‘জনগণের গণতন্ত্র’ গণশক্তিরই আরেক নাম

ফরহাদ মজহার--সংগৃহীত ছবি।

‘জনগণের গণতন্ত্র’ গণশক্তিরই আরেক নাম

ফরহাদ মজহার

গণতন্ত্র এবং নাগরিকতা ধ্রুব কিছু? অবশ্যই নয়। গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরনও বটে। রাষ্ট্র ধ্রুব কিছু নয়। রাষ্ট্র না থাকলে গণতন্ত্রও থাকবে না।

রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা কিংবা বিদ্যমান রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষমতা বা গণশক্তির বিকাশ শুধু মতাদর্শ কিংবা ‘সর্ব উদার সমাজ’ নিয়ে আলোচনা না। নাগরিকতা? না, সেটাও ধ্রুব কিছু নয়। গণতন্ত্র ও নাগরিকতা সম্পর্কে এই ধরনের বক্তব্য আমাকে বিস্মিত করেছে। এসব নিয়ে বিস্তর লিখেছি।
অনেকেই পড়েছেন, আশা করি। তারপরও প্রশ্ন তুলছেন? কটাক্ষ করে বলেছেন, আমার ইমান ‘খড়কুটা’র ইমান। বাংলাদেশে জায়নবাদের বিরুদ্ধে ইনি নাকি সাড়া দিতে চান, কিন্তু আমার খড়কুটা ইমানের জন্য নিস্তেজ হয়ে পড়েছেন। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ও তার ওপর গড়ে ওঠা ব্যবস্থা সমাজকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে। এক দিক সামাজিক পরিমণ্ডল বা সমাজ (সিভিল সোসাইটি), বিপরীতে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল (পলিটিক্যাল সোসাইটি) বা রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল। সমাজে নানান পরিচয় থাকলেও রাষ্ট্রের চোখে, সাংবিধানিক অধিকারের জোরে, আইনের চোখে অন্যের সঙ্গে সম্পত্তি, আর্থিক সুযোগ সুবিধা এবং অন্যান্য সামাজিক বা ধর্মীয় পরিচয়ের পার্থক্য থাকলেও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সকলে সমান এই ধারণার ভিত্তিতেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। বিভিন রাষ্ট্রে এই ধারণার বাস্তবায়নে মাত্রাভেদ আছে। সর্বহারা থেকে ধনীক এই ব্যবস্থায় প্রত্যেকেই প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক থেকে বিযুক্ত হয়ে যায় পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক প্রাকৃতিক সম্পর্ক নয়। বিযুক্তির কারণে মানুষ নিজেকে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে সমাজে হাজির দেখে। ফলে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে নিজেকে জানা, বোঝা, উপলব্ধি করা ঐতিহাসিক কারণেই অনিবার্য হয়ে ওঠে। যার কারণে ব্যক্তিতন্ত্রই এই কালে নতুন ধর্ম হয়ে ওঠে।  
নিজেকে কেউ সেকুলার, নাস্তিক, কিংবা অতিশয় ধার্মিক বা ইমানদার ভাবলেও ‘বিশ্বাস’, ‘অবিশ্বাস’, ‘ইমান’ ইত্যাদি ব্যক্তিবাদ বা ব্যক্তিতন্ত্রের জায়গা থেকেই তৈরি হয়। এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সব ব্যক্তির চিন্তা ব্যক্তিগত বিশ্বাসের অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারে না। বলাবাহুল্য ইসলামে ‘ঈমান’ কথাটার অর্থ আদৌ ব্যক্তিগত বিশ্বাস মাত্র কিনা সেটা একালে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার এই কালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসাবে হাজির হয়েছে। সেকুলার কি ধার্মিক স্রেফ ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে কেউই দুনিয়া বদল করতে পারে না। বদল করা যায় না। ইতিহাসের অভিমুখ শনাক্ত করবার ক্ষমতাও অর্জন করা চাই। পুঁজিবাদ নিছকই একটা আদর্শ না, তাকে কোনো ষড়যন্ত্র টিকিয়ে রাখে না, মানুষের ইচ্ছা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস ইত্যদির বাইরে নৈর্ব্যক্তিক ও ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসাবে পুঁজি হাজির। মুখে যে যাই বলুকÑ এ কালে পুঁজিই ‘আল্লাহ’। পুঁজির আনুগত্য না মানলে ভাত-কাপড় বাসস্থান জোটে না। এই চরম কুফরি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা আমি বারবার বলছি। পুঁজি প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ককে আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে