শিশুর মন থেকে ভয় দূর করার ইসলামী নির্দেশনা

প্রতীকী ছবি

শিশুর মন থেকে ভয় দূর করার ইসলামী নির্দেশনা

 আলেমা হাবিবা আক্তার

দুর্বল মনের শিশুরা, যারা স্বভাবে লাজুক ও মানুষের সঙ্গে মিশতে ভয় পায়, তারা অনেক সময় লেখাপড়া ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে পড়ে। এদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শিশুর মন থেকে ভয় দূর করা এবং তাকে সাহসী করে তোলা আবশ্যক। যেন তারা জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারে।

সাহসিকতা কাকে বলে?

আরবি ভাষায় সাহসিকতা বোঝাতে ‘সুজাআহ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। পরিভাষায় সাহসিকতা হলো প্রতিকূল ও বিপদাপদে অন্তর দৃঢ় থাকা এবং ভয়ভীতির সময়ে হৃদয় স্থির থাকা। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘বহু মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে শক্তিকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। অথচ দুটি ভিন্ন বিষয়।

সাহসিকতা হলো বিপদাপদে অন্তর দৃঢ় থাকা; যদিও ব্যক্তি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়। ’ (আর রুহ, পৃষ্ঠা ২৩৬)
সাহসিকতা প্রশংনীয়

সাহসিকতা প্রশংনীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সবচেয়ে সাহসী মানুষ। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) ছিলেন সবচেয়ে সুশ্রী ও সাহসী।

এক রাতে মদিনাবাসী (শব্দ শুনে) আতঙ্কিত হলো এবং শব্দের উৎসর দিকে বের হলো। তখন নবী (সা.)-এর সঙ্গে তাদের দেখা হলো এমতাবস্থায় যে তিনি পরিস্থিতি নিশ্চিত হয়ে ফিরছিলেন। এ সময় তিনি আবু তালহার জিনবিহীন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ছিলেন এবং তাঁর কাঁধে তরবারি ঝুলানো ছিল। তিনি তাদের বলছিলেন, তোমরা ভীত হয়ো না, তোমরা ভীত হয়ো না। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৯০৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৩০৭)
সাহসিকতা ও শক্তির পার্থক্য
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরে এই উম্মতের সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তি।

ওমর (রা.)-সহ অন্যরা তাঁর চেয়ে শক্তিশালী ছিলেন। আবু বকর (রা.) এমন সব ক্ষেত্রে অন্তরের দৃঢ়তার জন্য অন্য সাহাবিদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন যেগুলোতে পাহাড় পর্যন্ত টলে যায়। এসব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দৃঢ় মন ও স্থির চিত্তের অধিকারী। সাহসী ও বীর সাহাবিরা তাঁর কাছে আশ্রয় নিত। তিনি তাদের দৃঢ় রাখতেন এবং সাহস যোগাতেন। ’ (আল ফুরুসিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৫০০)

সাহস যেভাবে তৈরি হয়

আল্লামা ইবনু কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি সুধারণা থেকে সাহসিকতার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি যখন বিজয়ী হওয়ার ধারণা রাখে এবং ধৈর্য তার সহযোগী হয়; তখন সে দৃঢ় থাকে। অনুরূপ কাপুরুষিকতার জন্ম কুধারণা ও অধৈর্য থেকে। এমতাবস্থায় ব্যক্তি বিজয়ের কথা ভাবে না এবং ধৈর্যও তার সহযোগী হয় না। কাপুরুষিকতার উত্পত্তি কুধারণা ও মনে খারাপ কুমন্ত্রণা থেকে। ’ (আর রুহ, পৃষ্ঠা ২৩৬)

মনের ভয় যেভাবে দূর হয়

শিশুর মন থেকে ভয় দূর করতে প্রাজ্ঞ আলেমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুশীলন করার পরামর্শ দেন। তা হলো—

১. ঈমানি শিক্ষায় শিক্ষিত : শিশুকে যখন শেখানো হবে ভালো-মন্দ যা কিছু হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। তিনি তোমার জন্য ভালো কিছুই নির্ধারণ করে রেখেছেন। এখন প্রয়োজন শুধু কাজটি সুন্দরভাবে করা এবং যথাযথভাবে চেষ্টা করা। তুমি যদি ভালো কাজে চেষ্টা করে ব্যর্থ হও, তবু আল্লাহ তোমাকে প্রতিদান থেকে বঞ্চিত করবেন না। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা মুমিন হয়ে পরকাল কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে তাদের প্রচেষ্টা পুরস্কারযোগ্য। ’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১৯)

