপনারা হয়তো ভাবছেন, এই আত্মজীবনীতে আবার কেন এসব কথা আসছে!
মধ্যাকর্ষণের টানে দাঁড়িয়ে থাকার সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক জীবনের সম্পর্কই বা কোথায়? আমি ছোটবেলায় আব্বুর কাছে একটা গল্প শুনতাম। ফোকাসের গল্প। গল্পটা এরকম:
এক লোক বহু পাণিপ্রার্থী আছে এমন এক মেয়েকে বিয়ে বা প্রেমের জন্য পটাচ্ছে এভাবে: 'শোনো অমুকের সঙ্গে যদি তোমার বিয়ে হয়, তাহলে ও তোমাকে সেই সকালে দুটো  রুটি, দুপুরে চারটা ভাত আর রাতে দুটো রুটি খেতে দেবে। ' তিনবেলা খাবারের এই ঘোষণা সে খুব ধীরে ধীরে টেনে টেনে মীড়সহযোগে দিলো। এরপরে সে খুব দ্রুত লয়ে নিজের বিজ্ঞাপনটি দিলো।  বললো, 'আর আমার সঙ্গে যদি তোমার বিয়ে হয়, তাহলে আমি তোমাকে আজকে খাওয়াবো কালকে খাওয়াবো, আজকে খাওয়াবো কালকে খাওয়াবো। '

আব্বুর বলা এই গল্পটা একটা কৌতুক। কিন্তু আমার উপর্যুক্ত আলাপের সঙ্গে সাংঘাতিক মিল রয়েছে। আমরা এই পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই আর বিজ্ঞাপন করার জন্যই বেঁচে থাকি। কিন্তু পৌরাণিক এবং বিজ্ঞানের ফিকশনের জগতে একটু প্রবেশ করে যদি দেখি, বেন রাজার এই ছেলেটা, অর্থাৎ পৃথিবী যদি মনে করে এই বিজ্ঞাপনসর্বস্ব মানবজাতিকে আমি মেরু অথবা বিষুব অঞ্চলে রেখে দেব, তাহলে একবার ভাবুন তো, ওই ভদ্রলোক, যিনি স্ত্রীকে আজকে এবং কালকে খাওয়াবে বলে পাণিপ্রার্থী নারীটির কাছে নিজের বিজ্ঞাপন করলো, তার জন্য ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতি অপেক্ষা করে থাকতে পারে?

আমরা কি ভেবে দেখেছি, আমরা সারাজীবন প্রাতিষ্ঠানিক পরীক্ষার চেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিযোগিতায় অনেক বেশি এনগেইজড থাকি? জীবনের পুলসিরাত বা পুষ্পশয্যায় আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতাটাই কিন্তু করে যাই আগে।

ঘরের গৃহ-সহকারী যখন অন্য সহকারী নারীদের নিকৃষ্ট দিকগুলো উচ্চারণ করে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে ফোকাস করে খুবই আনন্দ লাভ করে, অফিসের সিনিয়র কলিগরা যখন নিজেদের কৃতকর্মের পজেটিভ দিকগুলো জুনিয়রদের সামনে তুলে ধরে, গোটা দুনিয়াটাকে যখন ফেয়ার এন্ড লাভলির বিজ্ঞাপন মনে হয়, তখন আমি পৃথিবীর ইচ্ছার কথা ভাবি। কী হবে তখন যখন সবাইকে মেজবানির লাইনের মতো করে মেরু অথবা বিষুব অঞ্চলে ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দেবে পৃথিবী? 

কোথায় যাবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বিজ্ঞাপনের কাঁচামাল?

অথচ, আমি নিজেও এখানে নিজের ভাবনা আর বাক্য রচনার মধ্যে দিয়ে নিজের বিজ্ঞাপন করতে এসে গেছি।

প্রিয় পাঠক,
আমার এই আত্মজীবনী পড়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আপনাদের জীবনে নেই। এই ফল্‌স্ ফল্স্ প্রতিযোগিতামুখর দুনিয়ায় নিজেদেরকে 'যোগ্য' করে তোলার রশদ আপনারা অন্য জায়গায় অনেক পাবেন। এ লেখায় নিজস্ব ভাবনাগুলোকে আমি বিশেষ জায়গা দিতে চাই। এর জন্য রবীন্দ্রনাথের সোমলতা বা ডিজে পার্টির হেডফোনের সংযোজন আমি সঙ্গে রাখছি।

যদিও আমি প্রাক্টিসিং মুসলিম, তবু বিজ্ঞাপিত 'সেকুলার' জনগোষ্ঠীর সাবস্ক্রাইবার হিসেবে একটি কথা জানাতে চাই:
পরজন্মের কোনো ব্যাপার যদি থাকে তো আমি মাছের আঁশ হয়ে জন্মাতে চাই।  
একটি পূর্ণ-প্রতিযোগিতামূলক অর্থকরী পৃথিবীতে কেউ মাছের আঁশ নিয়ে টানা-হেঁচড়া নিশ্চয়ই করবে না। এ বিজ্ঞাপনের ওয়ার্ল্ড থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেই তো ভালো।

( চলবে)

লেখক পরিচিতি : কবি, লেখক ও শিক্ষক। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।   বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে কর্মরত।

news24bd.tv/ ডিডি