মোমের মতো গলিয়ে দেয়। সব সম্পর্ক আমাদের নতুন করে নির্মাণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। পুঁজি মানবেতিহাসের যে সকল মূল্যবান অভিজ্ঞতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে, ধ্বংস করে দিয়েছে নতুন নির্মাণের ভিত্তির জন্য সেই সকল ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অন্বেষণ চালাতে হবে আমাদের। স্মৃতিচ্যুত হওয়া যাবে  না। আরও অনেক অভিজ্ঞতার প্রত্যাবর্তন সহ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা নতুন রূপ নিয়ে ফিরে আসে।  
গণতন্ত্র ও নাগরিকতা দুটোই পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্রের রূপ নিয়ে ঐতিহাসিক ভাবে হাজির। এর সঙ্গে গড়ে উঠেছে আইন-আদালত, সামরিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, র্যাব, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, মতাদর্শ সহ বলপ্রয়োগের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ নানান রূপ। এর বিরুদ্ধে লড়াই করার অর্থ আদতে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই। তাই না? কিন্তু শুরু করা যায় কোথা থেকে? সেই জন্যই প্রশ্ন ওঠে পাল্টা ক্ষমতা নির্মাণের। বিদ্যমান ক্ষমতার ধারক বাহকরা যাই বলুক, জনগণ লড়ে। দেশকালপাত্র ভেদে তার পতাকার রং একরকম থাকে না। পতাকার রং দেখে সেই লড়াইকে বিচার করা নিজ নিজ মতান্ধ বিশ্বাসের জায়গা থেকে গ্রহণ/নাকচের অধিক কিছু হয় না। সেকুলার ও ধর্মবাদী উভয় পক্ষই যা সাধারণত করে থাকে। লড়াইয়ের মর্ম বোঝা ও তার সাধারণ অভিমুখ শনাক্ত করাই এ ক্ষেত্রে জরুরি কর্তব্য। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান জালিম রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই ও পাল্টা ক্ষমতা তৈরির রাজনীতি এ কারণেই আমি সমর্থন করি। কারো পতাকার রং কিংবা জোব্বাটুপি আমাকে বিভ্রান্ত করে না। বিদ্যমান ক্ষমতার বিপরীতে পাল্টা ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়া বা ‘গণশক্তি’ গঠনের এটাই পথ। আর কোনো শর্টকাট পথ নেই। আর ‘জনগণের গণতন্ত্র’ গণশক্তিরই আরেক নাম। তাহলে বাংলাদেশে প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে গণশক্তির বিকাশ সাধন ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে তার পরিগঠন।
না। সেটা ‘উদার গণতন্ত্র’ দিয়ে সম্ভব না। আলবৎ। কিন্তু উদার গণতন্ত্র ও জনগণের গণতন্ত্র বা জনগণতন্ত্র এককথা নয়। বিদ্যমান জালিম রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জণগণতান্ত্রিক শক্তি লড়ে। তাকে চেনা যায় মজলুমের প্রতি জালিমের বিরুদ্ধে ঐক্যের আহ্বানে। উদার গণতন্ত্র জালিম ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখে, জনগণকে বিভক্ত রাখাই তার নীতি। এগুলো মীমাংসিত পুরানা তর্ক। যে কারণে উদার গণতন্ত্র ‘কুফরি’ ছাড়া আর কিছু না। কারণ উদার গণতন্ত্রীরা সত্য লুকায়। জায়নবাদ বা যে কোনো ধরনের জাতিবাদী আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ও তার বিপদ সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক শুনে যারা বলছেন, তারা লড়তে চান, কিন্তু ‘খড়কুটা’র ওপর ইমান রেখে তারা লড়বেন না তো অসুবিধা কি? আপনার হাতে ইমানের ইঁট-পাথরের দিয়ে তৈয়ারি রাজনীতি থাকলে তাই দিয়েই লড়ুন। ধর্মবাদী কিংবা সেকুলার লড়াইয়ের নামে কোনো না কোনো প্রকার জাতিবাদী বা জাতীয়তাবাদী আত্মপরিচয়ের খাপে ঢুকে নিজের ‘অপর’-কে কচুকাটা বা নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতি সম্পর্কে আপনি হুঁশিয়ার কিনা সেটাই আমার দেখার বিষয়। আর যারা আসলেই লড়বেন বা লড়েন তারা আমার কথায় নিস্তেজ হবেন কেন? যারা লড়াকু সংগ্রামের ময়দানে তাদের চিনতে আমার ভুল হবে না। আবারও বলি, পতাকার রঙ দেখে আমি মজলুমের পক্ষে দাঁড়াই না, মজলুম বলেই তার পক্ষে দাঁড়াই।  

news24bd.tv/ ডিডি

এই রকম আরও টপিক