২. ভালো কাজে উৎসাহী করা : শিশুকে যখন ভালো কাজের উৎসাহ দেওয়া হবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করা হবে, তখন তার ভেতর ভালো কাজ করার স্বভাবজাত অনুপ্রেরণা তৈরি হবে। ফলে সে ভালো কাজ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকবে। অন্যকেও তা থেকে বারণ করতে শিখবে। লোকমান হাকিম (রহ.) যেমনটি সন্তানকে বলেছিলেন, ‘হে ছেলে! নামাজ কায়েম করো, সৎকাজের আদেশ দাও আর অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং আপদে-বিপদে ধৈর্য ধারণ করো। এটাই দৃঢ়সংকল্পের কাজ। ’ (সুরা : লোকমান, আয়াত : ১৭)

৩. সত্য বলতে অভ্যস্ত করা : সত্য মানুষের ভেতর সাহস সৃষ্টি করে এবং মিথ্যা মানুষের ভেতর হীনম্মন্যতা তৈরি করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা সত্য এনেছে এবং যারা সত্যকে সত্য বলে মেনেছে, তারাই তো মুত্তাকি। ’ (সুরা : ঝুমার,আয়াত : ৩৩)

৪. মানসিক দ্বিধা দূর করা : দ্বিধা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিক দুর্বলতার প্রমাণ। তাই সন্তানকে সাহসী করে তুলতে ভালো কাজে মানসিক দ্বিধা দূর করা এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী করে তোলা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘আনুগত্য ও ন্যায়সংগত বাক্য তাদের জন্য উত্তম ছিল; সুতরাং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো যদি তারা আল্লাহর প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ করত, তবে তাদের জন্য এটা অবশ্যই মঙ্গলজনক হতো। ’ (সুরা : মুহাম্মদ, আয়াত : ২১)

৫. বীর ও সাহসীদের গল্প শোনান : শিশুদের যখন ইসলামের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বীর ও সাহসী ব্যক্তিদের গল্প শোনানো হবে, তখন তাদের ভেতর সাহস জন্ম নেবে; বিশেষত ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার জন্য সাহাবিদের অসামান্য আত্মত্যাগের বর্ণনা তাদের মনে ভয় দূর করতে সহায়ক হবে ইনশাআল্লাহ!

আত্মনিয়ন্ত্রণহীন সাহসী নয়

শিশুর মন থেকে ভয় দূর করা এবং তার মনে সাহস তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যে শিশু যেন আত্মনিয়ন্ত্রণহীন ও অহংকারী না হয়ে যায়। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কুস্তিগির প্রকৃত বীর নয়, বরং সে-ই প্রকৃত বীর যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১১৪)

সাহস দেখানোই সাহসিকতা নয়

শক্তি ও সাহস প্রদর্শনই প্রকৃতপক্ষে সাহসিকতা নয়, সাহসিকতা হলো কল্যাণের পথে ভয়হীন চিত্তে এগিয়ে যাওয়া। আল্লামা ইবনে হাজম (রহ.) বলেন, ‘সাহসিকতার সংজ্ঞা হলো—আমৃত্যু জীবন ব্যয় করে ধর্ম রক্ষায়, নারীর সম্ভ্রম ও সম্মান রক্ষায়, নির্যাতিত প্রতিবেশী ও মজলুম আশ্রয়প্রার্থীর রক্ষায়, সম্পদ ও সম্মানের ওপর জুলুমের শিকার ব্যক্তিকে রক্ষায় এবং সত্যের পথে অবিচল থাকা; চাই বিরোধীরা কম হোক বা বেশি হোক। উল্লিখিত ক্ষেত্রে ত্রুটি করাই হলো কাপুরুষিকতা ও ভীরুতা। একইভাবে দুনিয়াবি স্বার্থে এটি ব্যয় করা অবিবেচনাপ্রসূত কাজ ও নির্বুদ্ধিতা। ’ (আল আখলাক ওয়াস সিয়ার, পৃষ্ঠা ৩২)

আল্লাহ সব শিশুর মন থেকে ভয় দূর করে দেন। আমিন।

 


 

সম্পর্কিত খবর